উৎসর্গ: দেশের প্রথম মরণোত্তর অঙ্গদানকারী সারাহ ইসলামকে
Published : 01 Feb 2023, 11:38 PM
১৮ জানুয়ারি ২০২৩, শৈশবের অনারোগ্য ব্যাধিতে ১৯ বছর বয়সে সারাহ ইসলাম দুনিয়া ছেড়ে গেলেন, অমর হয়ে রইলেন ‘দেশের প্রথম মরণোত্তর অঙ্গদানকারী’ হিসেবে কিডনি ও চোখ দান করে। তার কিডনি নিয়ে দুজন মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেছেন ও তার দুই কর্নিয়া নিয়ে দুজন ফিরে পেয়েছেন তাদের দৃষ্টি। কত বড় মহান কাজ হল কল্পনা করা যায়? আশা করি তার এই মহৎ উদাহরণে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই মরণোত্তর কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গ দান করবেন। কারণ দেশে অগণিত মানুষ তাদের সুস্থ অঙ্গ নিয়ে মারা যান অথচ তাদের কিডনি/অঙ্গ পেলে অসংখ্য রোগী সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন।
অঙ্গদান বিষয়টি সাম্প্রতিক, কোরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বা সরাসরি কিছু নেই। বিশ্ব-আলেমদের মধ্যে অঙ্গদানের আলোচনাটি শুরু হয়েছিল ৫০-এর দশকে৷ বিষয়টির সাথে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় আইন, গণমানস ও এর পক্ষে-বিপক্ষে ইসলামী ধর্মবিশ্বাস। ব্যাপারটার ইসলামী আঙ্গিক আমরা সংক্ষেপে তিন ভাগে দেখব ১) অঙ্গদানের প্রতি বিরোধিতা, ২) অঙ্গদানের প্রতি সমর্থন ও (৩) অঙ্গদানের ইসলামী জটিলতা।
১) অঙ্গদানের বিরোধিতা
রক্তদানের বিরোধী বয়ানে আছে অমুসলিমদের থেকে রক্ত নেওয়া ঠিক নয়, কারণ খোদাভীরু মুসলমানের রক্তে কাফের, পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের রক্তের প্রভাব পড়ার সম্ভবনা থাকে ইত্যাদি। অঙ্গদানের বিরোধীরা বলেন জীবিত হোক মৃত হোক, শরীরের ক্ষতি, আত্মহত্যা বা অঙ্গদানের অধিকার মানুষের নেই। কারণ শরীর আল্লাহর তরফ থেকে আমানত মাত্র, এর মালিক মানুষ নয় বরং আল্লাহ। হাদিসে মৃতদেহকে অত্যন্ত সম্মান দেওয়া হয়েছে, এ-ও বলা হয়েছে `মৃতের ও জীবিতের হাড় ভাঙা একই কথা’। কাজেই মৃতদেহ থেকেও অঙ্গদান করা যাবে না। তবে ‘গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সীমিত ক্ষেত্রে এটা করা যেতে পারে… নইলে মানবদেহ এক সময় ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হবে, তখন জীবন্ত মানুষকে হত্যা করে এই নিকৃষ্ট ব্যবসা চালানো হবে’ –আত-তাহরিক, ফেব্রুয়ারি, ২০১০।
অর্থাৎ গবেষণা ও প্রশিক্ষণের বাইরে অগণিত মানুষ মরে যায় যাক, উনারা কেতাবের অক্ষর থেকে যা বুঝেছেন সেটাই বেঁচে থাকুক। এই অমানবিকতার জন্যই মুসলিম বিশ্ব সাধারণভাবে এই তত্ত্বকে বর্জন করেছে। নিচে ‘সমর্থন’ অংশ দেখুন। এই তত্ত্বের মধ্যে ফাঁক আছে দুটো। প্রথমত, মৃত বা সারাহ ইসলামের মত নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রীর অঙ্গ নিজের শরীরে লাগিয়ে অসংখ্য নিশ্চিত মৃত্যুমুখী রোগী বেঁচে যাবেন– এই মহৎ বাস্তবতাকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এভাবেই আমরা ধর্মপালনের উদগ্র তাড়নায় কেতাবের অক্ষরে বন্দি হয়ে ধর্মের নামে মানুষের ওপর অত্যাচার উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। একেই ড. হাশিম কামালীর মত অনন্য ইসলামী স্কলার বলেছেন লিটারালিজম বা আক্ষরিকতা, অক্ষরের কারাগার –‘প্রিন্সিপলস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’, পৃষ্ঠা ২০১, ২১৯ ও ২২৩।
দ্বিতীয়ত, মানবদেহ ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হবে, জীবন্ত মানুষকে হত্যা করা হবে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে অন্যায়ভাবে সাধারণ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। এক, সিরাজগঞ্জে কিডনির জন্য শিশুকে অপহরণ ও খুন করা হয়েছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩। দুই, কাতারে হামাদ মেডিকেল করপোরেশনের ‘অঙ্গদান’ আহ্বানে ২৯৩৫ জন বাংলাদেশিসহ ২৩,০০০ লোক নিবন্ধন করেছে, ‘কাতারে ৩০০০ বাংলাদেশির অঙ্গদান’, কালের কণ্ঠ, ১৮ অক্টোবর, ২০১৪।
তা বেশ।
সমাজে অত্যন্ত কম কিছু অপরাধ ঘটে, যেমন মায়ের হাতে সন্তানের খুন। সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছু অপরাধ সর্বদাই ঘটে যেমন ঘুস খাওয়া। সেগুলো ‘সামাজিক প্রবণতা’-এর পর্যায়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ‘সামাজিক প্রবণতা; হিসেবে চালিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। অঙ্গের জন্য মানুষ খুনের ঘটনা গত এক বছরে কয়টা ঘটেছে? পাঁচটা? দশটা? বিশটা? মোটেই নয়। কাতারে গণহারে অঙ্গদানের মত ঘটনা গত এক বছরে কয়টা ঘটেছে? ওই একটাই? পাঁচটা? মোটেই নয়। অথচ বিশেষজ্ঞ বলছেন ‘কিডনিদাতার অভাবে প্রত্যেক বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যান’, বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, ‘সারাহ ইসলাম: মরে গিয়েও অমর এক তরুণী’, www.eyenews.news, ২১ জানুয়ারি, ২০২৩।
তাহলে? মানুষ কেতাবের অক্ষরে বন্দি হয়ে থাকবে, নাকি ধর্মের যে মূল স্পিরিট মানবকল্যাণ তার পক্ষে থাকবে?
