ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ থেকে বৈ, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে সা, আর চাকমাদের ‘বিজু’ থেকে বি— এই তিন উৎসবের নামের আদ্যক্ষর জুড়ে তৈরি হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। সম্মিলিতভাবে উৎসব আয়োজনের এ উদ্যোগটি শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে। কিন্তু এটি আলাদা কোনো উৎসবের নাম নয়।
Published : 12 Apr 2025, 08:07 AM
বাংলাদেশে নানা বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মানুষের বাস। এ দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোও তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য আলাদা পরিচিতি বহন করে। সুদীর্ঘকাল থেকে আদিবাসী সমাজে প্রচলিত রয়েছে নানা ধরনের উৎসব ও পূজা-পার্বণ। এই উৎসবগুলোতে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পাহাড়ের আদিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব রীতি। এ সময়টায় তারা গান ধরে— ‘তুরু তুরু তুরু রু-বাজি বাজাত্তে/পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে/এচ্যে বিজু, বিজু, বিজু....’ (তুরু তুরু শব্দে বাঁশি বাজে, গ্রামে ঘুরে বেড়াব সবাই মিলে, আজ বিজু, আজ বিজু)।
চৈত্র-বৈশাখে চাকমারা বিজু, ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাইং, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু উৎসব পালন করে থাকে। এছাড়া অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোও নিজ নিজ নামে অভিহিত করে তাদের এ সময়ের উৎসবটিকে।
আদিবাসীদের বর্ষবরণ উৎসব এলেই মূলধারার প্রায় সকল সংবাদমাধ্যমেই বৈসাবিকে তুলে ধরা হয়। এ রেওয়াজটি চলছে বহুদিন ধরে। ফলে এখন সাধারণ পাঠকের কাছেও বৈসাবি পাহাড়ের আদিবাসীদের একটি উৎসবের নাম। কিন্তু আসলেই কি তাই?
মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ থেকে বৈ, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে সা, আর চাকমাদের ‘বিজু’ থেকে বি— এই তিন উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর জুড়ে তৈরি হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। এটি আলাদা কোনো উৎসবের নাম নয়, বরং জাত্যাভিমানী বাঙালিদের চাপিয়ে দেওয়া নাম। সম্মিলিতভাবে উৎসব আয়োজনের এ উদ্যোগটি শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে।
‘বৈসাবি’ শব্দটিকে বিনা ব্যাখ্যায় উৎসব হিসেবে তুলে ধরা ঠিক নয় বলে অনেকেই মনে করেন। এতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পার্বত্য এলাকার অন্য জাতিগোষ্ঠীর মূল উৎসবের নামগুলো প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এটি কাম্য নয়। তাই আদিবাসী গবেষকরা সংমাধ্যমকর্মীদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
পাহাড়ের আদিবাসীদের বর্ষবরণ উৎসব কেমন হয়? আমার গবেষণার আলোকে কিছু তথ্য তুলে ধরছি, যা গণমাধ্যমকর্মী ও আগ্রহী পাঠকদের কিছুটা হলেও ঋদ্ধ করবে।
ত্রিপুরাদের প্রধানতম উৎসব বৈসু বা বুইসুক। উৎসবটি তিনদিনের। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনকে তারা ‘হারি বৈসু’ আর শেষ দিনটিকে ‘বিসুমা বা বুইসুকমা', আর পহেলা বৈশাখের দিনটিকে তারা 'বিসিকাতাল' বলে। ত্রিপুরারা মনে করে, তাললাং মাসের ৩০ তারিখে রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছিল। এ কারণেই এটি বর্ষবরণের দিন। দ্বিতীয়ত, তাদের বিশ্বাস বিষুসংক্রান্তি লগ্নে দিনরাত্রি সমান হয়। ফলে ওই দিনটি অধিক পূণ্যময়। তৃতীয়ত, বৈসু উৎসবের দিনগুলিতে গরিয়া নৃত্যোৎসবের মাধ্যমে তারা মূলত উদ্দীপনা ও শক্তি সঞ্চয় করে থাকে।
বৈসু তিথি লগ্নে ত্রিপুরারা প্রয়াত পিতৃপুরুষদের স্মরণে পরলৌকিক মঙ্গল কামনায় বংশ প্রদীপ জ্বালিয়ে একটি পূজানুষ্ঠান করে থাকে। এর নাম ‘সিমতুং’। এ সময় অবিবাহিত নারীরা নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির আশা নিয়ে নদীতে মঙ্গল প্রদীপও ভাসিয়ে দেয়। ‘হারি বৈসু’ দিনটিতে ত্রিপুরারা বিশেষ শ্রদ্ধায় গবাদি পশুপাখিকে চন্দন পানি দিয়ে স্নান করায় ও তাদের উন্নতমানের খাদ্য ও পানীয় খাওয়ায়। অতঃপর ফুলের মালা পরিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এদিন বাড়িঘর নিম ও আমপাতা, দুর্বাঘাস ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। কেননা এ আদিবাসী সমাজে নিম, আম, ডুমুর, বট ও অশ্বত্থ গাছের পাতাকে শান্তির প্রতীক, দুর্বাকে অমরত্বের প্রতীক, ফুলকে ভক্তির প্রতীক আর পান-সুপারিকে কল্যাণের প্রতীক মনে করা হয়।
