রণজিৎ গুহ কিংবা গুহদের বাংলাদেশ

গুহ বারবার অধিপতি ইতিহাসে দাবিয়ে রাখা স্তূপ থেকে নিম্নবর্গের জংধরা-মরচে পড়া-ধূসর-মলিনসব ঐতিহাসিক আখ্যান ইতিহাসের বিবরণে হাজির করবার কথা বলেছেন।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 2 May 2023, 11:50 AM
Updated : 2 May 2023, 11:50 AM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলে থাকাকালীন বরাদ্দ পাওয়া কক্ষটির নাম তিনবার পাল্টেছিলাম। সুবাস বিশ্বাস ও আমি একবার নাম দেই ‘গোলাঘর’। তখন বাংলার ধানবৈচিত্র্য আর বীজরাজনীতি নিয়ে কাজ করছিলাম। গ্রাম ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যাওয়া ধানের বিবরণ আর গ্রাম-বাংলার বীজভাণ্ড হারানোর নিদারুণ কাহিনি সংগ্রহ করি তখন। উজ্জ্বল হলুদের ভেতর গাঢ় কালো রঙে গোলাঘরের জানালা, দরজা, দেয়াল ভরে ফেলেছিলাম হারিয়ে যাওয়া ধানের নামে। ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে তখন। কেন ‘গুহদের’ বলছি, তা পরে ব্যাখা করছি।

গোলাঘরে রাতে আড্ডা হতো। রাজনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্পকলা। নৃবিজ্ঞান বিভাগের বন্ধুরা তাদের নানা কাগজপত্র নিয়ে আসত। আমরা অনেকে মিলে সেসব পড়তাম, বোঝার চেষ্টা করতাম। ১৯৯৮ সনের যুগান্তকারী ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের আগের কী পরের বছর বুলবুল, রাসেল কিংবা পল্লব ভাই এক রাতে একটা ফটোকপি লেখা নিয়ে আসেন। সামনে তাদের কোনো পরীক্ষা ছিল। রণজিৎ গুহর লেখা ‘অন সাম আসপেক্টস অব দ্য হিস্টোরিওগ্রাফি অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’। ফটোকপি থেকে ফটোকপি হওয়ায় লেখাটির টাটকা ভাবটি হারিয়েছিল। কবে কোথায় প্রকাশিত হয়েছে কিছুই তখন জানতে পারিনি। লেখাটি পড়তে আমার সপ্তাহখানেক লেগেছিল। বিদ্যায়তনিক কাঠামোটি বহু সময় পর। প্রথম পাঠেই মনে হয়েছিল, এ যেন আমারই ভাষ্য, এই কাঠামোর ভেতর দিয়ে আমি তাকাতে শিখছি। লেখাটি রণজিৎ গুহ এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের যৌথ সম্পাদনায় ‘সিলেক্টেড সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ শিরোনামের বইতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮৮ সনে প্রকাশিত হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের পাঠচক্রে তখন গ্রামসি পড়েছি মাহবুব ও জাঈদ ভাইদের কাছে। ‘সাবঅলটার্ন’ প্রত্যয়টি তাই পরিচিত ছিল কিছুটা। তো, এক দুপুরে মিশু, সায়েমা কিংবা সায়দিয়া আপার কাছে ‘ইমান ও নিশান’ সবুজ-হলুদ প্রচ্ছদের বইটি দেখতে পাই। এক বিভ্রম ছড়িয়ে বিকেলের বাসে বইটি তাদের সঙ্গে চলে যায়। সবুজ-হলুদের এক নিদারুণ টানে কাটে রাত। পরদিন দুপুরের বাসে যাই শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে। কোনো এক কারণে উলুখড় (বইয়ের দোকানটি এখন নেই!) সেদিন বন্ধ ছিল আর তক্ষশীলায় বইটি ছিল না। গৌতম ভদ্রের ‘ইমান ও নিশান’ বইয়ের ‘পাগলাই ধূম’ লেখাটি আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘পাগলপন্থী বিদ্রোহ’ নিয়ে এভাবেও যে আলাপের বিস্তার সম্ভব তা আগে আমার জানা ছিল না। যদিও পরে নিজে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই আন্দোলনের উত্তরাধিকারদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ‘পাগলাই ধুমে’র কিছু অমিল পেয়েছি, পরে অন্য কোনো লেখায় সেসব বিস্তারিত বলা যাবে।