২) সমর্থন
সৌদি আরব, মিসর, আমিরাতসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে অঙ্গদান এখন কোনো ব্যাপারই নয়, অহরহই হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বেও অনেক মুসলিমই অঙ্গদান করেন। অর্থাৎ ইসলামের মানবতাবাদী ব্যাখ্যাই গ্রহণ করছে মুসলিম বিশ্ব, পিছু হটছে ইসলামের মানবতাবিরোধী ব্যাখ্যা। কোরআন বলেছে, “যে অন্য কারও জীবন রক্ষা করল সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল” –সূরা মায়েদা, ৩২। অঙ্গদানে মানুষের জীবন রক্ষার মত মহাকল্যাণ হয়, যার চেয়ে মহৎ কর্ম আর কিছু নেই। অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞের মতেই, মৃত ব্যক্তির যে কোনো অঙ্গ দান করা যাবে, জীবিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিরুপায় হলে তিনটি শর্তে অঙ্গদান করা যাবে ক) অঙ্গদাতার যেন শারীরিক ক্ষতি না হয়, খ) অঙ্গ গ্রহণে যাতে গ্রহীতার উপকার হয়, হুজুগ বা শখ করে নেওয়া যাবে না এবং গ) এর মধ্যে কোনো আর্থিক লেনদেন থাকবে না। আল্লাহ আমাদেরকে অনেক কিছুই দিয়েছেন এবং সেগুলো ব্যবহার বা অপব্যবহার করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন। পরকালের বিচার সেজন্যই আছে, এই স্বাধীনতাটা না থাকলে পরকালের বিচার অর্থহীন হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, অনেকদিন থেকেই কৃত্রিম রক্ত, বিভিন্ন বস্তু বা শরীরের স্টেমসেল থেকে কিছু অঙ্গ ও একটা অঙ্গের থ্রি ডাইমেনশন্যাল কপি করে নতুন অঙ্গ বানানোর গবেষণা চলছে। এটা সফল হলে মানব দেহ থেকে অনেক অঙ্গই নিতে হবে না।
৩) এর জটিলতা
এটা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং। সহি বুখারিতে আছে, “ইবনে আব্বাস বলিয়াছেন, রসূল (স.) বলিয়াছেন তোমরা খালি পায়ে হাঁটিয়া আল্লাহর সম্মুখীন হইবে নগ্ন এবং খৎনা-বিহীন ভাবে” –অষ্টম খণ্ড, হাদিস ৫৩১। এটা আছে সহি বুখারি প্রথম খণ্ড ১১৫, দ্বিতীয় খণ্ড ২২৬, চতুর্থ খণ্ড ৫৬৮ ও ৬৫৬, ষষ্ঠ খণ্ড ১৪৯ ও ২৬৪, সপ্তম খণ্ড ৭৩৫ ও অষ্টম খণ্ড ২৩৭, ৫৩১, ৫৩২, ৫৩৩ এবং ৫৩৪ এগুলোতেও। অর্থাৎ ‘খালি পায়ে হাঁটা’ ও ‘খৎনাহীন নগ্ন শরীর’ অনুযায়ী কেয়ামতে মানুষ শরীর নিয়ে উঠবে। আমরা তো জানি পরকালের শাস্তি ও পুরস্কার সবই দেহ-নির্ভর যেমন দোজখের আগুন ও বেহেশতের খাদ্য-পানীয় তহুরা শরাব।
এবারে ধরুন, কোনো খুনি-ধর্ষকের কিডনি এক মুসলিম দরবেশকে দেওয়া হলো কিংবা কোনো দরবেশের কিডনি এক খুনি-ধর্ষককে দেওয়া হলো।
ইসলাম ধর্মবিশ্বাস মাফিক খুনি-ধর্ষক দোযখে যাবে আর মুসলিম দরবেশ বেহেশতে যাবেন।
প্রশ্ন: ওই কিডনিটা কোথায় যাবে?