Published : 16 Jan 2013, 10:56 AM
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই কি ওয়াশিংটন থেকে খালি হাতে ফিরে গেলেন? তিন দিনের এ সফরে যাদের সঙ্গে তাঁর দেখা করার কথা তাদের সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন, বৈঠক করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে বৈঠক শেষে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। তারপরও প্রশ্ন হল হামিদ কারজাই যা অর্জন করতে এসেছিলেন তা অর্জিত হয়েছে কিনা।
যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানের সম্পর্কের আশু ও জরুরি বিষয় হচ্ছে ২০১৪ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশের নিরাপত্তায় মার্কিন ভূমিকা। কয়েক মাস ধরে এ রকম ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছিল যে কারজাই চাইবেন আফগানিস্তানে ২০১৪-সালের পরও মার্কিন উপস্থিতির নিশ্চয়তা, কিন্ত সফরের পর দুই প্রেসিডেন্টের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে যে কার্যত মার্কিন সৈন্যরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা (যাকে বলা হয় কমব্যাট রোল) থেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই সরে দাঁড়াবে। কথা ছিল যে তারা এ বছরের মাঝামাঝি গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত সে ভূমিকা পালন করবে– এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে; এখন ওবামা এবং কারজাই ঘোষণা করেছেন যে এ বসন্তেই মার্কিনীরা এ ভূমিকা থেকে সরে যাবে। তাদের ভূমিকা হবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার এবং আফগান বাহিনীকে সহযোগিতা করার।
আফগানিস্তানে এখন যে ৬৬ হাজার মার্কিন সৈন্য আছে তাদের অধিকাংশই ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ফিরে আসবে। ঠিক কত সৈন্য থাকবে তা নিয়ে নিশ্চিত কোনো সংখ্যা কেউই বলছেন না। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া ইঙ্গিত হল তা ১০ হাজারের কম। কোনো কোনো সূত্র বলছে তা ৩ হাজারের বেশি হবে না। কারজাইয়ের সফরের সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটা এ সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেননি যে সব সৈন্যই প্রত্যাহার করে নেয়া হতে পারে, একে তাঁরা 'জিরো অপশন' বলে বর্ণনা করছেন।
এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে গত কয়েক বছরে দুদেশের সম্পর্কে বেশ অবনতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে কারজাই সরকারের দুর্নীতি এবং হতাশাব্যঞ্জক প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণেই তালেবানের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করা যায়নি। আফগানিস্তানের সরকার মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিপদের মুখে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের দিকে যারা চোখ রাখেন তারা বলে থাকেন যে ২০১৪ সালের পর দেশের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা– দুইয়েরই মারাত্মক অবনতি ঘটবে। এসবের জন্যই কারজাই এবং আফগান সরকারের এবং কাবুলভিত্তিক রাজনীতিবিদরা চান না যে যুক্তরাষ্ট্র এখনই একেবারে প্রত্যাহার করুক। ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামা যে বলেছেন আফগানদের আমন্ত্রণে মার্কিন সৈন্যরা ২০১৪ সালের পরও থাকতে পারে সেটা কারজাইয়ের জন্য আশার বিষয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করিয়ে দিয়েছে যে সেক্ষেত্রে মার্কিন সেনাদের আফগান আইন থেকে দায়মুক্তি দিতে হবে।
