নানারকম পরীক্ষা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যারা সরকারি চাকরি জোটাতে পারেন, তাদেরও একটা বড় অংশ দিন শেষে বেনজীর, মতিউর, জাহাঙ্গীর কিংবা আবেদ আলীতে পরিণত হন।সুতরাং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার যেমন প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার।
Published : 17 Jul 2024, 04:37 PM
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে রোববার বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে যাকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন: “আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না।”
প্রধানমন্ত্রী তার নাম না বললেও সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার কিছু সময় পরেই একাধিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই পিয়ন বা ব্যক্তিগত সহকারীর নাম জাহাঙ্গীর আলম— যিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে পরিচিতি। নানাবিধ অভিযোগে তাকে ২০২৩ সালে চাকরিচ্যুত করে গণভবন থেকে বের করে দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের দিনই জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এরপরই জানা যায় যে, জাহাঙ্গীর আলম দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন।
জাহাঙ্গীরের বড় ভাই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই সংবাদ সম্মেলনের সময়ও জাহাঙ্গীর দেশে ছিলেন। কিন্তু এরপরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বসবাস করেন।
জাহাঙ্গীরের আগে একইভাবে সমালোচনার মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া যাদের নাম গণমাধ্যমে এসেছে, এরকম আরও অনেকেই দেশে ছেড়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
এসব ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে, দুর্নীতিবাজদের পাসপোর্টে তাদের পছন্দের দেশের ভিসা লাগানোই থাকে। আর প্লেনের টিকিট কাটা এখন মুহূর্তের ব্যাপার। অনলাইনে মোবাইল ফোনেই টিকিট কাটা সম্ভব। তার মানে দুর্নীতিবাজদের মনে সব সময় একটা ভয় থাকে এবং তারা সব সময় পালানোর জন্য প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন জনমনে আছে। যেমন:
১. এসব লোক কী করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান? রাষ্ট্রের এত গোয়েন্দা বাহিনী, এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি, রাষ্ট্রযন্ত্রে এতগুলো চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কী করে নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন? নাকি এই দুর্নীতিবাজদের নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যেতে সহায়তা করেন তাদের মতোই দুর্নীতিবাজরা? সুতরাং যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এইসব জাহাঙ্গীর-মতিউর-বেনজীরদের সৃষ্টি হয় এবং যারা প্রজাতন্ত্রের কোনো পদে থেকে শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান, সেই প্রশ্রয়দাতা এবং তাদেরকে নিরাপদে দেশ ছাড়তে সহায়তাকারীদের নামও কি আসবে? তাদেরকেও কি ধরা হবে নাকি নাম আসার পরে তারাও একইভাবে দেশ ছাড়বেন? তাদেরও কি পাসপোর্টে ভিসা লাগানো আছে?
২. যেসব দুর্নীতিবাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হলো, সেসব অ্যাকাউন্টে কি আদৌ কোনো টাকা আছে? কেননা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও তারা অ্যাকাউন্টে টাকা রাখবেন, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, যারা দুর্নীতির মাধ্যমে শত বা হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেন, তারা নিজের নামে দেশের ব্যাংকে অনেক টাকা রাখবেন— এতটা বোকা তারা নিশ্চয়ই নন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে এটা জানানো উচিত যে, এখন পর্যন্ত যেসব দুর্নীতিবাজের অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তাদের অ্যাকাউন্টে আসলেই কত টাকা আছে? যেমন প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের দিন রাতেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন জাহাঙ্গীর আলম। যে লোক নিজের পিঠ বাঁচাতে এত দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন— তার অ্যাকাউন্টে শত শত কোটি টাকা থাকবে— সেটি ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
একইভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের ১১৬টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আদেশ দিয়েছে আদালত। প্রশ্ন হলো, এই ১১৬৬ টি অ্যাকাউন্ট আদৌ কোনো টাকা আছে বা থাকলে তার পরিমাণ কত? প্রশ্ন ফাঁসে অভিযুক্ত আবেদ আলীসহ আরও ১১ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএফআইইউ। তাদের অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে?
৩. দুর্নীতিবাজ হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সম্প্রতি কতজনের নিজের, স্ত্রীর এবং সন্তানদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কত টাকা তোলা হয়েছে? একসঙ্গে সকল দুর্নীতিবাজ যদি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে ফেলেন, তাহলে এটি ব্যাংকিং খ্যাতে কী প্রভাব পড়বে বা এরই মধ্যে কী প্রভাব পড়েছে— সেটিও অনুসন্ধানের বিষয়।
৪. দুর্নীতিবাজ হিসেবে নাম আসতে পারে— সরকারের এমন শীর্ষ ব্যক্তি; বেশি দুর্নীতি হয় বলে পরিচিত প্রতিষ্ঠান যেমন পুলিশ, কাস্টমস, রাজস্ব বোর্ড, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক, ভূমি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, তিতাসসহ এরকম নাগরিক সেবার সঙ্গে যুক্ত এবং হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প রয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি, প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক এমনকি থানার ওসি এবং সারা দেশের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেনটেশন অফিসারদের (পিআইও) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা, সরিয়ে ফেলা কিংবা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের অ্যাকাউন্টে লেনদেন বেড়ে যাওয়া অথবা উত্তোলনের পরিমাণ বেড়েছে কি না— সেটিও জানানো দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই তথ্য না জানালেও সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে এগুলো বের করতে পারেন।
পরিশেষে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছে এবং যে আন্দোলনে এরই মধ্যে কিছু দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। বাস্তবতা হলো, দেশের যে বিপুল জনগোষ্ঠী এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যোগ্যতা রাখেন এমন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর যে সংখ্যা, সেই তুলনায় সরকারির চাকরির বাজার খুবই ছোট। বরং অধিকাংশকেই বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো কাজ করতে হয়। অনেককে বিদেশে চলে যেতে হয়। অনেককে বছরের পর বছর বেকার থাকতে হয়। কিন্তু নানারকম পরীক্ষা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যারা সরকারি চাকরি জোটাতে পারেন, তাদেরও একটা বড় অংশ দিন শেষে বেনজীর, মতিউর, জাহাঙ্গীর কিংবা আবেদ আলীতে পরিণত হন। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা একটি অবাস্তব। সুতরাং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার যেমন প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার।
একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কী করে শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারেন? শুধু নাগরিককে সেবা দিয়ে দুই চার হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে শত কোটি টাকার মালিক হওয়া সম্ভব নয়। বরং শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হতে গেলে তাকে শুধু চুরি নয়, বরং রাহাজানি করতে হয়। সরকারি কর্মচারীরা রাষ্ট্রের অগণিত চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে এই ধরনের রাহাজানি করতে পারেন? রাষ্ট্রের কোন দুর্বলতায়? সেই দুর্বলতা চিহ্নিত করা এখন প্রধান কাজ। এটি করা গেলে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে যে জটিলতা— সেটিরও অবসান হবে।