ক্যান্সার সম্পর্কে বলতে হয় সে এক অসময়ের মেহমান। হঠাৎ করে আমাদের শরীরে চলে আসে এবং তাকে তাড়ানো খুবই কঠিন। কিছু দিনের জন্য হলেও সে থাকবে।
Published : 11 Feb 2024, 07:03 PM
আমরা ছোটবেলায় কবি সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া গান শুনেছি।
“অসময়ে মেহমান ঘরে
ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন ঠিক আছে ঠিক আছে।”
ক্যান্সার সম্পর্কে বলতে হয় সে এক অসময়ের মেহমান। হঠাৎ করে আমাদের শরীরে চলে আসে এবং তাকে তাড়ানো খুবই কঠিন। কিছু দিনের জন্য হলেও সে থাকবে। যুদ্ধ শুরু হয় শরীর ও ক্যান্সারের সঙ্গে।
ক্যান্সার শরীরের সব জীবন্ত কোষেই হতে পারে। ধরনও বিভিন্ন, কোনটা খুব খারাপ আবার কোনটা তুলনামূলকভাবে অতটা খারাপ নয়। চিকিৎসা বিভিন্ন ধরনের, কেমোথেরাপি, সার্জারি, রেডিওথেরাপি, ইমিওনোথেরাপি, টার্গেটথেরাপি, ইন্টারপেরিটোনিয়াল কেমোথেরাপি ইত্যাদি।
ক্যান্সারের ধরনের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতির পরিকল্পনা করা হয়। কতটুকু পরিমাণ ওষুধ দিবেন, কতদিন দিবেন, কীভাবে দিবেন সবকিছুই চিকিৎসা শুরুর পূর্বের নির্ধারণ করে নিতে হয়, যা একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার করেন।
প্রত্যেক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির খারাপ প্রতিক্রিয়া আছে যাকে আমরা side effect বলি। অনেক সময় side effect গুলো মারাত্মক হতে পারে এবং যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। চিকিৎসা শুরুর আগে এগুলো ভালো করে বুঝে নিতে হবে যাতে সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভুলের কারণে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে বা বিলম্বিত হয়। আমাদের সবাইকে সেই জায়গাগুলো বুঝতে হবে যাতে আমরা দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা পেতে পারি। আমরা জানি চিকিৎসা যত বিলম্বিত হবে ততই prognosis খারাপ হবে। তাই চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো জায়গা জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে।
Diagnosis: সঠিক রোগটা নির্ধারণ করা । বায়োপসি করা অর্থাৎ আক্রান্ত অংশ থেকে সামান্য একটি অংশ নিয়ে পরীক্ষা করা। এখানে ভুল হলে সবই বিফল হবে।
Treatment Plan: সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করা। কোন ধরনের ওষুধ, তার পরিমাণ ও কতদিন চলবে ইত্যাদি।
Follow up: প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগী ক্যান্সার মুক্ত হলে তিন থেকে ছয় মাস পর পর পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার আবার শরীরকে আক্রান্ত করে। তখন দ্বিতীয়বারের মতো চিকিৎসা নিতে হয়।
ক্যান্সার যদি আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারি তাহলে সম্পূর্ণ সুস্থতা বা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সব ক্যান্সারের উপস্থিতি একরকম নয়। ভিন্ন ক্যান্সারের ভিন্ন রকম উপস্থিতি। এই জন্যই কিছু ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে ধরা পড়ে, আবার কিছু ক্যান্সার ধরা পড়ে না, যেমন:
জরায়ুর মুখের ক্যান্সার (Cervical Cancer) সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। রোগীর প্রথম দিকের সমস্যাগুলো হলো সহবাসের সময় সামান্য রক্তপাত হওয়া এবং অতিরিক্ত শ্রাব যাওয়া যা কখনো দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে। কিন্তু Ovarian Cancer (ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার) সহজে বুঝতে পারা যায় না। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর তেমন কোন সমস্যা থাকে না। হয়তো তলপেটে সামান্য ব্যথা যা মহিলাদের বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তাই বলা হয় ওভারিয়ান ক্যান্সার শব্দ করে না বরং ফিসফিস করে। আর এজন্যই বিলম্বে ধরা পড়ে এবং মৃত্যুর হারও বেশি। কোন উপযুক্ত পরীক্ষাও নেই এবং স্ক্রিনিংগুলো সঠিক না হতে পারে, যেমন আলট্রাসনোগ্রাম (Ultrasonogram) দ্বারা কখনো কখনো সঠিকভাবে ক্যান্সারের উপস্থিতি ধরা সম্ভব হয় না।