এ ধরনের সামরিক সম্পর্কের জন্য দরকার স্ট্যাটাস অফ ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট বা সোফা চুক্তি। এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। কিন্ত দায়মুক্তির বিষয়টির মীমাংসা করা যায়নি বলে এ নিয়ে বেশিদূর এগুতে পারেনি দুপক্ষ। তবে ২০১২ সালে দুদেশের মধ্যে যে স্ট্যটিজিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট সই হয়েছে তার মধ্যে অস্পষ্টভাবে এ ধরনের একটা সম্ভাবনা রাখা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট চুক্তি না হলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই আফগানিস্তানে সৈন্য রাখতে উৎসাহী হবে না। সম্ভবত সে কারণেই প্রেসিডেন্ট ওবামা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে স্থায়ী ঘাঁটি গাড়তে চায় না। ওবামার একথা বলার পেছনে আরেকটি কারণ আছে। তা হল আফগানদের কারও কারও ধারণা, যার মধ্যে সম্ভবত কারজাইও আছেন, যে যুক্তরাষ্ট্রের এখানে ঘাঁটি দরকার, তাই তাদের যেকোনো দাবি মানতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হবে।
সফরে কারজাইয়ের একটা সাফল্য হল এটা নিশ্চিত করা যে এখন আফগানিস্তানের বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে যেসব বন্দী আছে তাদের আফগান সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারজাই অনেকদিন ধরেই এ দাবি করছিলেন। এখন তিনি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছেন। এটা তিনি দেশে ফিরে তাঁর একটা অর্জন বলে বর্ণনা করতে পারবেন। তালেবানের সঙ্গে কাতারে আফগান সরকারের যে আলোচনা হচ্ছে, এ সফরে দুপক্ষই তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এটা এক অর্থে মোটেই বড় কোনো বিষয় নয়। কেননা গত কয়েক মাস ধরেই যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী নয়। তাঁরা এ কাজের ভার কারজাই সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনীর নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে খানিকটা আশাহত, কেননা আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতি হওয়ার আগেই আফগান সরকার কয়েকশ তালেবান যোদ্ধাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ আলোচনায় এখন পেছনের সারির দর্শক মাত্র।
তালেবানের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে আফগান সরকারেরও দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটেছে। আগে তারা এ আলোচনায় পাকিস্তানের কোনো ভূমিকা দেখতে চাইত না। কিন্ত এখন তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে পাকিস্তানের ভূমিকা ছাড়া তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় সাফল্যলাভের সম্ভাবনা খুব কম, সম্ভবত নেই। কারজাইয়ের নিয়োগ করা 'হাই পিস কাউন্সিল' ২০১২ সালের নভেম্বরে ২০১৫ সালের মধ্যে শান্তির যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে তাতেও পাকিস্তানের এ ভূমিকার কথা রয়েছে। (উৎসাহীরা পুরো পরিকল্পনা দেখাতে পারেন এখানে- http://www.mcclatchydc.com/2012/12/13/177367/afghan-peace-process-roadmap-to.html)। এ প্রস্তাবে তালেবানের ক্ষমতায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তারা যেখানে শক্তিশালী সেখানে গভর্নর নিয়োগের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে একটাই শর্ত তাদের আফগানিস্তানের বর্তমান সংবিধান মানতে হবে। তালেবান যোদ্ধা ও নেতাদের মধ্যে এখন টানাপড়েন চলছে তারা আলোচনার পথ বেছে নেবে না যুদ্ধে বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করবে।
কারজাইয়ের এ সফরের আরেকটা দিক হল যে ২০১৪ সালে তাঁর মেয়াদ শেষ হবে। নির্বাচনের তারিখ ইতোমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে। ৫ এপ্রিল ২০১৪ সালে নির্বাচন হবে। সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী কারজাই আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ফলে আফগানিস্তানের নেতৃত্বে কে আসবেন তার ওপর খানিকটা নির্ভর করছে আফগান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। কারজাই এ সফরে তাঁর লিগেসি তৈরির জন্য যতটা সম্ভব আদায় করতে চেষ্টা করেছেন সে কারণেই। আগামী এক বছরে তিনি এমন কিছু অর্জন করতে চান যা তাকে ইতিবাচকভাবে আফগান ইতিহাসের অংশ করে রাখবে। এজন্যও দরকার মার্কিনীদের সাহায্য। সেটা অর্জনে এ দফায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। সে কারণেই প্রশ্ন প্রেসিডেন্ট কারজাই ওয়াশিংটন থেকে খালি হাতে ফিরে গেলেন কিনা।
ইলিনয়, ১১ জানুয়ারি ২০১৩
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।