আমি একজন কেয়ারগিভার এবং একজন ক্যানসার সারভাইভার হয়ে এই আবেদন সবার কাছে করতে চাই। আসুন আমরা এমন একটি কমিউনিটি তৈরি করি, যেখানে এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবার সঠিক দিকনির্দেশনা পাবেন এবং মানসিকভাবে সুস্থতা বোধ করবেন।
Published : 06 Jun 2024, 05:30 PM
২০০২ সালে বাবাকে হারালাম। এর কয়েক মাস পরই চাকরির জন্য চট্টগ্রামে চলে গেলাম আমি। আম্মু আর বড়ো ভাইয়া ঢাকায়। এভাবেই চলছিল একটা বছর। তারপর ২০০৪-এ আম্মু হঠাৎ তার তলপেটে হাত দিয়ে কোনো একটা চাকার মতো অনুভব করেন, দেরি না করে টেস্ট করা হয়। দেখা গেল বিশাল আকারের একটি টিউমার আম্মুর জরায়ুর কাছাকাছি বাসা বেঁধে আছে। শিকদার মেডিকেলে অপারেশন শেষ হওয়ার পর ডাক্তার বের হয়ে আমাকে দেখালেন তিনি আম্মুর জরায়ুটি সম্পূর্ণ ফেলে দিয়েছেন, সাথে একটি ওভারিও। তখন তিনি আমাকে দেখালেন আম্মুর জরায়ু আর ওভারিতে সাদা সাদা কিছুর উপস্থিতি। বায়োপসি করার পর জানা যাবে, তিনি জানাতে পারবেন।
যথাসময়ে আমাকে জানানো হলো সেখানে ক্যানসারের উপস্থিতি আছে এবং তখন একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হলো আম্মুকে। তিনি দেখলেন ও জানালেন ক্যানসারটা যে অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেখানে র্যাডিয়েশন দিলেই হবে। ঢাকা মেডিকেলে শুরু হলো আম্মুর র্যাডিয়েশন। ওই সময়টা আম্মু নিজেই সবকিছু করতেন। আমাকে বা ভাইয়াকে খুব একটা কিছু করতে হয়নি।
এর মধ্যে আমিও চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি। এখানে একটা কথা বলা খুবই জরুরি বোধ করছি তা হলো, আম্মুর যখন র্যাডিয়েশন শেষ হলো এবং ক্যানসার বিশেষজ্ঞের কাছে পুনরায় যাওয়া হলো, তখন তিনি আমাদের পরিষ্কারভাবে বলেননি আম্মুকে কী কী ধরনের ফলোআপে থাকতে হবে। রিপোর্ট দেখে শুধু বলেছিলেন, তিনি ভালো হয়ে গেছেন আর কোনো সমস্যা হবে না। তখন আমি বা আমার বড় ভাইয়া ক্যানসার বিষয়টা নিয়ে তেমন কিছুই জানতাম না বলে আমরা ভেবেছিলাম আম্মু সুস্থ হয়ে গেছেন।
জীবন আবার নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় চলতে শুরু করল। এর চার বছর পর, মানে ২০০৮-এর জানুয়ারির শেষের দিকে আম্মু বলা শুরু করলেন তার বাথরুমে সমস্যা হচ্ছে। খাবারেও অরুচি। সব নিয়ে তিনি কেমন কেমন জানি অনুভব করছেন। আমি চাকরিতে থাকি, বললাম, চল ডাক্তার দেখাই। ভাইয়া তখন পিএইচডির জন্য লন্ডনে। আম্মু আজকে যাব, কালকে যাব করে করে নিজেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে বাথরুম পরিষ্কার হওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। এভাবে দু-তিন মাস চলে গেল।
একদিন হঠাৎ রাতের বেলা আমার মা চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করেন। তার পেটে তীব্র ব্যথা। আমি পুরো থতমত খেয়ে গেলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পেটের সমস্যার জন্য গ্যাস্ট্রোলজির কোনো ডাক্তার দেখাতে হবে। একজনকে দেখালাম। তিনি বললেন, কলনোস্কোপি করে দেখতে হবে। ভয়ংকর কষ্ট দিয়ে তিনি আম্মুর টেস্টটা করালেন এবং আমাকে জানালেন আম্মুর পায়খানার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বেশি দূর দেখতে পারেননি, আম্মুর ক্যানসারটা ছড়িয়ে গেছে।
আমি পাগলপ্রায় হয়ে নামকরা একজন ডাক্তারের কাছে আবার টেস্টটা করালাম। তিনি বায়োপসি করতে দিলেন। তিনিও একই কথা জানালেন। বায়োপসি করার পর ক্যানসারটা কোন স্টেজে আছে, জানাতে পারবেন। তিন দিন পর জানলাম স্টেজ ৪-এ, আম্মুর ‘রেকটাম ক্যানসার’। এরপর টানা আট ঘণ্টার একটা অপারেশন হলো, দেবদূত একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞকে পেয়েছিলাম (স্যার ২০১২-এ মৃত্যুবরণ করেন), ছয়টা কেমোথেরাপি হয় আম্মুর। আসলে আমি যদি বিস্তারিত লিখি, অনেক অনেক কথা লিখতে হবে, আম্মুর তিন মাস কলোস্টমি ব্যাগ লাগানো ছিল। সে কী কষ্ট আমার মায়ের! প্রথম দিন ব্যাগটা যখন আমি পরিষ্কার করি, আম্মুকে দেখলাম খুব কেঁদেছিলেন।
