আজকাল কারো হাতে রাষ্ট্রীয় ন্যূনতম ক্ষমতা থাকলেই তিনি তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজের, স্ত্রীর এবং সন্তানদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। অথচ আমাদেরই পূর্বপুরুষ—যারা পাঁচ দশক আগেই এই জনপদে ছিলেন; এই জনপদে রাজনীতি করেছেন; এই দেশটাকে স্বাধীন করেছেন—তাদের সততা ও দেশপ্রেমই বরং এখন রূপকথার গল্প!
Published : 11 Jul 2024, 05:36 PM
গল্পগুলো গল্প নয়। সত্যি। এই সময়ের বাংলাদেশে খুবই প্রাসঙ্গিক—যখন চারিদিকে নীতিহীনতা আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার ঘটনা একটির পর একটি সামনে আসছে। রীতিমতন বাবাকে ‘আপনার বাবাকে দুর্নীতিবিরোধী টিকা দিন’ ক্যাম্পেইন হচ্ছে। অথচ এই গল্পগুলো বাংলাদেশেরই কতিপয় মানুষের— যারা এই মাটির আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। যাদের নাম মোশাররফ, খালেদ, আসাদ কিংবা লুৎফর। মাত্র পাঁচ দশক আগেও যারা এই বাংলাদেশের গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে ছিলেন। ক্ষমতার পাদপ্রদীপে ছিলেন। অথচ তাদের সেই গল্প এখন এই বাংলাদেশের মানুষের কাছে রূপকথার গল্প বলে মনে হবে। গল্পগুলো তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শোনা।
এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ
শুরু করা যাক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৬ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রখাত আইনজীবী এ. কে মোশাররফ হোসেন আকন্দকে (১৯১৭-১৯৯৫) দিয়ে। এই গল্পগুলো বলেছেন তার ছোট ছেলে মাসুদ আলম আকন্দ এবং তার নাতনির জামাই, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ।
১. মোশাররফ হোসেন আকন্দের বড় ছেলে ক্যাপ্টেন মাহমুদ হোসেন আকন্দ চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে দায়িত্বরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই তিন দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে হাউজ অ্যারেস্ট করে এবং এপ্রিল মাসে অমানুষিক নির্যাতনের হত্যা করে। তার মরদেহটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহীদ পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকার মোশাররফ হোসেন আকন্দকে ঢাকা শহরে একটি বাড়ি উপহার দেয়ার উদ্যোগ নেয়। তিনি এই সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিবিদ সেটি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন: ‘‘মাই সান ইস মাচ মোর প্রেশাস দ্যান আ হাউজ।’’ ছেলের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। তার বিনিময়ে একটা বাড়ি হতে পারে না।’
২. মোশাররফ হোসেন আকন্দ একজন সিনিয়র আইনজীবী হওয়ার পরও তিনি মক্কেলদের কাছ থেকে খুব বেশি ফি নিতেন না। একদিন সকালে একজন জুনিয়র তার হাতে কিছু টাকা দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এটা কীসের টাকা? জুনিয়র জানালেন, আগের দিন তিনি যে কাজটি দিয়েছিলেন, তার মক্কেল দিয়েছেন। মোশাররফ হোসেন আকন্দ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জন্য কিছু রাখোনি? তিনি বললেন, জি রেখেছি। এটা আপনার। আকন্দ সাহেব টাকাটা গুনে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, এভাবে হবে না। নেহায়েত বিপদে না পড়লে মানুষ ডাক্তার ও উকিলের কাছে যায় না। তুমি যে কাজ করে দিয়েছ, সেটা খুবই ছোট। এর বিনিময়ে এত টাকা নেয়া উচিত হয়নি। তিনি তখন তার ওই জুনিয়রকে বললেন, মানুষ যখন মামলা নিয়ে আসবে, প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে যে তার আর্থিক অবস্থা কেমন? যদি বলে যে জমি বা গরু বিক্রি করে মামলার খরচ জোগাবে, তাহলে তার মামলাটি বিনা পয়সা করে দেবে না হয় মামলাটি নেবে না। দ্বিতীয়ত, মোশাররফ হোসেন আকন্দ অনেক সময় মামলা না নিয়ে দুপক্ষকে ডেকে মীমাংসা করে দিতেন— যাতে আদালতে গিয়ে দুপক্ষেরই অর্থ ও সময় নষ্ট না হয়।
