তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং কোম্পানিগুলোর অপকৌশল

“তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক কোম্পানির ব্যবহারিক অবস্থান একে অপরের বিপরীতে। উভয়ের স্বার্থ রক্ষাও বিপরীতমুখী। সেখানে কোন যুক্তিবলে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবনায় স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবে?” –লিখেছেন আবু নাসের অনীক।

আবু নাসের অনীকআবু নাসের অনীক
Published : 4 August 2022, 01:39 PM
Updated : 4 August 2022, 01:39 PM

তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সরকারি তরফ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যখনই কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ঠিক ওই সময়েই তামাক কোম্পানিগুলোর গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। তারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। সরকার ও নীতিনির্ধারকদেরকে প্রভাবিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রচেষ্টা হলো, গণমাধ্যমে তাদের অনুগত সংবাদকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করা। এর মাধ্যমে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ ও পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নেতিবাচক জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করে।

আইন সংশোধনী প্রস্তাবনাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে তারা জোরেশোরে কয়েকটি বিষয়ে আওয়াজ তুলছে। এর মধ্যে একটি হলো স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। এই বাদ পড়া স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে তামাক কোম্পানি ও তাদের মদদপুষ্ট তথাকথিত তামাকবিরোধী সংগঠন।

তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার সাথে সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থেই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রণয়ন হয়েছে এবং সময়ের দাবিতে ওই আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং তামাক কোম্পানির ব্যবহারিক অবস্থান একে অপরের বিপরীতে। উভয়ের স্বার্থ রক্ষাও বিপরীতমুখী। সেখানে কোন যুক্তিবলে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবনায় স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবে? তাদের স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিবেচিত হবার নুন্যতম কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। অন্তত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগের সাথে।

ব্যাপারটি অনেকটা এমন, চুরি প্রতিরোধে মহল্লায় সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভায় মহল্লার সবাই উপস্থিত, মহল্লায় বসবাসকারী চোরও উপস্থিত। চুরি প্রতিরোধের জন্য নানা পরিকল্পনা উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায় চূড়ান্ত। ওই সময় সভায় উপস্থিত চোরের প্রতিনিধি গলা উঁচু করে বলছে, ‘আপনারা তো সব পথই বন্ধ করে ফেলছেন, একটা পথ তো খুলে রাখুন যাতে আমরা চুরি করাটা অব্যহত রাখতে পারি।’

তামাক কোম্পানিগুলো আবদারটাও আইন সংশোধনীর ক্ষেত্রে এমন; ওনাদেরকে স্টেকহোল্ডার বিবেচনায় নিয়ে কথা শুনতে হবে। তারা প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনীর বিভিন্ন ধারার বিরোধিতা করে প্রস্তাবনা দেওয়ার সুযোগ চায়। যাতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করার জন্য তাদের সুযোগ নিশ্চিত করা হয় এবং প্রস্তাবিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেটা যেন বাধাগ্রস্থ না হয়!!

কী চমৎকার আবদার তামাক কোম্পানিগুলোর! এই আবদারকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য একটা পক্ষ নির্লজ্জভাবে তামাক কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে। এটা তামাক কোম্পানিগুলোর চরম দুঃসাহস। এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত এফসিটিসি-এর আর্টিকেল ৫.৩ ভঙ্গ করে তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে তারা কিছু অনুগত সঙ্গী-সাথীও জোগাড় করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Guidelines for implementation of Article 5.3 এ বলা হয়েছে, ‘The purpose of these guidelines is to ensure that efforts to protect tobacco control from commercial and other vested interests of the tobacco industry are comprehensive and effective. Parties should implement measures in all branches of government that may have an interest in, or the capacity to, affect public health policies with respect to tobacco control (decision FCTC/COP3(7))’.

বাংলাদেশ এফসিটিসিতে অনুস্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। সেই অবস্থান থেকে উল্লেখিত গাইডলাইন অনুসারে, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অথবা তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য যেকোনো ধরনের কৌশলপত্র নির্ধারণে তামাক কোম্পানির মতামত দেবার ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। তাদের মতামত গ্রহণ করার অর্থ, এফসিটিসি-এর আর্টিকেল ৫.৩ এর ধারা ভঙ্গ করা। সঙ্গত কারণেই আমাদের সরকার সেটা করতে পারে না।

অন্যদিকে তামাক কোম্পানির স্বার্থরক্ষাকারী তথাকথিত তামাকবিরোধী কতিপয় সংগঠন কোম্পানির সাথে সুর মিলিয়ে প্রস্তাবিত আইন সংশোধনকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য অযৌক্তিক বিতর্ক উপস্থাপন করছে। তামাক কোম্পানিগুলোর পয়সায় লালিত এই সমস্ত সংগঠন তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা বলে মূলত তামাক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে। এমন শুধু বাংলাদেশেই নয়; বিশ্বব্যাপী কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং প্রকৃত অর্থে যারা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তাদের কাজকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য এ ধরনের সংগঠনের জন্ম তামাক কোম্পানিগুলোই দিয়ে থাকে।