এ দিন সৃষ্টিকর্তার কাছে মঙ্গল কামনায় ভোরে নদীর তীরে কাদামাটি ও বালুর দেবী তৈরি করে ত্রিপুরারা। এটি ‘খুমকামুং’ পূজা। সন্ধ্যায় মৃত আত্মীয়-স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনা করে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় তারা। একে বলা হয় ‘সিমতং’ পূজা। এ সময় যুবক-যুবতীরা সুন্দর পোশাক পরিধান করে ঢোলের বাজনায় মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে কলা পাতা বা কাঁঠাল পাতার ঠোঙ্গায় তৈলের প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। আবেগ আপ্লুত হয় তাদের মন। হাজার হাজার প্রদীপ তখন নদীর জলে ভাসতে থাকে। রাতের অন্ধকারে তা অপরূপ দেখায়। ওইদিন অতিথিদের জন্য ঐতিহ্যবাহী পানীয় তৈরি করা হয়।
ত্রিপুরারা বিসুমা পর্বকে সংযম ও ত্যাগের পর্ব বলে। মাটি কোপান, গাছ ও বাঁশ কাটা ও প্রাণীবধ করা এ সময়টায় নিষেধ থাকে। বিশেষ ধরনের নিরামিষ বা ‘পাচন’ তরকারি খেয়ে আদিবাসীরা ওইদিন মঙ্গলের জন্য উপাসনা করে। বিসিকাতাল পর্বে মূলত নতুন বছরকে স্বাগত জানায় ত্রিপুরারা। এ সময় দৈহিক, মানসিক ও জাতির সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য পূজা করে তারা। প্রতিটি পরিবার আমিষ খাদ্যের আয়োজন করে। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস বিসিকাতাল অর্থাৎ নববর্ষের দিন কেউ খালি মুখে ফিরে গেলে ওই গৃহস্থের অমঙ্গল হবে।
ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবে ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরনের পিঠা আর পানীয় পান করানো হয়। উৎসব শুরু হলে 'গরাইয়া' নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে। এ নৃত্যে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। নৃত্য দলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়।
নৃত্য শেষে প্রতি বাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন আগতদের হাতে পানীয়, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে তারা। তবে একবার কেউ এ নৃত্যে অংশ নিলে তিন বছর পর্যন্ত আর ওই নৃত্যে তার অংশ নেয়ার নিয়ম নেই।
মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস ‘তিইংখুং’। এ মাসেই উদযাপিত হয় নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। এটি মারমাদের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব। সাধারণত তিনদিন এ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা পালন করে তারা। প্রথম দিনটিকে বলে ‘পাইং ছোয়াইক’। এর শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ দিন মারমা যুবতীরা গোলাপ, জবা, গন্ধরাজ, বেলীসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধ পূজার রাত্রে ওইসব ফুল সাজিয়ে দলবেধে ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। বুদ্ধমূর্তির বেদীতে ভক্তিসহকারে ওই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রংয়ের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে।
যারা বিহারে যেতে পারে না তারাও নিজগৃহে রাখা বুদ্ধমূর্তির সামনে ফুলের অর্ঘ্য, মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে। ওইদিন ভোরে প্রবীণেরা অষ্টশীল গ্রহণ ও উপবাস পালনের জন্য বিছানাপত্রসহ অবস্থান নেয়। বিকেলে মন্দিরের বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সকল বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। যারা প্রদক্ষিণরত মিছিলে আসতে পারে না তারাও ওইসময় কলস ভর্তি পানি দিয়ে যে কোনো পথ ধুয়ে, পরিষ্কার করে বুদ্ধমূর্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় হরেক রকমের পিঠা-পায়েসও তৈরি করে তারা।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে মারমারা বলে ‘সাংগ্রাইং রাইকু বা আইক্যা’। এ দিনটি সাংগ্রাইং দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। আগত পূজারীকে প্রবীণ গুরুজন কর্তৃক প্রদান করা হয় আশীর্বচন। পূজার্ঘ্যর জন্য কলা, পেঁপে, নারকেল ইত্যাদি রঙিন কাগজে মুড়ে মোমবাতির প্যাকেটসহ তা বুদ্ধমূর্তির বেদীতে রেখে প্রার্থনা করা হয়।