ওই সময়টা আমার জীবনে একটা অদ্ভুত সময় পার করেছি। একদিকে মায়ের এত বড়ো একটা অসুখ, অপর দিকে করপোরেট জব। রিপোর্টিং বসের ব্যবহার এবং বাদবাকি সব এক হাতে সামলে আমার মন-মগজে আর কিছু ঢুকত না। আম্মুর প্রথম অপারেশনের পর ২১ দিন হাসপাতালে ছিলেন। ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল সেলাইয়ের জায়গায়। সে কী তীব্র কষ্ট আমার মায়ের। ব্যাগ সরিয়ে ফেলার অপারেশনের পর ১২ দিন ছিলেন হাসপাতালে। সে কী নিদারুণ যন্ত্রণা! নাক দিয়ে নল ঢোকানো ছিল সাত দিন। আমার মা ছটফট করেছেন! সবকিছু সামনে থেকে দেখে আমি নিজেকে নিজে সাহস দিতাম, না, মাকে সুস্থ করে বাসায় নিতে হবেই। ভাইয়া পিএইচডি করছেন, ওকে খুব একটা অবস্থার কথা জানাতাম না, ও শেষ করুক। আমি আমার মাকে নিয়ে একটা দীর্ঘ যাত্রা সেবার শেষ করে বাসায় ফিরি।
ভেবেছিলাম এবার হয়তো মাকে নিয়ে একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারব। কিন্তু ওপরওয়ালার ইচ্ছা অন্য রকম ছিল। আম্মুকে বাসায় আনার চার মাস পর আবিষ্কার করি আমিও কর্কটকে নিয়ে বাস করছি। বলে রাখি, আম্মুর অবস্থার কারণে তখন নিজেকে বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে ফেলি, যাতে মা আমার কিছুটা শান্তি পান। নিজের শরীরে কর্কটের উপস্থিতিতে আমিসহ আমার চারপাশের সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। কী থেকে কী হলো! রিপোর্টে সবকিছু ফাইনাল হওয়ার ১০ দিনের মাথায় আমার প্রথম কেমোথেরাপি শুরু হয়। টানা ৩৬ ঘণ্টা কেমোথেরাপির পর আমি নিজেকে কোথাও খুঁজে পাইনি টানা ৫ দিন। এভাবে ছয়টা কেমোথেরাপি, একটা সার্জারি আর র্যাডিয়েশন শেষ করে নিজেকে আবার শক্তভাবে দাঁড় করিয়েছি। দীর্ঘ নয় মাসের জার্নিতে কত কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। মৃত্যু খুব কাছ থেকে এসে ফিরে গেছে কয়েকবার।
প্রথম কেমোথেরাপি নেওয়ার ঠিক ২১ দিনের দিন মাথার চুলগুলো যখন গোসলের সময় সব পড়ে গেল, সেদিন কলটা ছেড়ে কেঁদেছি খুব। অপারেশনের পর বুকে হাত দিয়ে জায়গাটা যখন খালি অনুভব করেছি, একটুও মনখারাপ করিনি, বরং সেটাই আমার শক্তি হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আস্তে করে যখন সব শান্ত হয়ে নিজেকে সংসারে থিতু করলাম, ঠিক তার কয়েক বছর পর পাশে থাকা মানব বললেন তিনি আর সম্পর্কটা টানতে চান না।
শুরু করলাম অন্য যাত্রা, অনেক অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ঝড়ঝাপটা সামাল দিয়ে চেষ্টা করেছি আম্মুকে যেন ভালো রাখতে পারি, নিজে যেন সুস্থ ও সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারি। বিধাতা হতাশ করেননি। এখনো সে চেষ্টা চলছে। আমার আম্মু এখনো আমার সাথে আছেন। অথচ অনেক ডাক্তার তার রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না, বড়জোর তিন-ছয় মাস! শুধু দেবতুল্য ডাক্তার, যিনি আমার মায়ের এবং পরবর্তী সময়ে আমার চিকিৎসা করেছেন, তিনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘মা, যদি ওপরওয়ালা ওনার হায়াত রাখেন আর আমার চিকিৎসা সঠিক হয়, তাহলে তোমার আম্মুর কিছু হবে না।’ স্যারকে জীবনের সব ক্ষেত্রে নীরবে স্মরণ করে যাই।
আমার কেয়ারগিভার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় আমি এখানে বলতে চাই। একজন ক্যানসার কেয়ারগিভারের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাও খুবই দরকার। প্রতিমুহূর্ত তাকেও এত চাপে থাকতে হয়, সে-ও যে কারও কাছে গিয়ে কিছু বলবে বা চাপ কমাবে, এমন একটা জায়গা বা কমিউনিটি তৈরি করা এখনকার সময়ে খুবই জরুরি। সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ার জন্যও অনেক ভুল হয়ে যায়। এমনকি আমাদের প্রিয়জনকেও আমরা হারিয়ে ফেলি। তাই প্রতিটি হাসপাতালে ক্যানসার কমিউনিটি তৈরি করা বা রাখা এখন একটি দাবি হওয়া উচিত। অনেক অনেক প্রশ্ন থাকে ভুক্তভোগীদের— সময় নিয়ে সেসব প্রশ্নের উত্তর জানানো, তাদের সঠিক গাইডলাইন দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা ক্যানসার কমিউনিটি থেকেই আসতে পারে। একজন কেয়ারগিভারের কাউন্সেলিংও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাই আমি একজন কেয়ারগিভার এবং একজন ক্যানসার সারভাইভার হয়ে এই আবেদন সবার কাছে করতে চাই। আসুন আমরা এমন একটি কমিউনিটি তৈরি করি, যেখানে এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবার সঠিক দিকনির্দেশনা পাবেন এবং মানসিকভাবে সুস্থতা বোধ করবেন। সামাজিক দায়িত্ব থেকে আমাদের সবার যার যার জায়গা থেকে এখনই এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন আবশ্যক।
লেখক: ক্যানসার সারভাইভার ও কেয়ারগিভার
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)