৩. মোশাররফ হোসেন আকন্দ ময়মনসিংহ আদালতে প্র্যাকটিস করতেন। একসময় ওই আদালতে সিনিয়র সাব জজ হিসেবে বদলি হন মো. শাহনেওয়াজ (পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনার)। মোশাররফ হোসেন আকন্দ তার আপন নানা শ্বশুর।তিনি একটি অদ্ভুত ঘটনা বললেন: ‘একদিন আমার নানা শ্বশুর দুটি কেসের নম্বর দিয়ে বললেন— এই দুটি মামলা আমার নিজের। তোমার কোর্ট থেকে অন্য কোর্ট থেকে পাঠিয়ে দাও। পরে আমি আদালতে গিয়ে মামলা দুটির নথি এনে দেখি, ওই দুটি মামলা আমার আদালতে শুনানির জন্য দুই তিনবার এসেছে। শুনানির জন্য প্রতিবারই প্রতিপক্ষ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু বাদীপক্ষ বারবার সময় নিয়েছে। তখন আমি প্রতিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান খানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো জানতেন মোশাররফ হোসেন আকন্দ আমার আপন নানা শ্বশুর। তারপরও কেন প্রতিবার আমার কোর্টে শুনানির জন্য আপনারা প্রস্তুত থাকতেন? জবাবে আনিসুর রহমান খান বললেন: আমি জানতাম আকন্দ সাহেব কখনো আপনার আদালতে মামলা রাখবেন না। সে কারণে আমরা হাজিরা দিতাম। কিন্তু আমরা জানতাম আকন্দ সাহেব আসবেন না।
আসাদুজ্জামান খান
গণপরিষদ সদস্য এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আসাদুজ্জামান খান। এই নিঃসন্তান রাজনীতিকের সততা ও নির্লোভ জীবনের দুটি ঘটনা শোনা যাক তার ভাইয়ের ছেলে কাজী শাহীন খানের কাছ থেকে।
১. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে তার মামাতো ভাই আসাদুজ্জামান খানকে বড় ভাই ফজলুল করিম খান রসিকতা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘নজরুল তো মন্ত্রী হইছে। তুই মন্ত্রী হইলে যাইতি না মিন্টু রোডে?’ আসাদুজ্জামান খান তখন ময়মনসিংহ-২৬ আসনের সংসদ সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও ছিল হৃদ্যতা। বড় ভাইয়ের রসিকতার জবাবে আসাদুজ্জামান খান বললেন, ‘আমি মিন্টু রোডে যাইতাম না।’ বড় ভাই জিজ্ঞেস করলেন– ক্যারে? তিনি জবাব দেন: ‘ভাইছাব হুনেন, আমি যদি ওইহানে (মিন্টু রোড) যাই, আবার আয়া পড়তে অইব বিছনা-বেডিং নিয়া। এহানেই থাকবাম।’
প্রসঙ্গত, আসাদুজ্জামান খানের বাড়ি তখন রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় ২৪/এ তোপখানা রোডে। বড় ভাইকে বললেন: ‘যদি মন্ত্রী হই, ওইহানে, বাড়ির কোণাডায় একটা পুলিশ বক্স বানাইবো। মন্ত্রিত্ব গেলে গা পুলিশ থাকব না। কিন্তু বক্সটা থাকব। মানুষ তখন কইব, ওই যে মন্ত্রীর বাড়ি।’ যদিও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ পাটমন্ত্রী হয়েছিলেন আসাদুজ্জামান খান। তিনি মোট তিনবার মন্ত্রী পদমর্যাদায় ছিলেন। কিন্তু কখনো মিন্টু রোডে সরকারি বাড়িতে ওঠেননি। তিনি সব সময় তোপখানা রোডে নিজের বাড়িতেই ছিলেন।
২. ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের পরে বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালীন তার একজন এপিএস বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) চাকরির আবেদন করেছিলেন। তখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন আসাদুজ্জামান খানের ছাত্র। তার এপিএস অনুরোধ করলেন তিনি যেন একটু সুপারিশ করে দেন। কাজী শাহীন বলেন, চাচা কোনোদিন কারো কাগজে এই কথা লেখেন নাই যে, ‘সুপারিশ করা গেল’। তিনি এপিএসকে বললেন, ‘তুমি যোগ্য ছেলে। আমার সঙ্গে দুই বছর ধরে আছ। ইন্টারভিউ দাও। তোমার চাকরি এমনিই হবে। সুপারিশ করা মানে কিছু ঘাটতি আছে। আমি কেন প্রথম শ্রেণির একটা চাকরির জন্য ঘাটতিসম্পন্ন একজনের পক্ষে সুপারিশ করব?’
