প্রতিপক্ষের জন্য হৃদয়ে সামান্য একটু ভালোবাসা জিইয়ে রাখতে হয়। আর তা যদি রাখা না হয় তাহলে সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ হবে কীভাবে? আলাপ-আলোচনা হলো সভ্যতা আর ভয়ভীতি অসভ্যতার প্রতীক।
Published : 24 Jul 2024, 04:18 PM
দেশজুড়ে অনেক রক্ত ঝরল। হতাহতের সংখ্যা নিছক কম নয়। তবে এটি কেবল সংখ্যার বিষয় নয়। সংখ্যা দিয়ে এমন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রতিটি নিহতের ঘটনা স্বতন্ত্র। গুণগত। প্রতিটি মৃত্যু ও প্রতিটি জীবন আলাদা বৈশিষ্ট্যময়। একটি সমাজে যখন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায় তখন বুঝতে হবে সমাজের সুস্থতা ও স্থিতিতে ক্ষয় ও ক্ষরণ ধরেছে।
আজকের বাস্তবতায় জীবন বিভক্ত করছে, কিন্তু মৃত্যু করছে এক। নিহতদের প্রোফাইল দেখলে দেখা যাবে এদের বেশির ভাগ সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। অধিকার প্রতিষ্ঠায় গরিব মানুষের আত্মত্যাগ এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। মধ্যবিত্ত কিছুটা পারে, উচ্চবিত্ত একেবারেই পারে না, তবে গরিব সহজেই জীবনের মোহ ত্যাগ করতে পারে। গরিবের সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বোধ গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখার সময় এসেছে।
প্রতিটি ফোঁটা রক্ত মূল্যবান, প্রতিটি প্রাণ অসামান্য। দিন শেষে একটি নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখছি আমরা। রুচিহীন পরিস্থিতি। এত অমানবিক বাংলাদেশ কেউ চায়নি। কোনো আন্দোলনকে ঘিরে এত অল্পসময়ে প্রাণহানির এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ আর রক্তক্ষয়ের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। ঢাকায় বাসার ছাদে খেলতে গিয়েও গুলিবিদ্ধ হয়েছে শিশুরা।
এ সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা যেত। কিন্তু আমরা সেদিকে না গিয়ে এক সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করলাম। সহনশীলতার মধ্য দিয়ে একটি সহঅবস্থানমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করতে আমরা বার বার ব্যর্থ হচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, সমাজ সংখ্যাগরিষ্ঠ (শাসকগোষ্ঠী) ও সংখ্যালঘিষ্ঠদের (বিরোধী রাজনৈতিক দল, ভিন্ন মত) নিয়ে গঠিত। এ দুই শক্তির মধ্যে ন্যূনতম ভারসাম্য না থাকলে সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তে বাধ্য। একটি শাসন ব্যবস্থায় জনপরিসর যত সংকুচিত হবে প্রতিবাদের বিকল্প তত শক্তিশালী হয়ে উঠবে হবে। সহিংসতা এবং ক্ষোভ বাড়বে। আমেরিকান নৃবিজ্ঞানীয় আরজুনা আপাদুরায় তার ‘ফিয়ার অব স্মল নাম্বারস’ বইয়ে সংহিসতার নৃ-তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তিনি দুটি ক্যাটাগরিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন আর তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠরা ভোগে অসম্পূর্ণের উদ্বিগ্নতায় (anxiety of incompleteness) আর সংখ্যালঘুরা ভোগে অনিশ্চয়তায় (uncertainty)।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বড় ধরনের সহিংসতা কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী পরিচয়কে ঘিরে সংঘঠিত হয় না বরং এর মধ্যে দিয়ে সংখ্যালঘুরা নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নিশ্চিত হতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের ভেতর পূর্ণসংযুক্তি (full attachment) তৈরি হয়, তারা বিক্ষুব্ধ হয়।
‘আমরা’ ও ‘তারা’ সর্বনামে যে আলাদাকরণ প্রচেষ্টা তা সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। আমরা এমন বাস্তবতার ভেতর রয়েছি। আরজুনা আপাদুরায় আরও মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিসীমার মধ্যে সংগরিষ্ঠের সম্পন্ন (complete) হওয়ার চেষ্টা একটি হতাশামূলক প্রচেষ্টা। যা সংঘাত উস্কে দেয়, জনমনে ক্ষোভ তৈরি করে।
ক্ষোভকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেকসময় ক্ষোভ নতুন নিশানার সন্ধান দেয়। ফ্রাঙ্ক ব্রুনি তার ‘দ্য এজ অব গিভেন্স’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ক্ষোভ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত, যা আলোকায়নের দিকে নিয়ে যায় (Grievance has been the precursor of justice, the prelude to enlightenment)।
যাহোক, সহিংতার পর এক ভিন্নধরনের তথ্য উপস্থাপন করেছে একটি দৈনিক সংবাদপত্র। সংবাদপত্রটি লিখেছে এ সহিংসতার পর কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগ এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় চারশ জন। অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। অনেকে চোখ নিয়ে গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন। যিনি চলে গেছেন তিনি তো গেছেন, আর যারা চোখ হারিয়েছেন বা হারানোর আশঙ্কায় আছেন তাদের কথা একবার ভাবুন। একটা আন্দোলন চারশ জনের চোখ সংকটাপন্ন করে তুলল। জানি না, কোন পরিস্থিতিতে গান্ধীজী বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ পুরো জাতিকে অন্ধ করে তুলবে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও একটি দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে, রক্ত ঝরাতে হচ্ছে, এর চেয়ে নির্মমতা আর কি হতে পারে? প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও তার যথাযথ প্রতিকার হওয়া উচিত। কারণ, কেউ জীবন দিতে পারে না, সুতরাং তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। যাই হোক, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কোটা ইস্যু একটি জায়গায় এল। কিন্তু কোটা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের আরও কিছু দাবি রয়েছে সেগুলোও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
