Published : 20 Jul 2022, 07:52 PM
গত ১৫ জুলাই নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় কী ঘটেছিল? ১৮ জুন একই জেলার সদর উপজেলার ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বেলায় যা ঘটেছিল তাই। স্বপন কুমার বিশ্বাসের বেলায় কী ঘটেছিল? ভোলার বোরহানউদ্দিনে যা ঘটেছিল। সেখানে কী ঘটেছিল? পীরগঞ্জে যা ঘটেছিল? পীরগঞ্জে কী ঘটেছিল? সাঁথিয়ায় যা ঘটেছিল। সেখানে কী ঘটেছিল? নাসিরনগরে যা ঘটেছিল। নাসিরনগরে কী ঘটেছিল? রামুতে যা ঘটেছিল।
আসলে কী ঘটেছিল? ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি লুটপাট করার অজুহাত তৈরি করা হয়েছিল। আর এ জন্য প্রতিবারই অভিন্ন একটি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তার নাম ধর্মীয় অনুভূতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া বা কোনো স্ট্যাটাসে মন্তব্য করা নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত হানার কথিত অপরাধে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে আক্রমণ চালানো হয়েছে। ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলো প্রতিবারই ঘটনা ভুয়া প্রমাণিত হলেও যার নামে অভিযোগ করা হয়েছে তার নিস্তার মেলেনি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তিও ঠেকানো যায়নি। যারা মিথ্যা অভিযোগ তুলে হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের লাঞ্ছিত করেছে, সম্পদ বিনষ্ট করেছে, নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে তাদের বিচার হয়নি। ফলে এ ধরনের ঘটনা একটার পর একটা ঘটছেই। সামনে আরও ঘটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এমন ধারাবাহিক ঘটনায় সর্বশেষ সংযোজন হলো নড়াইলের সাহাপাড়ার ঘটনা। লেখাটি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত এই গ্রামের বাসিন্দারা বাড়িতে ফেরেনি। বাজারের প্রায় অর্ধেক দোকান খোলেনি। মানুষের আতঙ্ক কাটেনি । মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটুক্তি করে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা হলে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় তারা বাড়ি ছাড়েন। তার আগে সাহাপাড়ায় দুটি বাড়ি ভাঙচুর হয়। একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাজারের তিনটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। ওই সময়ে চারটি মন্দিরে হামলার ঘটনাও ঘটে। এর আগে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়া অভিযুক্ত তরুণের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিপেটা করে ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সেদিন রাত সাড়ে নয়টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে ওই রাতেই সাহাপাড়ার বাসিন্দা দিঘলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলীপ চন্দ্র সাহা ও ব্যবসায়ী গৌর সাহার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। পান বিক্রেতা গোবিন্দ সাহার বাড়ির একটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দিঘলিয়া বাজারে গৌতম সাহা, নিত্যদুলাল সাহা ও অনুপ সাহার দোকান ভাঙচুর করা হয়। হামলা করা হয় ওই এলাকার রাধাগোবিন্দ মন্দির, আখড়াবাড়ি সর্বজনীন মন্দির, মহাশ্মশান কালীমন্দির ও স্বপন সাহার পারিবারিক মন্দিরে।
রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা পরদিন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সাহাপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে এ পাড়ার বাসিন্দারা বাড়ি ছাড়তে থাকেন। রাত একটার পর ভয়ে অধিকাংশ বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। যারা রাতে বাড়িতে ছিলেন, তাদের রাত কেটেছে না ঘুমিয়ে। বাকিরা পরদিন ভোরে বাড়ি ছাড়েন। এসব পরিবারের সদস্যরা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে ১০৮টি হিন্দু পরিবারের বসবাস। সর্বোচ্চ ২০ জন পুরুষ বাড়িতে আছেন। বাড়িতে নেই কোনো নারী। তারা আতঙ্কে বাড়িতে ফেরেননি।
ঘটনার পরদিন একাত্তর টিভিতে হ্যামলেট সাহা নামের সাহাপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, এক তরুণের বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-কে অপমান করে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে কিছু গ্রামবাসী তার পিতার কাছে আসেন। ওই তরুণের পিতা গ্রামবাসীদের বিচারের আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী ছেলের বিচার করা হবে। এই আশ্বাসের পর গ্রামবাসীরা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার এক পর্যায়ে মূল সড়কে অবস্থান নেয়। ওই সময়ে মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন পুলিশ আসে। পুলিশ দেখে উপস্থিত লোকজন আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
হ্যামলেট সাহা আরও বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তিনি অনেককে দেখেছেন যারা তার বাল্যবন্ধু। গ্রামের মুরুব্বি, যাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে তার বিকেলেও কথা হয়েছিল। একাত্তর টিভির সে অনুষ্ঠানে ওই নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও টেলিফোনে যুক্ত ছিলেন। একই অনুষ্ঠানে হ্যামলেট সাহা আরও বলেন, হামলাকারীরা ঘরে ঘরে টাকা দাবি করেছে, টাকা দিতে না পারলে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। এদের মধ্যে অনেকে বলেছে টাকা না দিলে ভবিষ্যতে আরও হামলা হবে।
ঘটনার দিন বিকেলে স্থানীয় বাজারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, অভিযুক্তের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। অভিযুক্ত তাকে বলেছে, যে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটি দেওয়া হয়েছে সেটি তার নয়।
প্রশ্ন হলো এক মাসও হয়নি নড়াইলেই একই কায়দায় একজন অধ্যক্ষকে গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল তারপরও কেন স্থানীয় প্রশাসনের সামান্য টনক নড়ল না? তারা পরিস্থিতি মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতি নিল না? নিরাপত্তার পূর্ণ ব্যবস্থা না নিয়ে সেদিন পুলিশের পক্ষ থেকে কীভাবে সাহাপাড়ার লোকজনকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল?