আবদুর রউফ
ষাটের দশকের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আবদুর রউফ। অগাস্ট ট্র্যাজেডির পরে এরশাদের আমলে তার কাছে মন্ত্রিত্বের অফারও এসেছিল। গ্রহণ করেননি। তার ছেলে ডা. মোস্তফা মইন উদ্দীনের ভাষ্য: ‘শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী তার ফ্ল্যাগ তোলা গাড়ি নিয়ে এলেন। আব্বারে বললেন, রউফ, মিজান ভাই তোমাকে ডেকেছেন। যে পদ চাও, দেবেন। আম্মা তখন একমাত্র ইঁদুরে কাটা সোফাটির ভাঙা পায়ে দশ ইঞ্চির ইট ঠেক দিয়ে উপরে কাপড় দিয়ে ঢাকতে ব্যস্ত। আমার ছেঁড়া স্কুলব্যাগে এক টাকার সুঁই দিয়ে অনভ্যস্ত-প্রাণপণ জোড়াতালি, বই যেন না হারায়। আব্বার উত্তর, না, ইউসুফ ভাই, বঙ্গবন্ধুর কাছে রাজনীতি শিখেছি। নিজেকে পরিচয় দিয়েছি As a political son of Bangabandhu, আদর্শের সঙ্গে আপস নয়।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ নভেম্বর ২০১৪)।
মইন উদ্দীন লিখেছেন: ‘চাকরি-বাকরি নেই, ব্যবসা নেই, সব সময় পেছনে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে অসহায় একজন ৩৪ বছর বয়সী সাবেক এমএনএ আবদুর রউফ। বলতেন, বেটা, ওই সময়ে বালুর কন্ট্রাকটারি পর্যন্ত করেছি। রেশনের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি চাল-তেল-চিনির জন্য। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে আট আনায় আসতাম মালিবাগ পর্যন্ত। তারপর কিছুটা হেঁটে পকেটের তিন টাকায় যখন নয়াটোলা পর্যন্ত রিকশাওয়ালা মানতো তখন উঠতাম।’
অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ
পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ। এরপরে বিভিন্ন সময়ে তাকে পদ-পদবি এমনকি মন্ত্রিত্বেরও অফার দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নীতির সঙ্গে আপোস করতে রাজি হননি এবং দলীয় আদর্শও পরিবর্তন করতে চাননি। শুধু রাজনৈতিক জীবন নয়, বরং ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও নীতি-আদর্শের সঙ্গে কখনো আপস করেননি হুমায়ুন খালিদ। রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকার পরেও নিজের সন্তানের জন্যও কখনো তদবির করেননি। তার মেয়ে বেলী খালিদ বলেন, ‘আমি তখন এইচএসসি পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছি। সেই সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ডা. মাজেদ। আব্বার বিশিষ্ট বন্ধুজন। আব্বাকে বললাম আমি ভর্তি পরীক্ষা দেব। তুমি একটু মাজেদ স্যারের সঙ্গে কথা বলে রেখো। আব্বার কাছ থেকে উত্তর আসে: আগে চান্স পেয়ে নাও, তারপরে তার সঙ্গে দেখা করব। বন্ধু হলেই যে আমার সুপারিশ করতে হবে— এটা বলা ঠিক নয়। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই, সে সময় বায়োকেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারমান আব্বার ক্লাসমেট। একটু লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম উনাকে দেওয়ার জন্য। তার সোজা উত্তর, না। নিজের যোগ্যতায় ভর্তি হও।’
শওকত আলী খান
খ্যাতিমান আইনজীবী এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য শওকত আলী খান ছিলেন নিঃসন্তান। তার কাছে থেকে বড় হয়েছেন তার এক নাতি ব্যারিস্টার রেহান হুসেন। তিনি বলেন, আইনজীবীদের প্রতি শওকত আলী খানের ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। বয়সে অনেক জুনিয়রকেও তিনি সম্মান করতেন। ভালোবাসতেন। কোর্টের বারান্দায় অনেক দিন তাকে দেখেছি কোনো জুনিয়রের টাই ঠিক করে দিচ্ছেন। পুরান ঢাকা থেকে হাইকোর্টে আসার পথে প্রায় প্রতিদিনই নানা রাস্তায় রিকশা বা অন্য কোনো বাহনের জন্য অপেক্ষমাণ কোনো আইনজীবীকে নিজের গাড়িতে তুলে নিতেন। বিচার বিভাগের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ এতটাই ছিল যে, একবার আমরা কোর্ট শেষ করে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ নানা খেয়াল করলেন যে আমরা একজন বিচারকের গাড়ি ওভারটেক করে গেছি। নানা সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে গাড়ি স্লো করতেন বললেন এবং নির্দেশ দিলেন, আমাদের গাড়ি যেন বিচারকের গাড়ির আগে না যায়। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল আইনজীবীকে ভালোবাসতেন। তিনি আমাকেও বলতেন যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কোনো আইনজীবীর প্রতি আমার আচরণ পক্ষপাতমূলক না হয়।
