মানুষের বিবর্তন বা বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষই তার নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছে। আবার প্রয়োজনে ওই কাঠামো ভেঙেও ফেলেছে।
Published : 23 Oct 2024, 05:50 PM
বর্তমানে সারা পৃথিবীব্যাপী চলমান অরাজক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান। সকল রাষ্ট্রই জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে অনেক রাষ্ট্র নিজেরাই দুনিয়ায় বিভিন্ন জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা জোট শুধু অন্যদেশ বা জোটের সঙ্গেই যুদ্ধে লিপ্ত নয় বরং অনেক দেশের অভ্যন্তরেই জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাতে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এমতাবস্থায়, মানবাধিকার রক্ষায় এবং মানুষের সর্বজনীন কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থার সফলতা, ব্যর্থতা এবং এই ব্যবস্থার গন্তব্য নিয়ে আলোচনা জরুরি।
আজ আমরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুনিয়াব্যাপী দেখতে পাচ্ছি, সেটা একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনের সর্বশেষ অবস্থা হলো আজকের এই আধুনিক রাষ্ট্রের স্বরূপ। দুনিয়াজোড়া ১৯৫টি স্বাধীন দেশ ১৯৫ রকমের ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তা তৈরি করেছে। এই ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার ধারণা শক্তিশালী হয়েছে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে। প্রাচীন আমল থেকেই সীমিত আকারে জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবোধ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও, ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং সার্বভৌমত্বের ধারণা শক্তিশালী হয় ১৬৪৮ সালে যখন; ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক চার্চ প্রায় তিনশ বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধের পর একে অপরের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই চুক্তিটি ‘ট্রিটি অব ওয়েস্টফেলিয়া’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল বিষয় হলো, একে অপরের ভূমির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে সংশ্লিষ্ট শাসকশ্রেণি চূড়ান্তভাবে তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবে। রাষ্ট্রে বা ভূখণ্ডে যুদ্ধাবস্থা ছাড়া রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। এক কথায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা হলো চরম এবং চূড়ান্ত। এই ধারণাই রাষ্ট্রের বা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব হিসেবে পরিচিতি পায়।
ইউরোপে সতেরো শতকে আবির্ভূত হওয়া এই জাতীয়তাবাদী ধারণা তারা প্রথমে তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও গ্রহণ ও প্রয়োগ করে। এই তত্ত্বের সফল বাস্তবায়নের চূড়ান্ত রূপ হলো আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির ফলে ইউরোপে ব্যাপকভিত্তিক ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটে। যদিও; মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, দীর্ঘ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, ধর্ম, রীতিনীতি এবং সমষ্টিগত মূল্যবোধ হলো জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধের মূল উপাদান বা ভিত্তি। কিন্তু, ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদে এই উপাদান এবং ভিত্তির চেয়েও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সীমানার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। যদিও অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জাতিগত নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ধর্ম বা সংস্কৃতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার কারণে নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তাসমূহ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নিগ্রহের শিকার হয়েছে, কোথাও আবার চিরতরে বিনাশ হয়েছে। এখনো দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় বিরোধ, জাতিগত বিরোধ, রাষ্ট্রের সীমানা নিয়ে বিরোধসহ নানা বিরোধ চলমান।
ইউরোপে জন্ম নেওয়া এই জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা পরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী নেতারা ধার করে নিয়ে আসেন বা ইউরোপীয়দের প্ররোচনায় স্থানীয়ভাবে এই ধ্যান-ধারণার রাজনৈতিক প্রয়োগ ঘটান। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে অনেকগুলো নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
বর্তমান দুনিয়ায় বা বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেমন শক্তিশালী হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক নতুন উপকরণ যোগ হয়েছে। যেমন আইন, শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি। মানুষ রাষ্ট্র এবং জাতীয়তার ধারণা তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু কিছুকাল পরে মানুষ আবার বুঝতে পেরেছে, শুধু নিজের রাষ্ট্রের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেই তার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। বিভিন্ন কারণেই বিশেষ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিজের সৃষ্টি করা জ্ঞান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে না পারলে কোথায় যেন অপূর্ণতা থেকেই যায়। তাই রাষ্ট্রসমূহ রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকেই অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে।
বর্তমান রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থায় ‘বিশ্বায়ন’ অন্যতম শক্তিশালী তত্ত্ব। এই তত্ত্বটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রয়োগ করেছে মূলত নিজেদের পুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের মাধ্যমে মুনাফাকে সর্বোচ্চভাবে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