সংশোধিত আইনের খসড়া প্রস্তাবনায় লাইসেন্সিং ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে কোম্পানিগুলোর গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। এটা নতুন বিষয় নয়। ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’-তে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি যখন যুক্ত করা হয় তখনই তাদের অপতৎপরতা শুরু হয় এটা বাতিলের জন্য।

তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম লক্ষ্য এর সহজপ্রাপ্যতা হ্রাস করা। এবং এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমিয়ে আনা। লাইসেন্সিং ব্যবস্থা এই উদ্দেশ্য পূরণে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে সেটি ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হতে তামাক বিক্রেতারা লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা করছে। খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ মানিকগঞ্জ, সিঙ্গাইরের মতো বিভিন্ন পৌরসভা শুরু করেছে গত অর্থবছর থেকেই।

যারা লাইসেন্স গ্রহণ করেছে তারাই বৈধভাবে ব্যবসা করছে। একটি সংবাদপত্রে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির সভাপতির মন্তব্য তুলে ধরেছে এই বিষয়ে। তিনি বলছেন, ‘কেরোসিন বা স্যালাইন বিক্রি করতে যদি পৃথক লাইসেন্স নিতে না হয় তাহলে তামাক বিক্রির জন্য আলাদা লাইসেন্স কেন নিতে হবে?’

আপনারাই বলুন, কেরোসিন বা স্যালাইন কি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? সরকার কি এমন কোনো পরিকল্পনা করেছে যে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্যালাইন আর কেরোসিন মুক্ত করবে? না, এমন কোনো ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করবে এই ঘোষণা বর্তমান সরকারপ্রধান দিয়েছেন। আর সেটি বাস্তবায়নের জন্য এর ব্যবহার কমিয়ে আনা আবশ্যক। আর তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ লাইন্সেসিং ব্যবস্থা।

প্রচার করা হচ্ছে, ১৫ লাখ নিম্নআয়ের খুচরা বিক্রেতা আছে। এই তথ্যের কোনো সত্যতা নেই। বলা হচ্ছে, লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকর হলে এদের জীবন-জীবিকা বন্ধ হয়ে যাবে। কী হাস্যকর যুক্তি! এদের বক্তব্য অনুসারে মনে হয়, বাংলাদেশে ফেরি করে বিক্রি করার একমাত্র পণ্য সিগারেট। এটা ব্যতীত ফেরি করে অন্য কোনো পণ্য বিক্রি করে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে না! লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গত একবছর ধরে চলমান। যারা দ্বৈত লাইসেন্স গ্রহণ না করে তামাক বিক্রি করা ছেড়ে দিয়েছে তাদের কারও জীবন-জীবিকাই বন্ধ হয়ে যায়নি। যেটা হয়েছে সেটা হলো ওই এলাকাগুলোতে সিগারেট বিক্রি কমে গেছে।

সরকারের লক্ষ্যই তো তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রি কমিয়ে আনা। সেজন্যই তো আইন করে এই বিক্রিকে কঠিন করে আনা হচ্ছে যাতে সিগারেট বা অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত বোধ করে। সিগারেটের পরিবর্তে অন্য কিছু বিক্রি করা শুরু করে। তার জন্য তো আর পৃথক লাইসেন্স নেওয়ার কথা বলেনি সরকার।

একটি বহুল প্রচলিত সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার এই খাত থেকে। কিন্তু এটা বলা হলো না, এই ৩০ হাজার কোটি টাকা আয় করতে গিয়ে তামাক ব্যবহারের আর্থিক ক্ষতি বাবদ ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে!

তামাক নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধীত ২০১৩) এর সংশোধনী এখন সময়ের দাবি। সেই দাবির প্রতি সাড়া দিয়েই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুনভাবে আইনে যে সকল সংশোধনী প্রস্তাবনা যুক্ত করেছে তা অত্যন্ত যুগোপযোগী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ইতোমধ্যে এই ধারাগুলো সংযুক্ত হয়েছে। এবং তারা এর সুফলও পাচ্ছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লক্ষ্য তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা না; জনস্বাস্থ্যকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা। আর তামাক কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা; চূড়ান্তভাবে যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।

তামাক কোম্পানিগুলো অনুগতদের দিয়ে আইনের সংশোধন বিষয়ে যে নেতিবাচ প্রচারণা চালাচ্ছে তার উদ্দেশ্যই হলো আইনের নতুন ধারাগুলো যাতে যুক্ত না হয়। কারণ এই ধারাগুলো যুক্ত হলে তামাক কোম্পানির বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। লাইসেন্সিং ধারাটি তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণে এই বিষয়টি নিয়ে তাদের বিরোধিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

আগামী প্রজন্মকে তামাকের সর্বনাশা ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্য সকল নাগরিকের দায়িত্ব তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর প্রস্তাবনাকে সমর্থন করা এবং তামাক কোম্পানির কূটকৌশলকে প্রতিহত করা।