বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাংলাদেশের সংবিধানও তেমনি, এটি অন্য কোনো দেশের তৈরি করা নয়।
Published : 28 Oct 2024, 05:52 PM
১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের ‘জন্ম’ ভারতে– এমন আলোচনার সূত্রপাত অনেকের কাছেই বিব্রতকর। বাহাত্তরের সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মাত্র চার জন বেঁচে আছেন। তারা হলেন ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, এম আমীর-উল ইসলাম ও আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী। এই চার জন হয়তো এমন অদ্ভুত কথা শুনে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তবে ওই কমিটির সদস্যদের পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ভারতে বাংলাদেশের সংবিধান জন্মের ‘নয়া তথ্যে’ তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে তারা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশের মাটিতেই রচনা করা হয়েছে।’ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শনকে ধারণ করে লাখো শহীদের রক্তে লিখিত বাংলাদেশের সংবিধান। খসড়া কমিটির সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করে জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে রচনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান।’
ইতিহাস কী বলছে?
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হলেও এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘ যাত্রা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাংলাদেশের সংবিধানও তেমনি বাংলাদেশের সংবিধান অন্য কোনো দেশের তৈরি করা নয়। এমন কী অন্য কোনো কোনো দেশের সংবিধান থেকে কিছু অনুচ্ছেদ ধার করে তৈরি করা কোনো ডকুমেন্ট নয়। বরং সংবিধানের প্রতিটি বাক্য, শব্দ, সেমিকোলন নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকা’ তথা নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র হওয়ার ঘোষণা দেওয়ারও দুই মাস আগেই সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদেরকে নৌকা আকৃতির মঞ্চে বসিয়ে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। শপথ পড়ান স্বয়ং শেখ মুজিব।
মূলত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ীরাই যে পাকিস্তানের দুই অংশের বৈধ প্রতিনিধি এবং তারাই যে গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান প্রণয়ন করবেন, সেটির সূচনা হয় এই রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধু এই সভার মাধ্যমে জান্তার দিকে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, তিনি এবং আওয়ামী লীগই জনগণের নির্বাচিত ও বৈধ একমাত্র প্রতিনিধি। (জালাল ফিরোজ, বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ সংবিধান, বাংলা একাডেমি/২০২০, পৃষ্ঠা ১৩)।
এর কিছুদিন পরে ১৬ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পরিষদের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে সংসদীয় দলের নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচন করা হয়। এদিন নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংবিধান (পাকিস্তানের জন্য) রচনার জন্য আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল একটি সাব-কমিটি গঠন করে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন এই কমিটির একজন সদস্য। তিনি লিখেছেন: ‘ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের দ্বিতীয় দফা ও শেষ প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা। পহেলা মার্চ সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে রচনাকারী কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া সংবিধান পেশ করা হয়। এই বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সরফরাজসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। আমার প্রণীত খসড়া সংবিধান কমিটির অনুমোদন লাভ করে। এই ব্যাপারে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সংসদীয় দলের ওপর ন্যস্ত করেন।’ (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশন/১৯৯১, পৃষ্ঠা ১২)।
কেন ভারতের প্রসঙ্গ?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলে তাজউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য ভারতে চলে যান। ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এক সপ্তাহ পরে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (ওইদিন থেকে যেটির নাম হয় ‘মুজিবনগর’) এই সরকারের শপথ গ্রহণের দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। আর এই ঘোষণাপত্রই ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তি ধরা হয় যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে, সেটি ভারতে বসেই লিখিত হয়েছে। আমীর-উল ইসলাম তার আত্মকথায় লিখেছেন: ‘আমি ও তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোনো বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো কপি। আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। এ অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম কী কী প্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনই চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘোষণায় অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সকলে এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। তিনি বললেন এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন। যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্য সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফ-এর মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। বললাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তার বাসা। আমার পরিচয় ‘‘রহমত আলী’’ নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাঁকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কি না জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিই। তিনি বলেন, “একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবারও কোনো প্রয়োজন নেই”।’ (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতে অবস্থান করা তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের বাকি নেতা ও গণপরিষদ সদস্যরা বাংলাদেশে চলে আসেন এবং সংবিধান প্রণয়নের যাবতীয় কাজ এখানে বসেই সম্পন্ন হয়। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ভারতে বসে রচনা করার বিকল্পও ছিল না। আবার সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই যেহেতু যুদ্ধের সময় ভারতে ছিলেন, অতএব সেখানে বসে ভবিষ্যৎ সংবিধান নিয়ে আলাপ-আলোচনা এমনকি এর কাঠামো কী হবে— তা নিয়ে শলাপরামর্শও অস্বাভাবিক ছিল না। তাতেও কি এটা প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের সংবিধানের জন্ম ভারতে? ভারতে বসে যদি এর খসড়া তৈরি করা হয় বা কাঠামো ঠিক করাও হয়, সেই কাজটি করেছেন বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই— জনগণ যাদেরকে এই ম্যান্ডেট দিয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে।
সংবিধানের খসড়া হয়েছে কোথায়?
