শিক্ষিত ও সম্পদশালী পরিবারে গ্রামীণ নিম্নআয়ের মানুষের আগমন কমে গেছে। শৈশবে আমরা শ্রেণি-বর্ণ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিশতাম, উপকরণ বিনিময় করতাম। গ্রামীণ সম্প্রীতির ওই আন্তরিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
Published : 13 Apr 2025, 09:43 AM
বর্ষবরণ তথা পাহাড়ের বৃহত্তম সামাজিক উৎসবটি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। চাকমারা বলেন ‘বিজু/বিঝু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই/সাংগ্রাইং’, ত্রিপুরারা ‘বৈসু/বৈসুক’, তঞ্চঙ্গ্যারা ‘বিষু’, খেয়াংরা ‘সাংলান’, চাকরা ‘সাংগ্রাইং’, ম্রোরা ‘চাংক্রান’, খুমিরা ‘সাংক্রাই’ ও আসামিরা ‘বিহু’ বলেন। পাহাড়ে কিছু সংখ্যক সাঁওতালও বাস করেন, তারা এটিকে ‘পাতা’ বলেন। একসময় এই উৎসবকে একত্রে বোঝাতে আদ্যাক্ষর সাজিয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হলেও, বর্তমানে বিতর্ক এড়াতে অনেকে সকল জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করতে পছন্দ করেন। এপ্রিল মাস এলেই পাহাড় যেন নেচে ওঠে। সর্বত্র প্রস্তুতির ধুম পড়ে যায়। প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক আয়োজন শুরু হয়। গ্রামের মানুষ উৎসাহ নিয়ে এতে অংশ নেন।
উৎসব উপলক্ষে বর্তমানে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা একটি প্রথায় রূপ নিয়েছে। একই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে শোভাযাত্রা বের হতে দেখা যায়। অনেকে এটিকে নিজেদের সমর্থন ও শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন। শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়, তবু এটি এখন যেন বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে। বড় সংগঠনগুলো বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে শোভাযাত্রা করে। উৎসবকে ঘিরে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খেলাধুলা ও লটারি বিক্রির প্রচলনও বেড়েছে। এসব আয়োজন উৎসবের আমেজ বাড়ালেও কখনো কখনো বাণিজ্যিক রূপ নেয়।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, উৎসবকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের মূল্যবান সামাজিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পাচন তরকারি। বিশ বছর আগেও গ্রামের নারীরা দলবেঁধে বন-জঙ্গলে গিয়ে পাচনের উপকরণ সংগ্রহ করতেন। বাঁশের কোড়ল, কাঁচা হলুদ, বনের টক পাতা, লতাপাতা, ‘চঃরগঙ’, ‘চেঞাং’, ‘তহ্-ম্রক’—এসব উপকরণ সংগ্রহ করে তারা একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করতেন। এই বিনিময় পাচন রান্নাকে আনন্দময় করে তুলত। এখন গ্রামবাসীরা আর বনে যান না। পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই বাজারমুখী হয়ে পড়েছেন। উৎসব উদযাপনে এখন গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষকেও বাজারের দিকে ছুটতে দেখা যায়। বাজার থেকে কেনা উপকরণ একে অপরের মধ্যে বিনিময় হয় না। শিক্ষিত ও সম্পদশালীদের মধ্যে পাচনের উপকরণ বিনিময়ের পরিবর্তে প্রতিযোগিতা চলে— কে কত বেশি উপকরণ মিশিয়ে রান্না করতে পারছে, তা নিয়ে প্রচার চলে।