ততদিনে জোগাড় করেছি রণজিৎ গুহের ‘ইলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পিজান্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ বইটিসহ ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজের’ বেশ কিছু লেখালেখি। শাহিদ আমিনের ‘সুগারকেন অ্যান্ড সুগার ইন গোরখপুর’ কিংবা গৌতম ভদ্রের ‘মুঘলযুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ, প্রশান্ত ত্রিপুরা, মানস চৌধুরী, সাঈদ ফেরদৌস এসব লেখা সংগ্রহ এবং পাঠপ্রক্রিয়ায় বহু সহযোগিতা করেছেন। কোনো এক দুপুরে ক্যাফেটারিয়ার এক আড্ডা জটলায় মননদার হাতে গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বইটি দেখি। এই বইটিও কেমন যেন ‘ইমান ও নিশানে’র মতো হলুদ-সবুজের মলাট। যদিও এর প্রচ্ছদ করেছেন দেবাশিস সাহা আর ‘ইমান ও নিশানে’র করেছেন বিমল মজুমদার।

কোনো বইয়ের উৎসর্গপত্র পাঠ আমার এক ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা। লেখক যাকে উৎসর্গ করেন তার সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক এবং পারস্পরিকতা থেকে বহু কিছু বোঝার থাকে। রণজিৎ গুহ তার অবিস্মরণীয় বিদ্যায়তনিক কাজ ‘ইলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পিজান্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া (১৯৯৯)’ বইটি উৎসর্গ করেন ম্যাচিল্ড গুহকে। জার্মানিতে জন্ম হলেও ম্যাচিল্ড বড় হন অস্ট্রিয়াতে এবং সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল কাজে যুক্ত হওয়ার সময় তার পরিচয় ঘটে রণজিৎ গুহর সঙ্গে। এ সময়ে তার দেখবার দুনিয়া পাল্টে যায় এবং তিনি রণজিৎ গুহকে বিয়ে করেন। ‘দান্যুব, গ্যাঞ্জেস অ্যান্ড আদার লাইফ স্ট্রিম’ নামে তার বইটি বেশ গুরুত্ববহ।  গৌতম ভদ্র ‘ইমান ও নিশান’ বইটি ভদ্র উৎসর্গ করেছেন হিতেশরঞ্জন সান্যালকে। হিতেশরঞ্জন একজন সামাজিক ইতিহাসবিদ। ‘বাংলার মন্দির’, ‘বাংলা কীর্তনের ইতিহাস’ কিংবা ‘দ্য সোশাল মবিলিটি ইন বেঙ্গলে’র মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ বইটির উৎসর্গপত্রে অরূপ মল্লিক ও দীপেশ চক্রবর্ত্তীকে তাঁর লেখক-জীবনের আদি কমরেড হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ইতিহাসবিদ বিজ্ঞানী দীপেশ চক্রবর্তী একটাসময় নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করলেও বর্তমানে জলবায়ু-রাজনীতি নিয়ে বেশি তৎপর। তো ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ পাঠপ্রক্রিয়ায় কিছু নামের সঙ্গে আমি অভ্যস্থ হয়ে ওঠি। গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ডেভিড হার্ডিম্যান, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, ডেভিড আর্নল্ড, শাহিদ আমিন, বীণা দাস কিংবা দীপেশ চক্রবর্তী। এরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে রণজিৎ গুহর অনুসারী এবং সকলে মিলে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচিন্তাকে’ কাঠামোগতভাবে বিকশিত করেছেন। ইতিহাসের উচ্চবর্গীয় অধিপতি কাঠামোকে প্রশ্ন করে দাবিয়ে রাখা নিম্নবর্গের ইতিহাসকে পাঠ করার পদ্ধতিগত বিদ্যায়তনিক আহবানটি প্রথম জানিয়েছিলেন রণজিৎ গুহ। কিন্তু বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আর ব্যক্তি হিসেবে থাকেনি, সংঘ ও সমষ্টিতে ছড়িয়েছে। চলতি আলাপখানির শুরুতে রণজিৎ গুহকে ‘গুহদের’ উল্লেখ করবার কারণ এটিই, নিম্নবর্গের ইতিহাসের পঠনপাঠন ব্যক্তি নয় বরং সমষ্টির যৌথতায় বিকশিত হয়েছে। যদি সবারই নিজস্ব স্বর ও ভঙ্গিমা গুহতে বিলীন না হয়েই বিকশিত হয়েছে। সম্প্রতি অস্ট্রিয়াতে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন রণজিৎ গুহ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে চলতি আলাপখানি রণজিৎ গুহ এবং গুহদের চিন্তা ও কাজের ময়দানকে আবারো শ্রদ্ধা জানাই।

২.

