চিন্তার মনোকালচার সযত্নে অভ্যাস করার ফলে ভাবনাবিহীন বহু সাধারণ লোকও ‘ক্ষমতা’র যন্ত্র হিসেবে স্বেচ্ছায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
Published : 01 Nov 2022, 08:07 PM
সভা-সমাবেশ করা যেকোনও রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা নিজেদের দল ছাড়া কখনও অন্য সংগঠনের সভা-সমাবেশ বা প্রতিবাদ কর্মসূচিকে সহ্য করতে চায় না।
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয় থেকে গত কয়েক মাস ধরে সক্রিয় হয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সভা-সমাবেশ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এসব সভা-সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করতে সব রকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর আগে বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতিই দেওয়া হতো না। যদিওবা দেওয়া হতো, সেসব সমাবেশ ঘিরে স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক বাধার মুখে পড়ত বিএনপি। এমনকি কিছু কিছু স্থানে ১৪৪ ধারাও জারি করতে হয়েছে। এখন একদিকে যেমন বিরোধী এই রাজনৈতিক দলটিকে সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, একইসঙ্গে যানবাহন বন্ধ করে সমাবেশে যোগদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রশাসন থেকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলেও যানবাহন বন্ধ করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ ও রংপুরের সমাবেশকে সামনে রেখে ঘোষিত ও অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। কোথাও ঘোষণা দিয়ে, কোথাও বা অঘোষিত এসব পরিবহন ধর্মঘটে মারাত্মক বিড়ম্বনায় পড়েন যাত্রীরা। সমাবেশের আগে ধর্মঘটের কারণে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনও বিকার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
পরিবহন খাতের নেতারা বলছেন, নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকায় যান চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে তাদের। গাড়ি ভাঙচুর হলে কি বিএনপি ক্ষতিপূরণ দিবে- এমন প্রশ্ন তাদের। যদিও ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টিকে কারো কাছেই বড় বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমাবেশের সময় গণপরিবহন বন্ধ রাখা হলেও হরতাল ডাকলে গণপরিবহন চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। হরতালে গাড়ি ভাঙচুরের ঝুঁকি বেশি থাকে। তখন যদি গাড়ি চালানো হয়, তাহলে গণসমাবেশের আগে কেন গাড়ি বন্ধ রাখা হয়? বোঝাই যায় নিরাপত্তার ইস্যুটি অজুহাত মাত্র।
আসলে গণপরিবহন চালু বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক। কারণ বাংলাদেশের পরিবহন মালিকদের সংগঠনগুলো সবসময়ই সরকার নিয়ন্ত্রিত থাকে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে নেতৃত্বও সেই দলের নেতাদের হাতে থাকে। তারা সব সময়ই চান বিরোধী দলকে বিপদে ফেলতে, তাদের কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে। বিএনপির আমলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। আর এখন জাতীয় পার্টির নেতা মশিউর রহমান রাঁঙ্গা। বিরোধীদের আন্দোলন বা সমাবেশ দমাতে গণপরিবহণ বন্ধ বিএনপির আমলেও করা হয়েছে। এমনকি তখন আওয়ামী লীগের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে সড়ক, নৌপথে গণপরিবহণ বন্ধ করে সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যে সব অপকর্ম করেছে, এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে সেসব ‘অপকর্ম’ই যদি ফিরিয়ে দেয়- তাহলে সেটিকে কি সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার নমুনা বলা যাবে? তাহলে আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্য কোথায়? বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের এত মাথাব্যথা কেন? সভা-সমাবেশের মাধ্যমে কখনও কি ক্ষমতা পরিবর্তন হয়? রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া যায়?
একথা ঠিক যে, আমাদের দেশে রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক বা নিয়মতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয় না। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতায় যাবার জন্য, ক্ষমতাসীনদের বেকায়দায় ফেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও নাশকতার আশ্রয় নেয়। সরকারকে তাই বিরোধীদলের ব্যাপারে সব সময়ই বাড়তি সচেতনতা দেখাতে হয়। সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। কিন্তু কেউ ষড়যন্ত্র বা নাশকতা করলে তার বিরুদ্ধে প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিল ও আইনের আওতায় আনার সুযোগ আছে। তা না করে কেবল বায়বীয় অভিযোগের ভিত্তিতে দমন-পীড়ন নির্যাতন রাজনীতিকে কলুষিত করে। সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও ঘৃণা। এমনকি ‘দেখে নেওয়ার’ উগ্র বাসনাও তাতে জন্ম হয়।
