Published : 03 Jul 2010, 08:56 PM
ফিফা আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার প্রধান আলোচনার দিক হচ্ছে কে জিতবে? যে যাকে সমর্থন করে সেদিন তার জেতার কথা ভেবেই খেলা দেখতে বসে এবং ফলাফল যা হয় তার ওপর পরের দিনের তুমুল আলোচনা, মন ভাল থাকা না থাকা সব নির্ভর করে। ছোট বড় সবাই এখন খেলা নিয়ে মত্ত। এর মধ্যে নিষ্পাপ আনন্দও রয়েছে। সেটা ঘরে ঘরে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ানো দেখে ভালই লাগে। চারিদিকে এত খারাপ অবস্থার মধ্যে একটু আনন্দ পেলে অসুবিধা কী? ধনীরা বিশেষ আয়োজন করে উপভোগ করছেন। বাড়িতে পার্টি চলছে, আর গরিব মানুষ যেখানেই টিভি দেখার সুযোগ ঘটে সেখানেই তার আনন্দ। পত্রিকায় বাড়তি পাতা দিয়ে বিশ্বকাপ খেলার খবর একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়।
টিভিতে বিশ্বকাপ দেখার সময় আমরা শুধু খেলোয়াড়দের দেখি না, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্টেডিয়ামের বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ দর্শকদেরও দেখি। খেলা কেমন হচ্ছে সেটা বুঝতে হলে উপস্থিত দর্শকদের হৈ হুল্লোড় দিয়ে বোঝা যায়। তবে এই দর্শক কারা? এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো এবং সাধারণ মানুষ কতজন আছেন তা দর্শকদের দেখেই তো বোঝা যায়। নিশ্চয়ই যাদের দক্ষিণ আফ্রিকায় প্লেনের টিকেট কেটে যাবার এবং হোটেল ভাড়া করে থাকার ক্ষমতা আছে, তারাই এখানে খেলা উপভোগ(?) করছেন। বিবিসির এক সাংবাদিক কালো এবং গরিব মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে জেনেছেন টিকেট কেটে খেলা দেখার সামর্থ তাদের নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে সাদারাই আনন্দ করছেন। অর্থাৎ দেশ-বিদেশের সাদা এবং ধনীদের পর্যটন ও খেলা দেখা এবং টিভির সামনে বসে গরিবদের দেখা এবং পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দিনভর কথা বলা—এই তো বিশ্বকাপ!
বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে এমন নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা আমার মোটেও উদ্দেশ্য নয়। সবার আনন্দ মাটি করার ইচ্ছাও আমার নাই। কিন্তু কী করবো? বিশ্বকাপ খেলা শুরু হবার কিছু দিনের মধ্যেই আমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নারী সংগঠনের কাছ থেকে কিছু তথ্য পেতে শুরু করলাম, যা আমাকে ভীষণভাবে আহত করলো। আমি জানলাম বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুধু খেলার মাঠ পর্যায়ে হয় নি, হয়েছে বিনোদনের পর্যায়েও। খেলোয়াড় এবং দর্শক সবারই বিনোদন দরকার এবং সে কারণে নারীর প্রয়োজন। নারীকে ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছু তারা ভাবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রাগ সেন্ট্রাল অথরিটি খেলার আগেই হিসাব করে রেখেছিলেন কত পর্যটক হবে এবং কত যৌনকর্মীর দরকার হবে। সে হিসাবে প্রায় ৪ লক্ষ পর্যটকদের (অধিকাংশই পুরুষ) জন্য কম পক্ষে চল্লিশ হাজার যৌনকর্মী আমদানী করা হয়েছে রাশিয়া, কঙ্গো, নাইজেরিয়ার মতো দেশ থেকে। এদের মধ্যে অনেকেই পাচার হয়ে এসেছে। নারী পাচার মূলতঃ বেশ্যাবৃত্তির জন্যে হয় এবং বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ব্যাপক সংখ্যক পুরুষ পর্যটক এবং বিশেষ আনন্দ ও উন্মাদনার সম্ভাবনা থাকলে তো নারী ও শিশু পাচার বেড়ে যায়। এই সব ক্ষেত্রে নারী ভোগ্যপণ্য ছাড়া কিছু না। যদিও অনেকে মনে করে পাচার ঘটে সরবরাহকারী দেশের দারিদ্র ও কাজের প্রয়োজনে। ধনীদের বিলাসী জীবনের এই 'চাহিদা' আছে বলেই সেক্স ইন্ডাস্ট্রি নামক ব্যবসা টিকে আছে এবং মেয়েরা যারা জীবিকার সন্ধানে বাইরে যেতে চায় তারাই এই ফাঁদে পড়ে যায়।