১৯৮২ সনে ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮৩ সনে এ বিষয়ে সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে রণজিৎ গুহ বাংলায় দুটি বক্তৃতা করেন, যা পরে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। রণজিৎ গুহই প্রথম সাবঅলটার্নের বাংলা হিসেবে ‘নিম্নবর্গ’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। আর এ নিয়ে দীর্ঘসময় জুড়ে বহু তর্ক ও বাহাস হয়েছে, এখনো জারি আছে। ইংরেজিতে সাবঅলটার্ন প্রত্যয়টি সাধারণভাবে ‘সাবর্ডিনেট’ বা অধস্তনের সমার্থক হলেও গ্রামসির ‘দ্য প্রিজন নোটবুকসে’ মার্কসীয় দর্শন ‘প্রাক্সিস দর্শন’ এবং ‘সাবঅলটার্ন’ শব্দটি ‘প্রলেতারিয়েতে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পুঁজিবাদী কাঠামোয় শ্রমিকশ্রেণি বা শ্রেণিবিভক্ত সমাজের নানাস্তরে বিদ্যমান অধিকতর প্রান্তিক শ্রেণির একক পরিচয় হিসেবে ‘সাবঅলটার্ন’ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হয়েছে। রণজিৎ গুহরা গ্রামসির ‘সাবঅলটার্ন’ প্রত্যয়ের ইঙ্গিত অনুসরণ করেই ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাখানিকে সমাজ ও ইতিহাস পঠনপাঠনে ব্যবহার শুরু করেন।

গৌতম ভদ্রের ‘মুঘলযুগে কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’ বইটি বাদ দিলে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের প্রথমদিককার প্রায় সব লেখালেখি ছিল ইংরেজিতে এবং মূলত সেসব প্রকাশনা খুব একটা সহজলভ্যও ছিল না। এছাড়া ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ নিয়ে বহু তর্কও শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিকে। এটি খুব বেশি একাডেমিক ডিসকোর্স, পাবলিক আলাপচারিতা নয় কিংবা এইসব সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এলিট বুদ্ধিজীবীদের কাজ কিংবা মার্কসীয় সমাজবিশ্লেষণের সঙ্গে এই তত্ত্বকাঠামো বিরোধ তৈরি করে। কণা, এ্যানী, ইউনা, জাকির, মান্নু, ফারুক, ইফতি, লুনা, দীনা, শশাঙ্ক, সঞ্জীব, শামীম, পরমেশ্বর, ইলিরা, সিডনী, সুকর্ণো, অঞ্জন, মণিশংকর, হ্যাপি, শিফা, বিশ্ব, দুপুর, পরাগ, তপু, ভাস্কর, মনা, মুনা, জুয়েল কিংবা এই তালিকা দীর্ঘতর হতে থাকবে আমরা সুপারিতলা কী বটতলায় নিম্নবর্গ নিয়ে বহু তর্কে মেতেছি। এসব বাহাসের বর্তমান প্রকৃতি আমার জানা নেই। বহু লেখার বাংলা অনুবাদ হওয়ায় এবং বেশকিছু বই বাংলায় প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশে কেবল বিদ্যায়তনিক স্তরেই নয়, পাবলিক পরিসরেও নিম্নবর্গের ইতিহাস স্বল্প পরিসরের হলেও এক গুরুত্ববহ আলাপের বিষয়।