আমাদের শৈশবে উৎসব মানেই ছিল চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা পাড়ায় দলবেঁধে বেড়ানো। সবাই মিলে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতাম। কিন্তু এখন এই প্রথা অনেকটাই কমে গেছে। শিক্ষিতরা শিক্ষিতদের বাড়িতে, গরিবরা গরিবদের বাড়িতে, গ্রামীণরা গ্রামীণদের বাড়িতে বেড়ান। শিক্ষিত ও সম্পদশালী পরিবারে গ্রামীণ নিম্নআয়ের মানুষের আগমন কমে গেছে। শৈশবে আমরা শ্রেণি-বর্ণ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিশতাম, উপকরণ বিনিময় করতাম। এখন এসব প্রথা খুবই কম দেখা যায়। গ্রামীণ সম্প্রীতির ওই আন্তরিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
পাহাড়ে এখনো নানা ফলমূল পাওয়া যায়। রাজধানী ও সমতলের মানুষ পাহাড়ের ফলমূল সংগ্রহ করতে আগ্রহী হলেও, আমরা পাহাড়বাসীরা উৎসবে স্থানীয় ফলমূলকে আপ্যায়নের তালিকায় কম রাখি। যেমন, পাহাড়ের বেল, কলা, পেঁপে স্বাদে-গুণে ভালো হলেও শরবত বা জুস করে পরিবেশনের প্রচলন নেই। উৎসবে ঘরে ঘরে জুস পরিবেশনে বাজারের কোমল পানীয় বা রঙিন জুসেরই দখল থাকে বেশি।
উৎসবের শুরুতে ফুলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। নদী-ছড়ায় ফুল দিয়ে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রথা এখন মিডিয়ার কল্যাণে জনপ্রিয় হয়েছে। এই দিনে নারী ও তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে নদীতে কলাপাতা বিছিয়ে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। অনেকে প্রদীপ জ্বালান, সন্ধ্যায় কলাগাছের বাকলে প্রদীপ ভাসান। এই দৃশ্য অপূর্ব। তবে, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এমন দৃশ্যও এখন কম দেখা যায়। আমাদের উৎসবে ‘বিজু ফুল’ বা ‘সাংগ্রাই পেইং’-এর ব্যবহার থাকলেও এই ফুল এখন বিলুপ্তপ্রায়। বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় এই ফুল খুব কমই দেখা যায়। আমরা এই প্রাকৃতিক ফুল সংরক্ষণ করতে পারিনি, ঘরের উঠোনে এর জায়গা করে দিইনি।
উৎসবের আগে বিজু ফুল ফুটলে আমরা ছবি তুলি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করি। কিন্তু বনের এই ফুলকে ঘরের ফুলে রূপান্তর করিনি। দেশি-বিদেশি ফুলের ভিড়ে উৎসবের বার্তাবাহক এই ফুলকে আমাদের আঙিনায় স্থান দিইনি।
উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যয় বেড়েছে। আনন্দ বাড়ানোর নানা চেষ্টা বাড়িয়েছি, কিন্তু মূল্যবোধের চর্চা বাড়াইনি। আমরা এখন আর পাচনের উপকরণ বিনিময় করি না, বরং বেশি উপকরণ জোগাড়ের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। আমরা খরচ বাড়িয়েছি বিস্তর, অথচ আত্মীয়-প্রতিবেশীরা উৎসব করতে পারছে কিনা ওই খোঁজ নিই না। আমরা এখন প্রকৃতি ও জুমের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাজারমুখী হয়েছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শুঁটকির পরিবর্তে দামি শুঁটকি, ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের পরিবর্তে দামি কাপড়ের ব্যবহার বাড়িয়েছি। ফলে গ্রামীণ মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তে বাজারমুখী সংস্কৃতি বেড়েছে।
যদি আমরা শৈশবে দেখা দাদা-দাদি, নানা-নানিদের মূল্যবোধের চর্চা ফিরিয়ে আনতে পারি, তবেই উৎসব সবার জন্য সমান আনন্দের হবে। আসুন, প্রতিযোগিতার পরিবর্তে ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহানুভূতির মূল্যবোধ চর্চা করি। উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। সকলকে বৈসু, বিজু, সাংগ্রাই, সাংলান, সাংক্রাই, সাংগ্রাইং, পাতা, চাংক্রান, বিহু, বিষু ও বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।