উল্লেখ্য, একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রয়েছে জনগণের দাবিভিত্তিক আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ‘‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন”। সেই সময় এ কর্মসূচি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, নিজের হক পাওয়া দাবি করা অন্যায় নয়, কর্তব্য।
জাতির পিতার রাজনৈতিক জীবনের মূল সংগ্রাম ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ভোট ও ভাত অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিশানা স্থির করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে পথে হাঁটছে, যেভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতে তার রাজনৈতিক পরিপক্কতা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।
সময়টা হলো এখন ডায়ালগ বা সংলাপের। কিন্তু আজ ঘৃণা ও ক্ষোভ এত বেশি যে কেউ কাউকে শত্রু জ্ঞান করলে তার সঙ্গে বসার ন্যূনতম রুচি ও পরিবেশ হারিয়ে ফেলে। নেলসেন মেন্ডেলা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন–২৭ বছর জেলখাটার পর যখন সাদাদের সঙ্গে প্রথম মিটিং বসলাম তখন আমরা উভয় পক্ষ উপলব্ধি করলাম আমাদের কারো মাথায় শিং নেই (অর্থাৎ কেউ অতটা হিংস্র নয়)। কিন্তু এত দীর্ঘসময় আমাদের বসা হয়নি। মোদ্দা কথা হলো, বসলেই একটা বিকল্প বের হয়। এজন্য সমঝোতামূলক মনোভঙ্গি জরুরি।
মডার্ন পলিটিক্যাল ডিসকোর্সে বলা হয়, প্রতিপক্ষের জন্য হৃদয়ে সামান্য একটু ভালোবাসা জিইয়ে রাখতে হয়। আর তা যদি রাখা না হয় তাহলে সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ হবে কীভাবে? আলাপ-আলোচনা হলো সভ্যতা আর ভয়ভীতি অসভ্যতার প্রতীক। আমরা ভয় বা শঙ্কিত না পেলে সিদ্ধান্ত ও অবস্থান বদলাই না। সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহ তার সবচেয়ে বড় উদহারণ।
শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন যাবৎ কোটা সংস্কারের দাবি তুলে আসছে। সরকার তাদের এ দাবি তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করেনি। বরং শিক্ষার্থীরা অমর্যাদাকর বিশেষণে বিশেষায়িত হয়েছে। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে শ্লেষমাখা যে শ্লোগান দিয়েছে যার মর্মার্থ বুঝতে অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি অনেক প্রখ্যাত এবং শিক্ষিতজনও।
আমরা বিদ্রুপাত্মক বা স্যাটায়ার বোঝার সক্ষমতা হারিয়েছি। রাজনীতিতে নান্দনিকতার বোধ বা স্যাটায়ার একদম উপেক্ষিত হলো। এখন সবকিছু সরাসরি, সরাসরি গুলি, কাঁচা রক্ত, সরাসরি আত্মম্ভরিতা সর্বস্ব প্রেসকনফারেন্স, সরকারি-বেসরকারি ও প্রাইভেট বাহিনীর সরব উপস্থিতি।
গণতন্ত্র না থাকলে চরম মনোভাব তীব্র হয়। জনগণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। তাদের মনে হয় একদলা কাদা। গণতন্ত্রহীন কাঠামো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভোগে চরম আত্মতুষ্টিতে। জনগণের দাবি-দাওয়া, আন্দোলন তাদের কাজে খুব বিরক্তিকর। জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে তারা এড়িয়ে যেতে যান।
একটি ন্যায়সঙ্গত দাবিকে অন্যায্য হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। একাজে তারা নিজেদের পরিষদ, পোষা বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ও সাংবাদিকদের কাজে লাগান। কোট সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। একটি অপরিশোধিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা মানেই অন্যায্য শাসন যেখানে নীতি-নৈতিকতা অপৃসয়মাণ। এমনকি তীব্র অহংবোধের কারণে তারা একটি পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা হারান।
মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল-সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আজ আকাশ সমান এবং তা বেড়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সংবিধানের বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টোচিত্র। বিভক্তি সমাজের সর্বক্ষেত্রে নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নোবেলজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ তার ‘গ্রেট ডিভাইড’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, সবার জন্য ন্যায় বিচার শব্দগুচ্ছ শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু ন্যায়বিচার তাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব যারা এটা ক্রয় (afford) করতে পারে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিগত ৫৩ বছরে মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রোমোট করেছে।
এ কোটা সংস্কার আন্দোলনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা মিলেছে। নায্যতার প্রতি মানুষের সমর্থন যে এখনও শেষ হয়ে যায়নি তা দৃশ্যমান হচ্ছে। লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির কারণে এক বৃহৎ রাজনৈতিক গোষ্ঠী একই বয়ান, একই সঙ্গে, বিভিন্ন স্থানে উচ্চারণ করছে। তাতে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। কারণ, দিনশেষে মানুষ জেতে এটিই ইতিহাসের শিক্ষা। যদিও এ জেতা সবসময় সহজ নয়, এর বিনিময়মূল্যও কম নয়।
সংযুক্তি থেকে যে কেনো আন্দোলন নতুন গতি পায়। সরকার তা ভালোই বুঝেছে। বন্ধে সমাধান নেই, সমাধান উন্মুক্ততায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে শেষ করি, “যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।”