শুধু নারী নয়, পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে অল্পবয়সী ছেলে এবং মেয়ে বা এক কথায় শিশুরাও। আফ্রিকায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, এবং অনেক দরিদ্র শিশুর পরিবার বা মা-বাবা কেউ নেই। তারা সব সময়ই কাজের খোঁজে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া আসা করে। সীমান্ত পাড়ি দেয়। তারা জানে বিশ্বকাপের সময় কাজ পাওয়া যাবে। সেই কাজের খোঁজে এসে যৌন ব্যবসার দালালের খপ্পড়ে পড়ছে অনেক শিশু। একজন শিশু যৌনকর্মের জন্য বিক্রি হয় মাত্র ৩০০ ডলারে! মেয়েদেরকে এই কাজে জড়িত করার আগে দালালের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যায়। ফলে মেয়েদের ফিরে যাবার সুযোগ থাকে না। অল্প বয়সী ছেলেদেরও যৌন কাজে নিয়োগ করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এই তথ্য এখন আর নতুন কিছু নয়।
"
বিশ্বকাপের মতো আনন্দের ঘটনার পেছনে কত নারীর আবমাননা জড়িয়ে আছে ভাবলে আমার এই খেলা দেখতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয়, এখানে খেলোয়াড় এবং দর্শকরা কত নারী এবং শিশুকে নির্যাতন করেছেন। তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ফুটবলের গোল দিলে লাফ দেবো—এমন মনের অবস্থায় আমি আর নেই।
"
পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ২০০৯ সালের জুলাই মাস থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। ফলে পুলিশ কড়া নজর রেখেছে বটে, এর ফলে পাচারের ঘটনা খুব দৃশ্যমান নাও হতে পারে। তবে পাচারকারীরা তাই বলে থেমে থাকে নি, তারা বিশ্বকাপ খেলা শুরু হবার আগে থেকেই নারীদের পাচার করে এনে ঘর ভাড়া করে রেখে দিয়েছে। গত বছর (জুলাই, ২০০৯) দক্ষিণ আফ্রিকায় পুলিশ এবং বেসরকারী সংগঠন মিলে পাচারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াবার রেড লাইট ২০১০ ('Red Light 2010') ক্যাম্পেন করেছিল। কিন্তু তার পরেও শেষ রক্ষা হয়েছে বলে মনে হয় না, কারণ এই বিষয় নিয়ে সর্বশেষ তথ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না।
একই সাথে চলছে কনডমের ব্যবসা। দক্ষিণ আফ্রিকা এইডস-এর দিক থেকে ঝুঁকিপুর্ণ দেশ বলে বাজারে প্রায় এক বিলিয়ন কনডম ছেড়েছে। খোদ ব্রিটেন প্রায় ৪২ মিলিয়ন কনডম সরবরাহ করেছে, কারণ তাদের ভয় হচ্ছে বিশ্বকাপ খেলা শেষ হবার পর ইওরোপে এইডস রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গত ১৪ জুন, ২০১০ তারিখে, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা যখন তুঙ্গে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত মানব পাচার প্রতিবেদন (Trafficking in Persons Report, 2009) প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্তর-২ (Tier 2) তে রাখা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে পাচার বন্ধ করার জন্যে আরও কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই প্রতিবেদনে বিশ্বকাপের সময় নারী ও শিশু পাচারের সম্ভাবনার কথাটি তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বকাপের মতো আনন্দের ঘটনার পেছনে কত নারীর আবমাননা জড়িয়ে আছে ভাবলে আমার এই খেলা দেখতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয়, এখানে খেলোয়াড় এবং দর্শকরা কত নারী এবং শিশুকে নির্যাতন করেছেন। তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ফুটবলের গোল দিলে লাফ দেবো—এমন মনের অবস্থায় আমি আর নেই।
আনন্দের সাথে আমাদের দায়িত্বের কথা যেন ভুলে না যাই।