‘সাংগ্রাইং আপ্যাইন’ হচ্ছে উৎসবের তৃতীয় দিন। এটি দেবীর প্রত্যাবর্তন দিবস। তাই ভোরে মঙ্গলাচরণ ও স্তত্র পাঠ, সকালে অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে দিবসের সমাপ্তি ঘটে।
মারমারা সামাজিকভাবে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যুবক-যুবতীদের মাঝে এ অনুষ্ঠান সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। অনুষ্ঠানে যুবতীরা প্যান্ডেলের ভেতরে পানিভর্তি নৌকা বা ড্রামকে পেছনে রেখে সারিবদ্ধভাবে পানির পাত্র হাতে নিয়ে নৌকা বা ড্রামের গা ঘেঁষে বসে থাকে। যুবকেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেচে গেয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগোতে থাকে। প্রত্যেকের হাতে থাকে খালি বালতি ও মগ। তারা কমিটির কাছ থেকে নির্ধারিত হারে পানি কিনে প্যান্ডেলের বাইরে পানি নিক্ষেপ স্থানে অবস্থান নেয়। যুবতীরা যুবকদের দিকে পিঠ রেখে উল্টোদিকে ফিরে সারিবদ্ধভাবে নৌকার পাশে বসে কিংবা ড্রামের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রতিটি যুবক পছন্দানুযায়ী এক-একজন যুবতীকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ঠ স্থান থেকে পিঠের ওপর পানি নিক্ষেপ করে। দু-তিনবার পানি পড়ার পর যুবতীটি উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকের মুখোমুখি হয়ে নৌকা বা ড্রাম থেকে মগে পানি তুলে যুবকের মুখের দিকে প্রীতি বিনিময়সূচক পানি ছুঁড়ে মারে। যুবকের বালতির পানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত উভয়ে পরস্পরের প্রতি এভাবে পানি ছুঁড়তে থাকে। পানি নিক্ষেপে কোনো ঝগড়া-বিবাদ করা যায় না। কৌনিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোনো অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।
সাংগ্রাইং উৎসব চলাকালে ভাত ও নানা প্রকার তরকারি সহযোগে পৃথকভাবে ক্যারিয়ারে সাজিয়ে যে খাদ্যসামগ্রী বৌদ্ধ ভিক্ষু, উপাসক ও গুরুজনদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, মারমা ভাষায় তাকে ছোয়াইং বলা হয়।
এছাড়া, জাহাজ টানা অনুষ্ঠানও পালন করে এ আদিবাসীরা। এ অনুষ্ঠানের জন্য কাঠের চাকার ওপর বাঁশ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে জাহাজ তৈরি করা হয়। যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, ছোট ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে বাদ্য বাজিয়ে গান গেয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে তা টেনে নিয়ে যায় বৌদ্ধ বিহার পর্যন্ত। এ সময় অনেকেই মনের নানা ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে জাহাজের মাঝে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। কেউ কেউ ছুড়ে দেয় টাকা পয়সা। যা পরবর্তী সাংগ্রাইং-এর খরচের জন্য তুলে রাখা হয়। শেষ রাতে এটিই বিসর্জন দেওয়া হয় নিকটবর্তী নদী বা খালে।
মারমাদের বিশ্বাস, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। স্বর্গ থেকে মর্ত্যে ওই দেবী নেমে আসার অর্থাৎ পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং বা নববর্ষ পালনের উৎসব। তিনি যতদিন মর্তে থাকেন, ততদিন এই উৎসব পালিত হয়। সাধারণত তিন থেকে পাঁচদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী চাকমা। তাদের বিজু উৎসবের সঙ্গে দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে মূল বিজু, তার আগের দিনটিকে ফুল বিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে নতুন বছর বা 'গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে।