CA-125: সাধারণত এই টিউমার মার্কারটি ওভারিয়ান ক্যান্সারে বেড়ে যায়, কিন্তু অন্য কারণেও এটা বেড়ে যেতে পারে, যেমন তলপেটে ইনফেকশন হলে বা অ্যান্ড্রোমেট্রিওসিস (endometriosis) হলে, এমনকি গর্ভবতী মায়েরও এটি বেড়ে যায়। তাই এই পরীক্ষাটিকেও আমরা সুনির্দিস্ট (specific) বলতে পারি না।
আমি নিজেই একজন ওভারিয়ান ক্যান্সার ফাইটার। তাই বাস্তবতার আলোকে সংক্ষেপে কিছু লিখছি:
ওভারিয়ান ক্যান্সারের কারণ:
জেনেটিক (Genetic): পরিবারের অন্য কোন সদস্যের ক্যান্সার থাকলে পরিবারের রক্ত সম্পর্কের অনেকের Gene-এ ক্যান্সারের Gene থাকতে পারে।
স্ট্রেস (Stress): বলা যায় স্ট্রেসফুল (stressful) জীবন দূষিত জীবন। Stress মানুষের শরীরে টক্সিন (Toxin) তৈরি করে যা শরীরের ভেতরের পরিবেশের ওপর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া করে।
খাদ্যাভ্যাস: আমাদের খাদ্যে অনেক ভেজাল থাকে যা শরীরের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
পরিবেশ: দূষিত পরিবেশে তুলনামূকভাবে অক্সিজেন কম থাকে।
উল্লেখিত সব কারণগুলো আমাদের শরীরে একটা এসিডিক টক্সিক পরিবেশ তৈরি করে যা ক্যান্সার সেলের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার সহায়ক।
এডভান্স স্টেজে ওভারিয়ান ক্যান্সার ধরা পড়ে তাই এর প্রোগনোসিস (prognosis) খারাপ। সাধারণত বলা যায়, তিন ভাগের এক ভাগ চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ ভালো হয়, তিন ভাগের একভাগ অসুখে ভুগতে থাকে, এবং তিন ভাগের একভাগ সাধারণত তাড়াতাড়ি মৃত্যুবরণ করে। উপযুক্ত চিকিৎসা, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা, সচেতনতা ইত্যাদি রোগীনিকে দীর্ঘায়ু করতে পারে।
শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতা, যেমন ডায়াবেটিস, হৃদপিণ্ডের সমস্যা, বেশি ব্লাড প্রেসার থাকা বা কিডনির অসুখ ইত্যাদি সুস্থতায় ব্যাঘাত ঘটায়। এই ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বায়োপসির মাধ্যমে ক্যান্সারের ধরন বের করা হয়। পেট স্ক্যান (PET Scan)-এর মাধ্যমে শরীরের কোথায় কোথায় ক্যান্সার ছড়িয়ে আছে তা বের করা হয়। কিছু কিছু পরীক্ষা যেমন Estrogen Receptors, Progesterone receptor, BRCA1, BRCA2, PDL1, HRD করতে হয়। এই পরীক্ষাগুলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এডভান্স স্টেজে ধরা পড়ে তাই প্রথমেই অপারেশনে না গিয়ে কয়েকটা কেমোথেরাপি নিতে হয় যা ক্যান্সারকে সংকুচিত করে এবং অপারেশনের সময় ক্যান্সার সেল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে না। এটাকে বলে Neo-Adjuvant কেমোথেরাপি। এরপর পরের ধাপ অপারেশন যত সূক্ষ্ম হবে অর্থাৎ ক্যান্সার সেল যত বেশি বের করা যাবে পরবর্তীতে কেমোথেরাপি তত ভালো কাজ করতে পারবে। রোগীর সুস্থতা তত বেশি হবে। অপারেশনের পরে আরও কয়েকটি কেমোথেরাপি নিতে হয়, যাকে বলা হয় Adjuvant Chemotherapy. এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিকে বলা হয় ফাস্ট লাইন ট্রিটমেন্ট। PET Scan-এর মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয় রোগী সম্পূর্ণ ক্যান্সার মুক্ত কিনা ।
এরপর রোগীনিকে এক থেকে দুই বছর Maintenance Therapy দিতে হয়, যাকে বলা হয় টার্গেট থেরাপি। সব পদ্ধতিগুলো ক্যান্সার চিকিৎসক নির্ধারণ করেন। প্রথম দুই বছর খুব সাবধানে থাকতে হয় কারণ আবার শরীরে ক্যান্সার ফিরে আসতে পারে। সময়মতো ফলোআপ এবং শরীরের শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কারণে ক্যান্সার ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা থেকেও রোগী মৃত্যূবরণ করেন।
প্রথম পাঁচ বছর যথাযথ নিয়মমাফিক ফলোআপ করার পর যদি রোগী ভালো থাকেন তাহলে আমরা বলতে পারি তিনি সুস্থ আছেন। কিন্তু সমস্ত জীবন ফলোআপ করতে হয়। অনেক সময় ক্যান্সার আবার ফিরে আসে, তাকে বলা হয় Recurrence. উপযুক্ত চিকিৎসা রোগীনিকে বাঁচিয়ে রাখে।
মনের সাহস, চিকিৎসা করার মতো পরিবেশ, সচ্ছলতা, পরিবারের সকলের সহযোগিতা এবং ভালোবাসা একজন রোগীনিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
লেখক: অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)