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরদিন ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন। আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে ঊদ্ধৃত করে ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সংস্থা এনার খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং এর চূড়ান্ত রূপ দিতে বেশি সময় লাগবে না। শাসনতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হবে বলেও জানান আইনমন্ত্রী। (দৈনিক বাংলা, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২)।
এর ১০ দিন পরে ২৯ জানুয়ারি ‘বিশ্বস্ত’ সূত্রের বরাত দিয়ে এনার খবরে বলা হয়, খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সমাপ্ত। এক এক মাসের মধ্যেই গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন ডাকার সম্ভাবনা। খসড়া শাসনতন্ত্রের মুখবন্ধে বলা হয়েছে: গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মৌলনীতির ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে এই দেশকে গড়ে তোলা হবে। (দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২)।
ড. কামাল হোসেনের এই বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, গণপরিষদের বৈঠক শুরু এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠনের আগেই সংবিধানের একটা প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়— যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু না হয়ে গেলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় এপ্রিলে খসড়া প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে। এর আগে ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করা হয়। এই আদেশ অনুসারে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিতদের নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হয়—যাদের ওপর বাংলাদেশের সংবিধান রচনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
গণপরিষদে কী হয়েছে?
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের বৈঠক বসে এবং পরদিন ১১ এপ্রিল গঠিত হয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। কমিটির জন্য ৩৪ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করেন মুনসুর আলী, যেখানে বলা হয় ড. কামাল হোসেন এই কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। স্পিকার (মুহম্মদুল্লাহ) প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। ৩৪ সদস্যের এই কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, এম আমীর-উল ইসলাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য ছিলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান আর একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নাতনি রাজিয়া বানু।
সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কমিটির বৈঠক বসে একাদিক্রমে ১৭ থেকে ২৯ এপ্রিল, ১০ থেকে ২৫ মে, ৩ থেকে ১০ জুন, ১০ অগাস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর। মোট ৮৫ দিন। তৃতীয় দফার বৈঠকে অর্থাৎ ১০ জুন সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া অনুমোদিত হয়। পূর্ণাঙ্গ মানে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। তারপরে বাকি রয়ে যায় ইংরেজি ভাষ্যের আইনগত দিক এবং বাংলা ভাষ্যের ভাষাগত দিকের উন্নতিসাধন। (বাংলাদেশের সংবিধান নানা প্রসঙ্গ, আহেমদ জাভেদ সম্পাদিত, অন্যপ্রকাশ/২০২০, পৃষ্ঠা ১১৬)।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে গণপরিষদের বাইরে থেকে নানা ধরনের পরামর্শ-সংবলিত ৯৮টি স্মারকলিপি আসে। সদস্যদের বিবেচনার জন্য এগুলো বিলি করা হয়েছিল।
১২ অক্টোবর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ১৫৩টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত ৭২ পৃষ্ঠার খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদের সামনে পেশ করেন। ১৯ অক্টোবর বিলের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয় যা চলে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। গণপরিষদের ৪৫ জন সদস্য খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনা করেন।
খসড়া বিলের ওপর আলোচনা শেষে পরিষদে মোট ১৩৫টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যরা সংশোধনী আনেন ৮৩টি। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনার জন্য ৩৩ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের সবগুলো সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও এসব সংশোধনী ছিল প্রধানত শব্দ ও ভাষাগত অসঙ্গতি। কমিটির ৬ জন সদস্য খসড়া সংবিধানের ওপর নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতসূচক মন্তব্য দেন। (আমীন আল রশীদ, সংবিধান প্রণেতাগণ, শিলালিপি/২০২৪, পৃ. ৩১)।
৪ নভেম্বর খসড়া সংবিধানের তৃতীয় ও চতুর্থ পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। এদিন দুপুরে তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের সদস্যগণ হাতে লেখা সংবিধানের কপিতে স্বাক্ষর করেন। সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।
সংক্ষেপে এই হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাস। অতএব এই সংবিধানটির জন্ম ভারতে বা ভারতে বসে এই সংবিধান রচনা করা হয়েছে সেটি বলার সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক যে, সংবিধান প্রণয়নের আনুষ্ঠানিকতা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে গণপরিষদে বসে সম্পন্ন হলেও যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণপরিষদ সদস্যদের অনেকেই, বিশেষ করে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে ছিলেন, ফলে সেখানে বসেই তারা সম্ভাব্য সংবিধানের নানা বিষয়ে শলাপরামর্শ করেছেন।
আরও পড়ুন:
৭২ এর সংবিধান নিয়ে জামায়াতের অবস্থান, যা জানা গেল
সংবিধানের ১১৮ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদে যা আছে
সংবিধান সংশোধন হতে হবে নির্বাচিতদের দিয়ে: নজরুল
শাহদীন মালিকের বদলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রিয়াজ