এমনিতেই আমাদের দেশে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং ঘৃণার রাজনীতি জারি আছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, ক্ষমতাসীনরা গায়ের জোরে তাদের দমন করতে পুলিশ-প্রশাসন ও আদালতকে ব্যবহার করছে। আর ক্ষমতাসীনরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, পুলিশ-প্রশাসন-আইন-আদালত সব কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে।
মুখে যাই বলুক, আসলে বর্তমানে দেশে কোনো কিছুই ঠিকঠাকমতো চলছে না। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের কারও কারও আচরণকে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। সমালোচনা বা ভিন্নমত দেখলেই তেড়েফুড়ে উঠছেন এদের কেউ কেউ। হয়রানি আর প্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই চুপ হয়ে গেছেন। এর প্রভাব পড়ছে বৃহত্তর সমাজে।
আমাদের অভ্যাস কিংবা সামাজিক সংস্কৃতিতেও এখন স্বাভাবিক ‘ভিন্নতা’ বা অন্য মত সহ্য না করার প্রবণতা বেড়ে উঠেছে। কৃষি ব্যবস্থা থেকে প্রণয় সম্ভাষণ- বহুত্বের বৈচিত্র্যময়, প্রাণবান সৌন্দর্যের জায়গা নিতে শুরু করেছে ‘একমাত্র’। বিকল্প ভাবনার সৃষ্টিশীল পরিসর ভাগ করা নয়, ‘সমস্তটা’ই দখল করার ভাবনা। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র পর্যন্ত এই ‘কাউকে জায়গা না ছাড়া’র মনোবৃত্তি প্রায় একটা যান্ত্রিক অভ্যাসের ভয়ালরূপ ধরেছে।
এই ব্যাধি অভ্যাস করা হয়েছে অবশ্য গত কয়েক দশক ধরে। নিতান্ত শিশুকাল থেকে ‘শুধু তোমার, আর কারও নয়’ ভাবনাকে প্রায় স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে টিকে থাকার এবং টু-পাইস কামানোর জন্য এখন সকলেই চায় সাংগঠনিক ক্ষমতা। আরও ক্ষমতা। একচ্ছত্র ক্ষমতা। ‘যত মত তত পথে’র দেশে আজকে ‘অন্য মত’-কে মনে হচ্ছে স্পর্ধা। আর স্পর্ধাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
‘অন্য মত’-কে বলদর্পে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা এর আগেও অনেক বার ঘটেছে। একচ্ছত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রীয় শাসকরা এই কণ্ঠরোধের চেষ্টা, ‘আদার’ বা ‘অন্য’-কে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার চেষ্টা বহু বার করেছে এবং ইতিহাস সাক্ষী যে তাদের সকলের নাম হিটলার বা আইয়ুব খান নয়। কিন্তু গত কয়েক দশকে কেবল রাষ্ট্রীয় শাসকের বদলে এই অসহিষ্ণুতা, এই অধৈর্য বিকেন্দ্রায়িত হয়ে গিয়েছে। সমাজের নানা স্তরে অসহিষ্ণুতার ক্রোধ ও হিংসা প্রায় ফসলখেতের মতো ব্যাপ্ত।
চিন্তার মনোকালচার সযত্নে অভ্যাস করার ফলে ভাবনাবিহীন বহু সাধারণ লোকও ‘ক্ষমতা’র যন্ত্র হিসেবে স্বেচ্ছায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের মনে মনে কোথাও সমস্ত মানুষ ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি মাত্র অবস্থানে- হয় তুমি আমার পিছনে নয় তো আমার মুখোমুখি। যে কোনও অন্য মতকেই মনে হচ্ছে বিরোধিতা এবং যে কোনও বিরোধিতাই ধ্বংসযোগ্য। অথচ প্রকৃতির নিয়ম এমন নয়। বৈচিত্র্যই প্রকৃতির শক্তি। অসংখ্য বৈচিত্র্যের বিপুল সহাবস্থানের কারণেই নানা প্রতিকূল অবস্থায়ও প্রকৃতি টিকে থাকে। মানুষ প্রকৃতিরই এক সংস্থান, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী কোনও অবস্থানে সে রক্ষা পাবে না।
দীর্ঘকাল গড়ে ওঠা একটি সঙ্কটের চূড়ান্ত মুহূর্তে দাঁড়িয়ে চটজলদি কোনও ক্ষোভপ্রকাশ বা দোষারোপে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার গোড়া যতটা গভীরে প্রসারিত, ততখানি গভীরেই ধৈর্য ধরে, সচেতন চিন্তা নিয়ে নিরাময় চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব।
দার্শনিক সক্রেটিস হেমলক বিষ পান করার আগে বলেছিলেন, “আমি চললাম মৃত্যুর দিকে। আপনারা চলুন জীবনের পথে।” প্রশ্ন থেকে গিয়েছে, সক্রেটিস কি মৃত্যুর পথেই হেঁটেছিলেন? না কি যারা তার মৃত্যুদণ্ড দিতে তৎপর ছিলেন, তারাই আসলে জীবন থেকে বিচ্যুত ছিলেন?
সক্রেটিসকে যখন জেরা করা হচ্ছিল, তখন মিলেটাস তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন, সক্রেটিস যুবকদের বিপথগামী করছেন। প্লেটো তার ‘অ্যাপোলজি’ গ্রন্থে মিলেটাসের সঙ্গে সক্রেটিসের কথোপকথনের যে নমুনা দিয়েছেন, তাতে আছে, মিলেটাস বলছেন যুবকদের সঠিক পথ চালাতে পারে আইন। সক্রেটিস জিজ্ঞাসা করছেন, আইন ব্যবহারকারী মানুষটি কে? মিলেটাস বলছেন, উপস্থিত শ্রদ্ধেয় জুরিরা। যুবকদের পথনির্দেশক সিনেটের সভ্যরা। পরিষদের সকল সভ্য।
তখন সক্রেটিস বলেন, মিলেটাস, তোমার কথা অনুসারে আমিই যুবকদের অকল্যাণ করি। আর এথেন্সের সকলে উন্নতির পক্ষে। মিলেটাস: এই কথাটিই তো আমি বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করতে চাই। তখন সক্রেটিস বলেন, তা হলে যুবকদের মহাভাগ্য যে তাদের অপকার করার লোক আমি একা। আর সমাজের সকলেই তাদের উপকার করতে চাইছেন। তা হলে আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কীসের?
আজ থেকে কত কত বছর আগে সক্রেটিস এসেছিলেন। খ্রিস্টের জন্মের ৪৭০ বছর আগে। আর আজও প্রতিটি সমাজের কোণে কোণে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে।
সক্রেটিসের মতো বলতে হয়, সমাজের সবাই যদি কল্যাণ এবং সঠিক পথে থাকেন, তাহলে দু-চারজন ভিন্ন মতাবলম্বীকে কেন শায়েস্তা করতে হবে? শক্তি ও ধমক দিয়ে দমাতে হবে?