যদিও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তথাপিও, এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে গিয়েই বিশ্বব্যাপী এক ধরনের নৃতাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। দুনিয়াব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিকাশের ফলে রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকেই দুনিয়ার একপ্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্যপ্রান্তের মানুষের নিবিড় যোগাযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্র এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে যেমন সাহায্য করছে, ঠিক একইভাবে বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্যপ্রান্তের বা অন্যদেশের মানুষের সম্পর্ক আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, মানুষ নিজের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ অন্যের সঙ্গে শেয়ার করছে। একইভাবে, অন্যদেশের সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, জাতিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও জানতে পারছে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক থাকলেও, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু অপার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। যা নিয়ে নতুন সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যে বিষয়টি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই আলোড়িত করে সেটি হলো, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার ফলে মানুষ একদেশে থেকেও অন্যদেশের মানুষের সঙ্গে নিজের অনুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি শেয়ার করছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাষাগত দূরত্ব বা বোঝাপড়া ঘুচিয়ে দিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আমরা কেউই এক দশক আগেও চিন্তা করতে পারতাম না যে, বাংলাদেশের কোনো এক ধানক্ষেতে বসে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে বান্ধবীর সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে, ভাষাগত বোঝাপড়ার দূরত্ব ঘুচিয়ে পারস্পরিক অনুভূতি প্রকাশ করা যায় বা শেয়ার করা যায়! এই পারস্পরিক আদান-প্রদান অনেকসময় প্রেম বা ভালোবাসায় রূপ নিচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতেই আমেরিকা বা কানাডা বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে এসে পরস্পরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। দুই জাতীয়তার মিলনের ফলে, নতুন সংকর জাতীয়তার জন্ম হচ্ছে। এই ঘটনা নেহায়েত কম নয়। ভিন্ন একটি দেশের মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে নতুন ধরনের সংকরায়ণ সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও, দুনিয়ায় অনেক জায়গাতেই এই সংকরায়ণকে কটু দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। সংরক্ষণবাদীরা এই প্রক্রিয়াকে মেনে নিতে পারছেন না। অনেক দেশেই পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদীরা শক্তিশালী হচ্ছে। যেমন জার্মানি, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি। আবার অনেক দেশ আগে থেকেই জাতিগত সংরক্ষণশীলতা মেনে চলে। এরমধ্যে চীন, জাপান বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অন্যতম।
বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, ‘man is born free but everywhere he is chained’ অর্থাৎ, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্রই সেই শৃঙ্খলিত।’ আবার সমাজবিজ্ঞানী আন্তেনিও গ্রামসি রাষ্ট্রের ধারণা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্র হলো এক ধরনের স্বীকৃতি’। অর্থাৎ, মানুষের জন্মের পরে যখন সে বুঝতে শেখে তখন তাকে রাষ্ট্র, সমাজ, কাঠামো ইত্যাদি বিষয়কে শিখিয়ে দেওয়া হয়। একটা মানুষ যখন দেখতে পায় অন্যসব মানুষ যখন এই ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন সে নিজেও এই ব্যবস্থাকে নিরঙ্কুশভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কি এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই তাদের শেষ শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে মেনে নেবে? নাকি অন্যকোনো ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটাবে? মানুষের বিবর্তন বা বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষই তার নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করেছে। আবার প্রয়োজনেই ওই কাঠামো ভেঙেও ফেলেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘মানুষ শক্তিশালী নাকি কাঠামো বা সিস্টেম বা রাষ্ট্র শক্তিশালী?’ এই প্রশ্নের সহজ এবং সাবলীল উত্তর হলো, নিশ্চিতভাবেই মানুষই বেশি শক্তিশালী। কারণ, রাষ্ট্র বা কাঠামো বা রীতিনীতি মানুষই তৈরি করেছে। কোনো রাষ্ট্রই নিজ থেকে কোনো আইন, নীতি, প্রথা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে না। মানুষ নিজেই এগুলো তৈরি করে রাষ্ট্রের মধ্যে প্রয়োগ করে। এককথায়, রাষ্ট্র হলো এক প্রকার কাঠামোবাদী ধারণার নাম। যার মধ্যে মানুষই বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ যোগ করে। সুতরাং, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, মানুষ ভবিষ্যতে নিজের প্রয়োজনে জুতসই এবং আরও আধুনিক নতুন কোনো ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে।
রাজনৈতিক বাস্তববাদ এবং কাঠামোবাদী ধ্যান-ধারণার জায়গা থেকে রাষ্ট্রকাঠামো বা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে আপনি অনেক বক্তব্যই দিতে পারবেন। অথবা, এই ব্যবস্থা বা মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য অনেক পদক্ষেপই নিতে পারবেন। কিন্তু, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনৈতিক বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবেন, আসলেই তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের কোনো শেষ গন্তব্য নেই।
রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন খুঁজতে আপনাকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। আপনি আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্টের আগ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে তিনবার ভূখণ্ডগত বিবর্তন ঘটেছে। একইসঙ্গে তিনবার নাগরিকত্বের বিবর্তন ঘটেছে। আজকের একই বাংলাদেশের মানুষ ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্টের আগ পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক, ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানের নাগরিক এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে আজ অব্দি বাংলাদেশের নাগরিক।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সার্বভৌমত্ব, সীমানা, জাতীয়তা, নিরাপত্তা এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব এবং প্র্যাকটিস আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে। একইভাবে, জাতীয়তার আত্মপরিচয়ের অহমিকা ভুলে গিয়ে মানুষ সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নিজের ডেরা সাজাতে শুরু করেছে। যেহেতু, এই রূপান্তর প্রতিনিয়ত ঘটছে সেহেতু এই সংকরায়ণের ধারাকে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নতুন ডিসকোর্স হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংকরায়ণকে খুবই ইতিবাচকভাবেই দেখি। আমি মনে করি মানুষ যখন কোনো জ্ঞান বা সামর্থ্য বা শক্তি অর্জন করে, ওই জ্ঞান সামর্থ্য বা শক্তির উপযোগ বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে। তাহলে, পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতে পারে।
রাষ্ট্র নিজেই একটা কাঠামো। কিন্তু, এই কাঠামোর প্রধান উপাদানই আসলে মানুষ। খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, রাষ্ট্রের মূল স্পিরিট সর্বজনীন কল্যাণের জন্য হলেও, যখনই পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তির উপাদান হিসেবে যোগ করা হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই পুঁজিপতি এলিটদের পাশ কাটিয়ে সর্বজনীন জনহিতৈষীরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। অনেক সময় রাষ্ট্র নিজেই বড় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের পুঁজির দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আজকের দুনিয়ায় রাষ্ট্রসমূহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, মানুষের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা, সীমানার নিরাপত্তার নামে কত আয়োজন সম্পন্ন করে চলেছে! যেখানে, অন্য কোনো দেশকে বা রাষ্ট্রকে কল্পিত শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কত বোমা, গুলি, বোমারু বিমান, ফ্রিগেডসহ নানা যুদ্ধ উপকরণ তৈরি করে চলেছে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো কমবেশি একই কাজই করতে থাকে তথাকথিত নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে। যার ফলস্বরূপ, রাষ্ট্রসমূহ নীরবে নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করার দিকে ধাবিত করে। মানুষের মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেলে রাষ্ট্রের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। যা ক্ষতি হবার সেটা মানুষেরই হবে।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র এবং মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও, অনেকসময়; এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়। অনেক ধরনের সাইবার অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। অনেকসময়, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সন্ত্রাসবাদকে প্রসারিত করা হয় এবং উসকে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাবের পাশাপাশি, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের জনগণের ওপর এবং জাতীয়তার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বব্যাপী মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে ইতিবাচক ভূমিকা এবং প্রভাব রেখে চলেছে, সেটিকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচনায় নিতে চাই।
দুনিয়াব্যাপী মানুষে-মানুষে মিলন এবং ভালোবাসা প্রতিষ্ঠাই মানুষকে কৃত্রিম আরোপিত অবৈজ্ঞানিক নিরাপত্তাবোধের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আনতে পারে। বিশ্বব্যাপী মানুষের পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়ার এই প্রবণতা মানুষের সর্বজনীন কল্যাণের অন্যতম নিয়ামক হতে পারে। এই প্রক্রিয়া যত জোরালোভাবে সম্পন্ন হবে, ততই মঙ্গল। বিভিন্ন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং চিন্তার ধরন একত্রে মিলে গিয়ে বহুমাত্রিক এবং ভিন্নমাত্রার সমষ্টিগত নতুন মূল্যবোধের বিকাশ ঘটতে পারে। এই চিন্তাধারার দুনিয়া হয়তো খুব বেশি দূরে নেই। যখন রাষ্ট্রসমূহ দেখতে পাবে, যে নাগরিকের জন্য তার এত আয়োজন, ওই নাগরিকেরাই রাষ্ট্রের এই কাঠামোগত ভূমিকাকে তোয়াক্কা করে না, কোনো আরোপিত বাধ্যবাধকতা মেনে নেয় না। ঠিক তখনই রাষ্ট্রের ভূমিকার চেয়ে মানুষের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে।
মানুষ যত দ্রুত রাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে বা রাষ্ট্রের জাতীয়তাকে গৌণ মনে করে মানুষে-মানুষে মিশে যাবে, তত তাড়াতাড়িই মানুষের ওপর থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করবে। লাখ লাখ বা কোটি কোটি মানুষ অন্যায্য যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হবে। কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা পাবে। অনেকে মনে করতে পারেন, এই ধারণা একটা কল্পিত ফ্যান্টাসি। তবে, নতুন চিন্তার কল্পিত ফ্যান্টাসিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিন্তা বা কল্পনা করার শক্তিই নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ।