‘নারী নেতৃত্ব হারাম’—এটা প্রজ্ঞাহীন, কোরান, রসূল (স.) ইতিহাস ও নারীবিরোধী দাবি। নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরুষতন্ত্র চিরকাল অত্যন্ত ধূর্ততা, নিষ্ঠুরতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে প্রথা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্য, আইন, ধর্মরাষ্ট্র ও ধর্মকে।
Published : 21 Jun 2023, 08:03 PM
গত ১৬ জুন জার্মানির ‘ডয়চে ভেলে’ প্রচারিত ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ টকশোতে “জামায়াতে ইসলামী ও আসন্ন নির্বাচন” অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের৷ তিনি একজন সাবেক সংসদ সদস্যও। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে নারী নেতৃত্ব হারাম কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রে নারীরা সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ইত্যাদি হতে পারবেন কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। দেশের বৃহত্তম ইসলামী দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির হিসেবে তাঁর বক্তব্য গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে বিষয়টা নতুন কিছু নয়, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে এক ইসলামী দল লিখিত স্মারকলিপি দিয়েছিল যেন সাংবিধানিকভাবে নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। চলুন আমরা দেখে নিই এ ব্যাপারে ১. বিশ্ববরেণ্য আলেমরা কী বলছেন, ২. ইতিহাসের শিক্ষা কী, ৩. সংশ্লিষ্ট শারিয়া আইন, ৪. কোরান ও ৫. হাদিস কী বলে।
১. বিশ্ববরেণ্য আলেমরা কী বলছেন?
(১-ক) বাংলাদেশের আলেমদের মাথার তাজ প্রয়াত শাহ্ আব্দুল হান্নান জাতিকে জানাচ্ছেন তাঁর ভাষায় ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ আলেম’ ও ‘আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন অব ইসলামিক স্কলারস’-এর সভাপতি ড. ইউসুফ আল কারজাবি’র ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা, তত্ত্ব ও প্রয়োগ বই থেকে (পৃ: ২১৭-২৪১), “বহুদলীয় গণতন্ত্র ইসলামসম্মত। তিনি মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের সব যুক্তি খণ্ডন করে বলেছেন, যে তাঁরা আধুনিক গণতন্ত্রের সব পদেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।”— দৈনিক নয়া দিগন্ত, উপসম্পাদকীয় ‘ইউসুফ কারজাবির রাষ্ট্রচিন্তা’, ১০ এপ্রিল ২০১৫।
(১-খ) ভারতবর্ষের বিখ্যাত আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী বলেন, “কোরানে আছে বিলকিস তাঁর সভাসদগণকে বলেন আপনাদের উপস্থিতি ব্যতীত আমি কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না — এই উক্তি থেকে প্রমাণিত হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি শাসনতন্ত্র অনুসারেই হোক বা বিলকিসের স্বাভাবিক অনুসৃত রীতি অনুসারেই হোক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুরূপই ছিল। বিলকিসের মুসলমান হবার পর তাঁর রাষ্ট্রাধিকার কেড়ে নেবার কোনো প্রমাণ নেই বরং তাঁর রাজ্য যে আগের মতোই বহাল ছিল ইতিহাসে তা যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিলকিসের রাজত্বে ও রাজ্যশাসন পদ্ধতির প্রতি কোরানে কোনরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন জ্ঞাপন করা হয়নি। সুতরাং বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মহিলার নেতৃত্ব চলতে পারে”— দৈনিক আজাদ, ২২ অক্টবর ১৯৬৪। সার্চ, ‘রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ — ১০ জন আলিমের বিবৃতি’।
২. ইতিহাসের শিক্ষা কী?
“বর্তমানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেগম বেনজির ভুট্টো ও বেগম সুকর্ণপুত্রী। ইতিহাসে মুসলিম খেলাফতে খলিফারা কী করেছিলেন? উদ্ধৃতি, ‘ডক্টর মার্নিসির এই শ্বাসরুদ্ধকর অনুসন্ধানটি দুর্বার আঘাত হানিয়াছে পশ্চিম বিশ্বের ‘ইসলামে মুসলিম নারীরা চির অবহেলিত’ এই বয়ানকে এবং নারীনেতৃত্ব-বিরোধী ইসলামী মৌলবাদকে”— আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট। উদাহরণ দিচ্ছি সেই বই থেকে, বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ড. ফাতিমা মার্নিসির ‘দ্য ফরগটেন কুইনস অফ ইসলাম’ (ইসলামের বিস্মৃত রানিরা) পৃষ্ঠা ৯০-৯১।
ইতিহাসের এই ১৭ জন মুসলিম রানিরা কোনো রাজার অলঙ্কার-মার্কা রানি ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সার্বভৌম শাসনক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের অনেকের নামে মাওলানারা মসজিদে খুৎবা দিতেন, তাঁদের কারো কারো নিজের নামে মুদ্রাও ছিল। খলিফারা কেন ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ বয়ানে বিশ্বাস করেননি এবং এই সার্বভৌম রানিদের বিরোধিতা করেননি সেটা নিচে হাদিস অংশে দেয়া হলো।
(২-ক) ভারতবর্ষ, সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা সুলতানা রাজিয়া, ১২৩৬-১২৪০ সাল।
(২-খ) ইরানে রানি তুরকান খাতুন, ১২৫৭-১২৮২, মসজিদে তাঁর নামে খুৎবা।
(২-গ) তুরকান খাতুনের কন্যা পাদিশা খাতুন, নামাঙ্কিত মুদ্রা।
(২-ঘ) ইরানের সিরাজ অঞ্চলে আবশ খাতুন, ১২৫৩-১২৮৭, খুৎবা এবং নামাঙ্কিত মুদ্রা।
(২-ঙ) ইরানের লুরিস্থান অঞ্চলের ১৩৩৯ সালের মুসলিম রানি (নাম জানা নেই)।
(২-চ) রানি তিন্দু, ১৪২২- ১৪৩১, স্থান সম্বন্ধে মতভেদ আছে।
(২-ছ) মালদ্বীপের সুলতানারা খাদিজা, মরিয়ম ও ফাতিমা, ১৩৪৭-১৩৮৮।
(২-জ) ইয়েমেনের রানি আসমা ও রানি আরোয়া, মসজিদে খুৎবা।
(২-ঝ) ১২৫০ সালে মিশরের রানি সাজারাত আল্ দু’র, ১২৫৭-১২৫৯, মুদ্রা ও খুৎবা।
(২-ঞ) মধ্য এশিয়ায় সুলতানা ফাতিমা, ১৬৭৯-১৬৮১।
(২-ট) ইন্দোনেশিয়ায় সুলতানা শাফিয়া, সুলতানা নূর নাকিয়া, সুলতানা জাকিয়া, ও সুলতানা কামালাত শাহ ১৬৪১-১৬৯৯।
৩. সংশ্লিষ্ট শারিয়া আইন
বাংলাদেশের পাঠক যাতে মিলিয়ে দেখতে পারেন সেজন্য দেখাচ্ছি। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ — এর ৩য় খণ্ডের ১৯৭ পৃষ্ঠায় ধারা ৯০০: “রাষ্ট্রপ্রধানের পুরুষ হওয়াও অপরিহার্য শর্ত”। কিন্তু তার পরেই ওটা আর ‘অপরিহার্য’ থাকেনি, বলা হয়েছে — “ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ ফকীহগণ কোন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতির সার্বিক কল্যাণ বিবেচনা করিয়া উক্ত সর্বোচ্চ পদ নারীর জন্য অনুমোদন করিতে পারেন।” অর্থাৎ তাঁদের অনুমোদন ছাড়া নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। কে বা কারা, কবে, কোথায়, কোন অধিকারে ও কিসের ভিত্তিতে এই সুবিশাল সিদ্ধান্ত নিলো এবং সেটা আমরা জনগণ মানবইবা কেন তা অবশ্য বলা হয়নি। ‘নারী-নেতৃত্ব হারাম’ দাবির পরও পাকিস্তান ও বাংলাদেশে তাঁরা নাকি ‘পরিস্থিতির কারণে’ বেনজির ভুট্টো, শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। অর্থাৎ ‘পরিস্থিতির কারণে’ তাঁরা হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করার ক্ষমতা রাখেন।
দেশে অনেক আলেম নিজেদের মধ্যে উন্মত্ত কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা একমত হয়ে ভালো কিছু করবেন, দুনিয়া উল্টে গেলেও সেটা হবে না। কিছু আলেম এই উগ্রতার প্রতিবাদ করেন কিন্তু কাজ হয় না। তাঁদের উচিত অনতিবিলম্বে ‘ওয়াজ মনিটরিং সেল’ গঠন করা। প্রমাণ:
ক) এক মওলানা হেফাজতের প্রয়াত শীর্ষ নেতা সম্পর্কে বলেছেন, নালায়েক, ... এই বয়সেও এত শয়তানী... মারাত্মক শয়তান ...মালাউন ...যুগের শ্রেষ্ঠ দাজ্জাল... কুত্তাও বলবে ‘আমার বাচ্চা বলো না ইজ্জত যাবে’... শুয়োরের বাচ্চা বললে তারাও বড় কষ্ট পাবে”...,
খ) অমুক মাওলানা বলেছেন তমুক আলেমকে “কাছে পেলে ওর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম”,
গ) অমুক আল্লামা বলেছেন তমুক মওলানা “বুড়া শয়তান”,
ঘ) অমুক মওলানা তমুক আলেমকে “জুতা পেটা”করলেন,
ঙ) অমুক মওলানার “ফাঁসি চাই” দাবি করলেন তমুক আলেম,
চ) অমুক হাফেজ বলেছেন তমুক মওলানা “হারামজাদা”—এরকম লম্বা তালিকা।
বাজারে কালো টাকা যেমন সাদা টাকাকে হটিয়ে দেয় তেমনি এইসব উগ্র আলেমরা শান্ত ও ভদ্র আলেমদেরকে বলতে গেলে কোণঠাসা করে রেখেছেন।
৪. কোরান
ওপরে ‘বিশ্ববরেণ্য আলেমরা কি বলছেন?’ অংশের (১-খ) দেখুন।
৫. হাদিস
নারী-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কিছু হাদিস আছে যেমন নবীজী (স.) নাকি বলেছেন, “যখন তোমাদের শাসকবর্গ তোমাদের মন্দ ব্যক্তি হইবে, তোমাদের বিত্তশালীরা কৃপণ হইবে এবং তোমাদের কাজকর্ম নারীদের হাতে ন্যস্ত হইবে — তারা যেভাবে ইচ্ছা কাজ করিবে, তখন তোমাদের বসবাসের জন্য ভূপৃষ্ঠ অপেক্ষা ভূগর্ভই শ্রেয় হইবে”, মাওলানা মুহিউদ্দীন অনূদিত বাংলা কোরানের ব্যাখ্যার অংশ, পৃষ্ঠা ১২২০। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নাম-ধাম ঘটনার বিবরণসহ হাদিস আমি বুখারীতে পেয়েছি মাত্র একটি, মাত্র একজন সাহাবীর বলা এবং রাসূলের (স.) মৃত্যুর সুদীর্ঘ ২৪ বছর পরে বলা। সেটার ব্যবচ্ছেদ করা যাক।
৬৩০ সালে নবীজী (স.) তায়েফ আক্রমণের সময় ঘোষণা করলেন দুর্গ থেকে পালিয়ে এলে ক্রীতদাসেরা মুক্ত হবে। শুনে বালক আবু বাকরা (হজরত আবুবকর রা. নন)সহ অনেক ক্রীতদাস পালিয়ে আসে, দুর্গের পতন হয়। তারপর ছাব্বিশ বছর চলে গেছে, নবীজী (স.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, আবু বাকরা তখন বসরায়। ৬৫৬ সালে জামাল যুদ্ধে হজরত আয়েশা-তালহা-যুবায়েরকে (রা.) পরাজিত করে হজরত আলী (রা.) বিবি আয়েশাকে (র.) সসম্মানে মদিনায় পাঠিয়ে বসরায় এলে আবু বাকরা তাঁকে এই হাদিস শোনান।
“আবু বাকরা বলিয়াছেন, জামাল যুদ্ধের সময় আমি সাহাবীদের সহিত যোগ দিয়া যুদ্ধে প্রায় নামিয়া পড়িয়াছিলাম, কিন্তু নবী (দ.)-এর একটি কথায় আল্লাহ আমাকে বড়ই উপকৃত করিয়াছেন। যখন নবীজী (দ.)-কে বলা হইল যে পারস্যের লোকেরা খসরু’র কন্যার উপর নেতৃত্ব অর্পণ করিয়াছে, তখন তিনি বলিলেন — “নারী-শাসিত জাতি কখনও সফল হইবে না”, সহি বুখারীর ইংরেজি অনুবাদ, ড. মুহসিন খান, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস ৭০৯। বুখারীর ইন্টারনেট ভার্সনে এটা ৯ম খণ্ড হাদিস ২১৯, এছাড়া হাফেজ মো. আবদুল জলিলের সহি বুখারীর বাংলা অনুবাদের হাদিস ২২২ নম্বরেও পাবেন।
তাহলে আমরা পেলাম:
১. এ হাদিস জানার পরও আবু বাকরা “যুদ্ধে প্রায় নামিয়া” পড়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি এ
হাদিস মেনে হযরত আলীর (র.) পক্ষে ও আয়েশা (রা.)-এর বিপক্ষে যুদ্ধ করেননি।
২. এ হাদিস তিনি প্রকাশ করেছেন যুদ্ধে হজরত আয়েশা (রা.) পরাজিত হবার পরে, আগে
নয়।
৩. এ হাদিস তিনি প্রকাশ করেছেন নবীজীর (দঃ) মৃত্যুর সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর।
৪. এ হাদিসে তিনি “বড়ই উপকৃত হয়েছেন”।
৫. এক বর্ণনায় পাওয়া যায় তিনি হজরত আলী (রা.)-কে বলেছেন তিনি নাকি জামাল যুদ্ধের আগে হজরত আয়েশা (রা.)-কে চিঠি লিখে এ হাদিসের কথা জানিয়েছিলেন।
৬. অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজী (স.) বর্ণনা করেছেন অনেক সাহাবীকে, কিন্তু যে হাদিসের সঙ্গে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত মুসলিম নারীদের সম্মান ও অধিকার বাঁধা, সেই অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজী বলেছেন শুধু তাঁকেই, আর কাউকেই নয় এমনকি বিদায় হজের খুৎবাতেও নয়।
এবার হিসেবের কড়ি।
“আমি বড়ই উপকৃত হইয়াছি”। কীভাবে? তিনি কোনো নেতা বা রাজা বাদশা ছিলেন না, কীভাবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বড়ই উপকৃত হলেন? প্রশ্নই ওঠে না।
তিনি নিজে যদি এ হাদিস বিশ্বাস করতেন তাহলে বিবি আয়েশার (রা.) বিপক্ষে হযরত আলীর (র.) পক্ষে যুদ্ধ করতেন, তা তিনি করেননি।
জামাল যুদ্ধে যদি আয়েশা (রা.) জিতে যেতেন তবে কি তিনি এ হাদিস প্রকাশ করতেন? নিশ্চয়ই না, তিনি তো সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছরে কাউকেই এ হাদিস বলেননি।
জামাল যুদ্ধ যদি না হতো তবে তিনি নিশ্চয়ই এ হাদিস বলতেন না, কারণ তিনি সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছরে এ হাদিস বলেননি।
এবারে প্রমাণ।
চিঠিতে হাদিসের কথা জানানোর কথা সত্যি হলে সেটা জেনেও বিবি আয়েশা (রা.) যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি এ হাদিস বিশ্বাস করেননি।
১৯২৪ সালে খেলাফত উচ্ছেদের আগপর্যন্ত পরবর্তী মাওলানারা মুসলিম সুলতানাদের বিরোধিতা তো করেনইনি বরং রানিদের নামে খুৎবা পড়িয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরাও এ হাদিস বিশ্বাস করেননি।
খলিফাদের সমর্থন ছাড়া সুলতানাদের মুদ্রা ও খুৎবা সম্ভব হত না। অর্থাৎ খলিফারাও এ হাদিস বিশ্বাস করেননি।
ইসলামের ইতিহাসে কেউই এ হাদিস কেন বিশ্বাস করেননি? কারণ:
“আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার অপরাধে আবু বাকরাকে শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল - দ্য
ফরগটেন কুইনস অফ ইসলাম”—ড. ফাতিমা মার্নিসি।
বিভিন্ন বয়ানে পাওয়া যায় তিনি এক নিরপরাধ নারীর বিরুদ্ধে অবৈধ যৌনাচারের মিথ্যা অভিযোগ এনেছিলেন যা আদালতে প্রমাণিত হয়। সুরা নূর আয়াত ৪, “যাহারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ-সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাহাদিগকে আশিটি বেত্রাঘাত করিবে এবং কখনও তাহাদের সাক্ষ্য কবুল করিবে না। ইহারাই নাফরমান”।
ওপরের অঙ্কটা আমাদেরকে কী বলছে? বলছে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ এটা প্রজ্ঞাহীন, কোরান, রসূল (স.) ইতিহাস ও নারীবিরোধী দাবি। নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরুষতন্ত্র চিরকাল অত্যন্ত ধূর্ততা, নিষ্ঠুরতা ও সাফল্যের সাথে কাজে লাগিয়েছে প্রথা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্য, আইন, ধর্মরাষ্ট্র ও ধর্মকে।জীবনের বেশিরভাগ বোঝা মা-বোনেরাই বয়েছেন চিরকাল কিন্তু সে অবদানের প্রতিদান তো দূরের কথা স্বীকৃতিটুকুও পাননি। তাছাড়া, প্রতিটি আদেশ-নির্দেশের পেছনে প্রজ্ঞা থাকতে হয়, দেখতে হয় তা দিয়ে জীবনের মঙ্গল হচ্ছে কিনা। প্রজ্ঞাহীন আদেশ-নির্দেশে ইসলামেরও বদনাম হয় এবং মুসলিম সমাজও পিছিয়ে পড়ে।
পুরুষের নেতৃত্বে দুনিয়াটা কী বেহেশত হয়েছে তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।