ফুল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা অনেক সময় বয়োবৃদ্ধরাও খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দলে দলে নানা দিকে ফুল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। এরপর তারা নিজ নিজ বাড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়ে নেয়। এছাড়া ফুল দিয়ে বুদ্ধ পূজা, গৃহ দেবতার পূজাও করে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায়ও ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়।
ফুল বিজুর দিনে গ্রামের সবাই একত্রিত হয়ে শিকারে বের হয়ে যায়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদী বা জলাশয়ে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল ও ক্ষেত খামারে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় নানারকম পিঠা বানানো। পরদিন খাওয়ার জন্য চাকমরা সান্যাপিঠা, বরাপিঠা, হগাপিঠা ইত্যাদি তৈরি করে। ফুলবিজুর রাতে আকাশে যখন পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে তখন গ্রামে গ্রামে চাকমাদের ‘গেংগুলি’ নামক চারণকবিরা বেহালা ও বাঁশি বাজিয়ে পালাগান করে থাকে।
মূল বিজুর দিন প্রতি বাড়ির নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নদীতে বা জলাশয়ে স্নান সেরে নেয়। অতঃপর দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে চাকমারা পুরাতন বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে ঘরে ঘরে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার।
যুবতী মেয়েরা বাড়ির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নদী বা জলাশয় থেকে পানি এনে নিজ হাতে স্নান করায়। ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড় পরে ‘কুরুম’ বা ছোট বেতের ‘টুরং’(ঝুড়ি) এ ধান নিয়ে দলে দলে প্রতি বাড়িতে গিয়ে মোরগ-মুরগি ও হাঁসের খাওয়ার জন্য উঠানে ধান ছিটায়। এ সময় বাড়ির লোকেরা তাদেরকে পিঠা, পাঁচন ইত্যাদি খেতে দেয়। ওইদিন সবাই সবার বাড়িতে বেড়াতে গেলে নানা ধরনের খাবারের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী পানীয় 'জগরা' বা 'কাঞ্জি' দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দলবেধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এ দিনটি গিলাখেলা, গুদুসহ (হাডুডু) বিভিন্ন খেলাধুলা ও আমোদের মধ্যে অতিবাহিত করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। মূল বিজু বা বৎসরের শেষ দিনে নানা প্রকার পানীয় ও উত্তম খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন বা নববর্ষের প্রথম দিনে চাকমারা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই এ দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলা হয়। চাকমাদের মতো তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীরাও একইভাবে বিষু উৎসব পালন করে থাকে।
চৈত্র-বৈশাখে বাঙালির মতো আদিবাসীদেরও সম্মিলন ঘটে নানা উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতায়। এ উৎসবগুলোই তাদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় আদিবাসীরা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু।
বিগত কয়েক দশক ধরে পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি-বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধনে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলে। যার রেশ এখনও রয়ে গেছে। বরাবরের মতো এবারও পাহাড়ে বর্ষবরণের আদিবাসী উৎসবগুলো শুরু হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ প্রশাসন থেকেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ফলে কিছুটা স্বস্তিতেই চলছে পাহাড়ে আদিবাসী উৎসবগুলোর এবারের আনুষ্ঠানিকতা।
এ দেশে সব জাতির উৎসবগুলো পালিত হোক নির্ভয়ে। সেটিই আমরা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ওই পরিবেশ তৈরিতে প্রশাসনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদেরই। আমরা চাই, উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষে পাহাড়ি-পাহাড়ি ও পাহাড়ি-বাঙালির পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় হোক।