হাফেজ হাবীবুর রহমান
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান ছিলেন সৎ, নীতিবান ও আদর্শবান মানুষ। তার গুলশানের ১১৫ নং বাড়িটি ১৯৭৩ সালে বায়না করার পরেই কিছুদিনের মধ্যে বাড়ির মূল্য ক্রমাগতভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকলে অনেকেই তাকে বলেছিলেন যে, তিনি চাইলে বায়নাটি বাতিল করতে পারেন। তাতে আরও বেশি দামে বাড়িটা বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু তিনি বায়না বাতিল করেননি। কারণ ক্রেতাকে তিনি কথা দিয়েছেন। অর্থ বা ক্ষমতার মোহ তাকে স্পর্শ করেনি।
এম. আব্দুর রহিম
এম আব্দুর রহিম সম্পর্কে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম বি আখতার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘চাচা বলতেন- ছাত্রলীগ কারও পকেটের সংগঠন নয়; কাজ করতে হবে, রাজনীতি করতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সামনে নিয়ে ছাত্রদের স্বার্থে। আর্থিক সহযোগিতা চাইলে বলতেন, ‘বাপুরে আমিও চাই তোমাদের সহযোগিতা করতে; কিন্তু এত টাকা (২০-৫০ টাকাকেই তিনি বলতেন এত টাকা) তো জোগাড় করা মুশকিল, দেখি কী করতে পারি। রিকশায় বা বাসে করে দূরে কোথাও (যেমন, পাশের থানা বিরল, বোঁচাগঞ্জ, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর) যাওয়ার কথা বললেই বলতেন– ইনায়েতুর, মালেকের সাইকেল আছে; আর কয়েকটি জোগাড় করে ডাবল করে যাও। ট্রেনে যাও, রেল শ্রমিক নেতাদের বলে দেব। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বলব, তোমাদের নাস্তা খাওয়াবে। হয়তো তিনি সেই টাকা দিতে পারতেন কিন্তু ছাত্ররা অর্থের কাছে কলুষিত হোক– এমনটি চাইতেন না বিধায় এ পরামর্শগুলো দিতেন। তিনি সব সময় পড়ালেখার পাশাপাশি সৎভাবে ছাত্র রাজনীতি করার কথা বলতেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ
সংবিধান প্রণয়ণ কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ইচ্ছে করলেই বিত্তশালী হতে পারতেন। গাড়ি-বাড়ি-সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু সে মোহ তার কখনোই ছিল না। বরং সারাজীবন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন। আমৃত্যু তিনি ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়েছেন। রিকশায় করে অফিস করেছেন প্রতিদিন। শ্বেত শুভ্র পোশাকে সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু লালন করতেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ। অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ছিল তার অগাধ দরদ, সম্মানবোধ।
ব্যারিস্টার বাদল রশীদ
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে রাজধানীর ঝা চকচকে জীবন কখনোই টানেনি। তিনি গ্রামকে ভালোবেসে, গ্রামের মানুষকে ভালোবেসে তিনি একজন কৃষকের জীবন বেছে নিয়েছেন। ইউরোপে পড়াশোনা করলেও এবং পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরলেও তার জীবনাচরণ ছিল আবহমান গ্রামবাংলার অতি সাধারণ মানুষের মতো। লুঙ্গি, গেঞ্জি ও স্যান্ডেল পরতেন। আলমডাঙ্গা থেকে প্রতিদিন বিকালে একটা ‘ফিফটি মোটর সাইকেল’ চালিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরে আসতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতেন।
লুৎফর রহমান
গাইবান্ধার খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ লুৎফর রহমানকে বঙ্গবন্ধু স্নেহ করতেন তার সততা ও নিষ্ঠার কারণে। তিনি কখনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে বঙ্গন্ধুর কাছে কিছু চাননি। একদিন বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, কতজন নিজের জন্য কত কিছুর আবদার নিয়ে আসে। তুই তো কোনোদিন নিজের জন্য কিছু চাস না। উত্তরে লুৎফর রহমান বলেছিলেন, ‘আপনি তো আছেন, আমার আর কিছুর দরকার নেই।’
তার সততার কয়েকটি ঘটনা জানা যায় তার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে।
১. ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু তাকে ৮ হজার টাকা দিয়েছিলেন। নির্বাচন শেষে কিছু টাকা বেঁচে যায়। লুৎফর রহমান সেই বেঁচে যাওয়া টাকা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত দিতে গেলে তিনি কিছুটা বিস্মিত হন এবং টাকাটা দলের জন্য খরচ করতে বলেন।