নিম্নবর্গের ইতিহাস চিন্তাকাঠামো বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজ গবেষণা কী বিশ্লেষণে বহুজনের কাজে প্রতিনিয়ত ছাপ ফেলছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের অধিপতি ইতিহাসে আগে নিম্নবর্গের কোনো ভাষ্য ও বিবরণ জায়গাই পায়নি। যদিও খান আতাউর রহমানের বিখ্যাত সেই গান বহু আগেই জানিয়েছে, ‘...হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে, তোমাদের কথা কেউ কবে না’। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান ও অংশগ্রহণ দীর্ঘসময় আমরা আলোচনায় আনিনি। নিম্নবর্গের ইতিহাস কাঠামোর ভেতর দিয়ে প্রশ্নটি বহুবার তুলেছি। লিখেছি, ‘মুক্তিযুদ্ধের অদৃশ্য রক্তদানা : অধিপতি ইতিহাসে আদিবাসী প্রান্তিকতা’ এবং ‘উত্তরবঙ্গের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’। মুক্তিযুদ্ধকে পঠনপাঠনের অধিপতি ও ঔপনিবেশিক কায়দা বদলাচ্ছে। আমরা এখন কৃষক, নারী, আদিবাসী, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধশিশুসহ নিম্নবর্গের যুদ্ধদিনের ভাষ্য ও বিবরণ বহুজনের কাজে নানাভাবে হাজির হতে দেখছি। রণজিৎ গুহরা প্রশ্নটি না করলে কিংবা একটা বুদ্ধিতাত্ত্বিক তৎপরতা জারি না থাকলে হয়তোবা ইতিহাসকে সর্বজনের কাতার ও কিনার থেকে দেখবার তাগিদ তৈরি হতো অন্য কোনো স্রোতোধারায়। 

৩.

রণজিৎ গুহ অধিপতি কাঠামোর রচিত ইতিহাসপাঠকে সংকট হিসেবে দেখেছেন এবং বলেছেন সেসব ইতিহাস অধিকাংশই ঔপনিবেশিক কাঠামোতে রচিত। গুহর ভাষ্য, ‘...আমরা যে ইতিহাস লিখি, পড়ি ও পড়াই তার উৎপত্তি ইংরেজের ক্ষমতালিপ্সায়। পলাশীর যুদ্ধের আগেও আমাদের ইতিহাস লেখা হতো কিন্তু সে ইতিহাসের ধাঁচ ছিল পৌরাণিক।’ গুহ নানাভাবে দেখিয়েছেন অধিপতি ইতিহাসগ্রন্থনের কায়দা কেবল ক্ষমতার ইতিহাস নথিভুক্ত করে আর বিজয়ীর বিবরণ মেলে ধরে। নিম্নবর্গকে ঐতিহাসিক গবেষণা ও বক্তব্যের বিষয় বলে সচেতনভাবে স্বীকার করার কথা বলেছের গুহ। গুহ লিখেছেন, ‘...শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিব জনতা ইত্যাদি গণ্য তো বটেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সমাজে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটা যাদের জীবনে খুবই প্রকট অথচ যারা আমাদের ইতিহাসচিন্তায় এখনও প্রায় অনুপস্থিত সেই আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও নারীদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ করে ভাবতেও লিখতে হবে।’

ইতিহাসরচনার প্রতিষ্ঠিত প্রকল্পটি সর্বদাই নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চবর্গ এবং তার ক্ষমতার বিন্যাস। এই কাঠামো চুরমার করেই ইতিহাসকে নিম্নবর্গের ময়দান, ভাষ্য ও নথিসমেত পাঠ করা জরুরি। ১৯১৮ সনে ভারতের আমেদাবাদের সূতাকলের ধর্মঘটের ইতিহাস গ্রন্থনের প্রসঙ্গ টেনে গুহ জানান, ...এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা কেবল মহাত্মা গান্ধী, শংকরলাল ব্যাংকার ও অনসূয়া সারাভাইয়ের জীবনীর অধ্যায় মাত্র নয়, ধর্মঘটীদের শ্রেণীচেতনা ইতিহাসের অন্যতম উপাদান। হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলন, তেভাগা, টংকপ্রথা বিরোধী আন্দোলন কিংবা মধুপুর ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে গুহদের চিন্তাকাঠামোর স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। কেবল মূলধারা নয়, বরং প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসগ্রন্থনেও দেখেছি ‘নাচোলের রানীমা ইলা মিত্রদের’ কেন্দ্রে রেখেই তেভাগা আন্দোলনের অধিকাংশ ইতিহাস রচিত হয়েছে। সেখানে সাঁওতাল, ক্ষত্রিয় বর্মণ, ওঁরাও, কোল, মুন্ডা, জোলা এবং বাঙালি নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলিম জনগণের বিষয়টি কেবলমাত্র ‘অংশগ্রহণ’ হিসেবে দেখা হয়েছে। নিম্নবর্গের জাগরণ, শ্রেণীকৌশল কিংবা নেতৃত্ব হিসেবে নয়।

৪.

