সংবাদে রাজনৈতিক পক্ষপাত, সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিশ্চিতের চেষ্টা, সংবাদের বিষয়বস্তুতে নির্ভুলতার ঘাটতি, সংবাদ লেখা ও সম্পাদনার দুর্বল মান, সংবাদে নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহার না করা, গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক সংবাদ প্রচার এবং প্রচারের স্বার্থে সংবাদকে অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে।
Published : 31 Aug 2024, 06:32 PM
তিন প্রজন্মের তিনটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই লেখাটি। প্রথমটি আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের। ২০০৬ সালের দিককার। আমার গ্রামের বাড়ির এলাকা তথা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কানসাটে পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রিক আন্দোলন নিয়ে দেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যম বেশ উত্তাল। বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। এই আন্দোলোনের অনেককিছু তিনি নিজ কানে শুনতেন ও চোখেও দেখতেন। পরদিন পত্রিকায় ও টেলিভিশন খবর দেখে তার দেখা ও শোনাকে মিলিয়ে নিতেন। দৈনিক পত্রিকা পড়া অভ্যাস তার দীর্ঘ দিনের। তো একদিন বাড়ির বারান্দায় বাবা-ছেলে একটি পত্রিকা ভাগ করে পড়ছি। হঠাৎ কোনো একটি খবরের বিষয় নিয়ে তার খটকা লাগে। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করে তাকে বিষয়টি যতটা সম্ভব সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। এনিয়ে তার সঙ্গে আমার খানিকটা বিতর্কও হয়। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বলেন, “খবরের কাগজে বেরিয়েছে। পত্রিকাওয়ালারা কখনও মিথ্যা খবর ছাপাতে পারে না। পক্ষপাতমূলক কিংবা বেঠিক সংবাদ ছাপানো অসম্ভব।” সেদিন বাবার সঙ্গে আমি আর কথা বাড়াইনি। কারণ পত্রিকার খবরকে তিনি বিশ্বাস করতেন একদম ধ্রুব সত্যের মতো।
গ্রামের বাড়ি গেলে আমি নানান আড্ডায় যোগ দেই এখনও। আর সেই আড্ডাগুলো হয় পাড়ার নাপিতের চুল কাটার ঘর, বাজারের ওষুধের দোকান কিংবা হাটের মোড়ের চায়ের দোকানে। এই দোকানগুলোর প্রায় সব কটিতেই রয়েছে ক্যাবল টেলিভিশন সংযোগ। এখানে মানুষ খবর দেখে। খবর নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করে। দু-এক চা খেয়ে ফিরে যায় বাড়ি কিংবা কাজে। এখানে বসে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ জুড়ার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি সমকালীন মানুষের মানস, চিন্তা-ভাবনা, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা, আনন্দ, সুখ-দুঃখ ও ক্ষোভ ইত্যাদি। সবমিলিয়ে তাদের জীবনের গল্পগুলো জানা ও বোঝার চেষ্টা করি। তো এমনই এক গল্পের ছলে মাঝ বয়সী এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাই, “এই যে আপনি এখানে কয়েক ঘণ্টা বসে আড্ডা দিচ্ছেন, টেলিভিশনে খবর দেখছেন, আবার এনিয়ে তর্ক-বিতর্কও করছেন। কেন? খবরের মাঝে কী পান আপনারা? আপাত অপ্রাসঙ্গিক কিংবা বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তিনি বলেন, “কোন ঘটনাটি মিথ্যা তা বুঝার জন্য।” আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই, “মানে! দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন।” তিনি বলেন, “বেটা, বয়স তো কম হলো না। জীবনে অনেককিছু দেখেছি। অনেককিছু শুনেছি। আমি নিজের চোখে অনেক ঘটনা দেখেছি। বুঝেছি কোনটা, কোনটা বেঠিক। তো সাংবাদিকরা সেই ঘটনার ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে খবর বানিয়েছে যা ঘটে যাওয়া ঘটনাটির পুরোপুরি উল্টো। তারা টাকা খেয়ে এরকম করে হয়তো। এই আমি এখনও খবর দেখি। তবে এর বিন্দুও বিশ্বাস করি না।”
সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, দিনে অন্তত দশ মিনিট পত্রিকায় খবর পড়ে কিংবা টেলিভিশন দেখে এমন কয়জন আছে ক্লাশে। উপস্থিত ছিল প্রায় ৩৫ জনের মতো। তাদের মাঝে হাত তুলেছে মাত্র দুই জন। যারা হাত তুলেনি কারণ হিসেবে জানায়, পত্রিকা পড়া কিংবা টেলিভিশন তাদের জীবনের জন্য তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তাছাড়া জীবনে তো অবসর বলেই কিছু নেই। রাস্তার জ্যাম এবং হাজারও বাধা পেরিয়ে বিশ্ববিদালয়ে আসা, নানান ক্লাস, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া, চাকরির প্রস্তুতি কিংবা বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা সবকিছু নিয়ে দিন পার হয়ে যায়। আর বাকি যেটুকু সময় পায় তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব কিংবা ওটিটিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখে সময় কাটায়।
সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে এই তিন প্রজন্মের অভিজ্ঞাতা ও অনুধাবনের বিষয়টি আমাকে বেশ নাড়া দেয়। প্রাসঙ্গিক গবেষণা পড়ার চেষ্টা করি। বিভিন্ন গবেষণার বরাতে খেয়াল করি সারাবিশ্বে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেদের প্রতি তরুণদের আস্থা কমছে। তবে বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি কেমন তা নিয়ে তেমন লেখাজোকা চোখে পড়েনি। যাহোক, এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সম্প্রতি আমি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের প্রতি আস্থার ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করি। ‘ফ্যাক্টরস অ্যাফেক্টিং ট্রাস্ট ইন নিউজ মিডিয়া অ্যামং ইয়াং পিপল ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রটি ‘ওয়ার্ল্ড অব মিডিয়া’ নামক একটি রাশিয়ান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় বাংলাদেশের তরুণদের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর আস্থা কেমন এবং কোন কোন কারণ এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে হিসেবে কাজ করে তা দেখার চেষ্টা করি আমরা।
গবেষণায় আমরা দেখতে পাই, সামগ্রিকভাবে সংবাদ মাধ্যমের ওপর বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের আস্থার মাত্রা অত্যন্ত কম। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আস্থার মাত্রা আরও কম। শহরাঞ্চলের তরুণরা গ্রামের তরুণদের তুলনায় সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের প্রতি কম আস্থা রাখেন। সামগ্রিকভাবে, সংবাদে রাজনৈতিক পক্ষপাত, সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিশ্চিতের চেষ্টা, সংবাদের বিষয়বস্তুতে নির্ভুলতার ঘাটতি, সংবাদ লেখা ও সম্পাদনার দুর্বল মান, সংবাদে নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহার না করা, গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক সংবাদ প্রচার এবং প্রচারের স্বার্থে সংবাদকে অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে।এই প্রজন্মের যারা একটু-আধটু সংবাদ দেখে তার বেশিরভাগই মুদ্রিত সংবাদপত্রের পরিবর্তে অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে খবর পান। ফেইসবুকের নিউজ ফিড সেক্ষেত্রে একটি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। তবে তারা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে তথ্যের সবচেয়ে কম বিশ্বস্ত উৎস হিসেবে দেখে।
স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, পুরো তথ্য তুলে ধরা, নির্ভুলতা এবং মতামত ও তথ্যের মধ্যকার পার্থক্য আলাদা করার মতো বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা পেশার ওপর আস্থার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আমরা গবেষণায় দেখেছি, দেশের তরুণ প্রজন্ম মনে করে সাংবাদিকগণ স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষ, নির্ভুল ও পেশাদারত্ব বজায় রেখে সংবাদ পরিবেশন করেন না। সংবাদের নির্ভুলতার অভাব বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে তারা বেশি উদ্বিগ্ন। শুধু তাই নয়, তারা মনে করছেন, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা একটি সমস্যা বা ঘটনার পুরোটা বলেন না।
সমাজের অন্যতম এই স্তম্ভের প্রতি আস্থার এই প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক। একইসঙ্গে সংবাদমাধ্যম শিল্পের টিকে থাকার প্রশ্নে একটি বড় বাধা। কেননা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজে অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রবাহ থাকা জরুরি। এখন তরুণ প্রজন্ম যদি সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিশ্বাসই না করে তাহলে সমাজের ভিতটি নড়ে যায়। গণমাধ্যমের কোনো তথ্যই তারা বিশ্বাস করবে না। ফলে সামাজিক বিশ্বাসের মাত্রাও যাবে কমে। এতে করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অন্যায়, অনাচার ও দুর্নীতি কোনোকিছুই তাদের নাড়া দেয় না। ঐকমেত্য পৌঁছাতে পারে না জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে। দানা বাধে না কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলন। অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর মূল লক্ষ্য কিন্তু কেবল জনগণকে তথ্য সরবরাহ করা নয় বরং বিশ্বাযোগ্য ও সঠিক তথ্য দিয়ে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম সংবাদ না কিনলে সংবাদমাধ্যমের অর্থনৈতিক ভিতটিও দুর্বল হতে বাধ্য।আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল গণমাধ্যম কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজে তার প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালন করতে পারে না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের আস্থা কমছেটা কেন? কিংবা কিভাবে এই আস্থা বাড়ানো যায়? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের গবেষণায় আসেনি। কিন্তু আসাটা জরুরি। ভবিষ্যৎ গবেষকগণ নিশ্চয় এটা নিয়ে গবেষণা করবেন। তবে আমি এই আস্থা ফেরানোর প্রশ্নে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই। প্রথমত, সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি– তথ্য-উপাত্ত হাজির করার প্রশ্নে বস্তুনিষ্ঠতা, সঠিক তথ্য উপপস্থান এবং পক্ষপাতহীনতার প্রতি জোর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংবাদ মাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি নতুন করে ভাবতে হবে। তাদের সংবাদ প্রকাশের পর সমাজে এর প্রভাব কী হতে পারে তার দিকে জোর দিতে হবে। তৃতীয়ত, সংবাদ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। কোনটি সংবাদ, কোনটি মতামত, কোনটি তথ্য-উপাত্তভিত্তিক অভিমত-বিশ্লেষণ, কোনটি বিজ্ঞাপন কিংবা বিজ্ঞাপনদাতা কর্তৃক আধেয় তা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। সেক্ষত্রে প্রতিটি আধেয়তে লেবেল সেঁটে দেওয়া যেতে পারে। কোনো সংবাদে বেঠিক তথ্য প্রকাশিত হলে তাৎক্ষণিক ভুল স্বীকার করতে হবে। ফ্যাক্ট চেকিং, তথ্যের বেনামি উৎস ও ভুয়া তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর জোর দিতে হবে। চতুর্থত, সংবাদমাধ্যমগুলোকে নতুন বাণিজ্যিক মডেল নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ বর্তমান যুগে পুরানা বাণিজ্যিক মডেল দিয়ে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই যোগ্য সাংবাদিক নিয়োগ ও সঠিক সাংবাদিকতার চর্চা করা যাবে। পঞ্চমত, পাঠক-দর্শক-শ্রোতার আচরণ বোঝা, আধেয় ও সংবাদ-বাণিজ্য নিয়ে জানা ও উদ্ভাবনার লক্ষ্যে নিজস্ব গবেষণা বিভাগ চালু করতে হবে। আমি জানি, আমার পর্যবেক্ষণ বা পরামর্শই সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদের প্রতি আস্থা ফেরাতে পূর্ণাঙ্গ বটিকা নয়। বরং নিয়ে পেশাগত, বিদ্যায়তনিক ও সামাজিক পর্যায়ে আলোচনা, বিতর্ক ও গবেষণা বাড়াতে হবে।