২. মুক্তিযুদ্ধের সময় মানকার চরে মুক্তিযুদ্ধ যুবশিবিরের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত টাকা-পয়সা খরচের দায়িত্ব ছিল লুৎফর রহমানের। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে তিনি ৯০ হাজার টাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলেন, এই টাকাটা বেঁচে গেছে। বঙ্গবন্ধু তাকে ওই টাকা এলাকার উন্নয়নে খরচ করার জন্য বলেন।
৩. দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। রাস্তা-ঘাট স্কুল-কলেজসহ সব অবকাঠামো বিধ্বস্ত। লোকজন এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ঘোরাঘুরি করত। লুৎফর রহমান লোকজনকে স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধ করে এক প্রকল্পের টাকা দিয়ে দুটি কাজ করাতেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, ‘আপনারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এই কাজটা করেন। আমি আপনাদের কাজটা করে দেব।’
৪. ১৯৭৪ সাল। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। বন্যা আর খরার কারণে বরাবরই উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। এক রাতে লুৎফর রহমান তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরকে নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে আলাপ করছিলেন। বিদ্যুৎ চলে গেলে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। হাঁটতে গিয়ে তার পায়ে কিছু একটা বেঁধে যায়। টর্চলাইট জ্বালিয়ে দেখেন একজন মানুষের মৃতদেহ। এই দৃশ্য দেখে সবাই ব্যথিত হন। নিজের নির্বাচনি এলাকায় পায়ে পায়ে লাশ ঘুরবে, তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনা শুনে বঙ্গবন্ধুরও চোখের কোণে পানি জমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গাইবান্ধার জন্য বিশেষ বরাদ্দের নির্দেশ দেন এবং লুৎফর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘প্রত্যেক জেলায় যদি তোর মতো একজন করে গভর্নর দিতে পারতাম, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম।’
প্রসঙ্গত, সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন— এরকম আরও অনেকের জীবনের সততা ও নৈতিকতার গল্পগুলোর এরকমই। যাদের কাছে প্রাচুর্য, অর্থবিত্ত, ক্ষমতা এমনকি পরিবারের চেয়েও অনেক বড় ছিল দেশ দেশ ও দেশের মানুষ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও যে মানুষগুলো অতি সাধারণ জীবন-যাপন করে গেছেন। যে কারণে আজ পাঁচ দশক পরেও আমরা তাদের স্মরণ করি। অথচ এখন চারিদিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার। এমপি মন্ত্রী দূরে থাক, একজন সরকারি অফিসের পিয়ন কিংবা ড্রাইভারেরও যে সম্পদের বিবরণ গণমাধ্যমে আসছে, তা দুই তিন দশক আগেও ছিল রূপকথার গল্প। কিন্তু এখন রূপকথার গল্পের সেই আলাদিনের চেরাগ ক্ষমতাবানদের হাতে হাতে। আজকাল কারো হাতে রাষ্ট্রীয় ন্যূনতম ক্ষমতা থাকলেই তিনি তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজের, স্ত্রীর এবং সন্তানদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। অথচ আমাদেরই পূর্বপুরুষ—যারা পাঁচ দশক আগেই এই জনপদে ছিলেন; এই জনপদে রাজনীতি করেছেন; এই দেশটাকে স্বাধীন করেছেন—তাদের সততা ও দেশপ্রেমই বরং এখন রূপকথার গল্প!
মানুষের মনোজগতটাই এমনভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে, এখন আর কেউ কোনো দুর্নীতির খবরে বিস্মিত হয় না। এমনকি খুব ভালো, সৎ ও নীতিবান মানুষ হিসেবে পরিচিত কারো বাড়ি থেকেও যদি একশো কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়; যদি জানা যায় যে তার বাড়িটাও অবৈধ পয়সায় বানানো; নীতিবান লোক হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে তিনি দুই নম্বর—তারপরও মানুষ সম্ভবত এখন আর বিস্মিত হবে না। বরং তাদের মনোজগত এমনভাবে তৈরি হয়ে গেছে বা তাদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা কমতে কমতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, এখন নিতান্ত ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত কারো বিরাট দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলেও মানুষ বলবে: ‘ও আচ্ছা, তাই নাকি...’
প্রশ্ন হলো, মানুষের মনোজগতে এই বিরাট পরিবর্তনটা হলো কী করে? ৫৩ বছরে আমরা সামনে দিকে কতটুকু এগোলাম আর কতটুকুই বা পিছিয়ে গেলাম?