কৃষক বিদ্রোহের জনচরিত্র ব্যাখা করতে গিয়ে কোল ও সাঁওতাল বিদ্রোহের উদাহরণ টেনে গুহ দেখান, আদিবাসীদের একসঙ্গে সংগ্রহবৃত্তি এবং খাদ্যগ্রহণ কিংবা সামাজিক পরবের সামাজিক যৌথতার সংস্কৃতি জনবিদ্রোহের ক্ষেত্রে তাদের একাত্ম হতে সহযোগিতা করে। বাংলাদেশে চাশ্রমিকদের আন্দোলন কিংবা ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলনেও দেখা যায় স্থানীয় বাঙালিদের চাইতে আদিবাসীরা দ্রুততম সময়ে গ্রামে গ্রামে নিজেদের ঐক্য গড়ে তোলেন। জনবিদ্রোহের ক্ষেত্রে যোগাযোগ এবং তথ্যের বিস্তারকে খুব গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখা করেছেন গুহ। বিশেষ করে নিম্নবর্গের তথ্য, তথ্য স্থানান্তর, যোগাযোগের নানা মাধ্যম এবং পরিসর কিংবা ইশারা-প্রতীক-সংকেত ও চিহ্নর নিজস্ব কারিগরি সবকিছুই নিজেদের ভেতর তথ্যের আদানপ্রদানকে সমুন্নত রাখে। এমনকি ‘গুজব’ও এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

টংক আন্দোলন নিয়ে নেত্রকোণার দূর্গাপুর-কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী হাজং গ্রামগুলোতে কাজ করতে গিয়ে বিষয়টি একভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। তৎকালীন ইপিআর বাহিনী যখন কুমুদিনী হাজংকে জোর করে নিয়ে যেতে চায় তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে কুমুদিনীকে খুন করা হয়েছে।  রাশিমনি হাজংসহ অন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন এবং কুমুদিনীকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন। কিন্তু প্রতীক, সংকেত, চিহ্ন, গুজব কিংবা যোগাযোগ ভাষা ও ধরণ নানাভাবে বদলায়। বিশেষ করে চলমান র্ভাচুয়াল দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক ‘বানোয়াট মিথ্যাচার কিংবা গুজব’ প্রতিনিয়ত লুট-খুন-ভাঙচুর-দখল-আক্রমণ উসকে দেয়। ২০২০ সনে করোনা মহামারির প্রথম ঢেউয়ে কেবল এক গুজবের কারণে করোনায় আক্রান্ত না হয়েও কিন্তু ‘করোনার কারণেই’ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পাতাখালীর রেণুকা রপ্তান মারা যান। 

৫.

ইতিহাস রচনার অন্যতম উৎস হিসেবে ধর্ম, ধর্মীয় আখ্যান, লোকাচার এবং স্থানীয় কৃত্যকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন গুহরা। গুহর ভাষায়, ‘… যেসব তথ্যের সূত্র ধরে ইতিহাস রচনা সম্ভব উপমহাদেশে তার প্রাচীনতম সংকলন রয়েছে ধর্মে। প্রভু আর অধীনের সনাতন সম্পর্কের সব বিশিষ্ট মুহূর্ত ধর্মেই গ্রথিত রয়েছে কর্তৃত্ব, সহযোগিতা আর প্রতিরোধের নিয়মে এবং এমন নিয়মের মূলে আছে কিছু ক্ষমতার বিধান; ইতিহাসে তার উচ্চারণ স্পষ্ট’। ধর্মভাব নিম্নবর্গের রাজনীতির একটি প্রধান উপকরণ, কিন্তু উচ্চবর্গের ইতিহাসচর্চায় বিষয়টিকে কেবল ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ হিসেবে দায়সারা হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহসহ ব্রিটিশি উপনিবেশবিরোধী লড়াইকে বিশ্লেষণ করে গুহ দেখান, কোনো বিদ্রোহের পূর্বে বিদ্রোহীরা তাদের জাগরণ এবং ঐক্যকে নিজেদের নয় বরং ঐশ্বরিক হিসেবে কল্পনা করেছেন; যা তাদের লড়াইকে আরো বেশি সংহত এবং সংঘবদ্ধ করেছে।

গুহর এই কাঠামোটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল জনপদে হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহকে পাঠ শুরু করি। সেই অভিজ্ঞতার ওপর লেখা আমার ‘জানাম-হাসা রক্ষায় ঐতিহাসিক গিরা : ১৭৮১ থেকে ২০০৮’ প্রবন্ধটি ২০০৯ সনে প্রকাশিত হয়। সাঁওতাল প্রবীণদের স্মৃতি-বিস্মৃতির অভিজ্ঞতার বিবরণ থেকে লিখেছিলাম, ‘...সাঁওতাল সমাজে ‘‘গিরা’’ মানে হল ধর্মীয় আহবান, এই আহবান জনগোষ্ঠীর মুক্তির আহবান। হুলের সময় সিধো-কানহো-চাদ-ভায়রো-ফুলমণি-জানো মুরমুরা নিপীড়িত সাঁওতাল জনগণকে গিরার ভেতর দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আর হুলের গিরাই ছিল সংগ্রামের গণইশতেহার এবং রণনীতি ও রণকৌশল।’ কিন্তু এই যে, সিধো-কানহো-চাদ-ভায়রোর সঙ্গে তাদের বোন ফুলমণি ও জানোর নাম লিখেছি, এটি একান্তই আমার উপস্থাপন ঢং। প্রবীণ সাঁওতাল নারী-পুরুষেরা হুলের বিবরণে দুই বোনের নাম এক কাতারে উল্লেখ করেননি। এমনকি হুলে এই দুই বোনের অবদান খুব কম লেখাতেই দৃশ্যমান হয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বাংলায় তাঁর ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ প্রবন্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘সাঁওতাল উপবিপ্লব’ বলেছেন, বিপ্লব নয়। রাষ্ট্রের স্বাধীন সংবিধান যেমন এখনো সাঁওতালসহ দেশের সব আদিবাসীদের ‘জাতি’ নয়, ‘উপজাতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

৬.

গুহ তার জীবনে বহু দেশ, বহু নদী, বহু মানুষের কাছাকাছি এসেছেন। কলকাতায় গুহ একটা সময় কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন, পরবর্তীতে বিদ্যায়তনিক তাত্ত্বিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন এবং পরে পাবলিক পরিসরের লেখালেখি শুরু করেন। গুহ কিংবা গুহদের কাজের এক বিশাল অংশজুড়ে আছে বাংলা অঞ্চল, বাংলাদেশ, তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের খতিয়ান। ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় এবং পাশাপাশি চাবাগানের জুলুমকে ধাক্কা মেরে লাখো বন্দি চাশ্রমিক ‘মুলুকযাত্রা আন্দোলন’ শুরু করে। এর ঠিক দু’বছর পর ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের সিদ্ধকাঠি গ্রামে জন্ম রণজিৎ গুহের।

বিস্ময়করভাবে ঠিক দু’বছর পরেই পাশের কীর্তিপাশা গ্রামে জন্ম নেন আরেক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। এভাবে উল্লেখ করবার মানে হলো ১৯২১ সনকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা নাকি একইসঙ্গে মুলুকযাত্রা আন্দোলনের স্মৃতি হিসেবেও? কিংবা কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো? একতরফা উন্নয়ন নাকি লাখো জীবনের উদ্বাস্তুকরণ ও বঞ্চনা হিসেবেও? গুহ বারবার অধিপতি ইতিহাসে দাবিয়ে রাখা স্তূপ থেকে নিম্নবর্গের জংধরা-মরচে পড়া-ধূসর-মলিনসব ঐতিহাসিক আখ্যান ইতিহাসের বিবরণে হাজির করবার কথা বলেছেন। কৃষক বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিম্নবর্গের বিবরণ নথিভুক্ত করতে হবে। নথিভুক্তকরণের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও অঙ্গীকার আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর সক্রিয় করতে হবে। তাহলেই ইতিহাসে কোনো চেহারা কী রেখা বা চিহ্ন কী গুজব বা রক্তদাগ মুছে মলিন হয়ে যাবে না।