তবে পূর্বের সবকটি ঘটনার মতো পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
২.
বাংলাদেশে কখনোই কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। এমনকি ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের ২৩ বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের মধ্যে এই বক্ষমান কলামটি লেখার সময় পর্যন্ত কোথায়ও কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি। যা হয়েছে তা সংখ্যালঘুর ওপর হামলা ও নির্যাতন। দাঙ্গার জন্যে দু-পক্ষকে সক্রিয় হতে হয়। দু-পক্ষেরই অংশগ্রহণ থাকে তাতে। এ ভূখণ্ডের কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দাঙ্গায় অংশ নেয়ার মতো বা দাঙ্গা করার মতো মানসিক শক্তি অর্জন করেনি। তারা বরাবরই সংখ্যাগুরুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং এদের বিশাল একটি অংশ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দুদের দেশত্যাগ কখনো থামেনি। ১৯৪৭-এ একবার, ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধের পরে একবার ১৯৭১-এ একবার, এরশাদের আমলে দু-বার, ২০০১ সালে জোট সরকার (বিএনপি-জামাত জোট) ক্ষমতায় আসার পরে একবার– এভাবে এদেশের বিপুল সংখ্যক হিন্দু পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এদেশের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে। আশ্রয় নিয়েছে না বলে বলা উচিৎ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। দিন দিন সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমছে। দেশভাগের সময় সংখ্যালঘুর সংখ্যা যেখানে ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আজ সেখানে সংখ্যালঘুর সংখ্যা ৮ ভাগের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তথ্যটি উদ্বেগজনক, অমানবিক, সাম্প্রদায়িক ও একটি সভ্য জাতির জন্যে অবমাননাকর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এইসব কি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা? আমি তা মনে করি না। দেশকে সংখ্যালঘুশূন্য করতে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ এসব। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে এ ধরনের ঘটনা ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব বাংলাদেশে এখন থেকে প্রতিদিনই অপেক্ষা করতে হবে নতুন নতুন অরাজক পরিস্থিতি অবলোকন করার জন্যে। এ কাজে যে শুধু বিএনপি-জামায়াত বা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা জড়িত তা নয়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পুলিশে ও অন্যান্য বাহিনীতে এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও লুকিয়ে আছে তাদের সমর্থক ও চর। তাদের ইন্ধনেই এমন ঘটনা আরও ঘটবে। শুধু সংখ্যালঘু নয় মুসলিমদের মধ্যেও বিভিন্ন তরিকা বা মতভেদ নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি হতে পারে। পুলিশ বিরোধীদল ঠেকাতে যত সহজে অ্যাকশনে যেতে পারে। লাঠিপেটা এমনকি গুলি চালাতেও দ্বিধা করে না সেই পুলিশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় নিষ্ক্রিয় থাকে কাদের খুশি করার জন্যে! কাদের ফায়দা লোটার জন্যে!
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিতাড়নের ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের কারণটি বলি। বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দ্বি-ধারায় বিভক্ত। একটি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে উজ্জীবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, উদার গণতান্ত্রিক ধারা। অন্যটি পাকিস্তানি ভাবধারায় লালিত সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক, আধা সামরিক ও জঙ্গিগোষ্ঠী সমর্থিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারা। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা প্রথম ধারাটির সাথে যুক্ত এবং সমর্থক। এখন বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইলে, দুর্বল করতে হবে প্রগতিশীল ধারাটিকে। আর প্রগতিশীল ধারার বড় একটি অবলম্বন, সমর্থক বা সহজ করে বললে ভোটার দেশের সংখ্যালঘু জনগণ। এখন সংঘাত স্থানীয় মাধ্যমে, আক্রমণ আতঙ্ক ও জবরদখলের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা গেলে দুর্বল হবে প্রগতিশীল শক্তি। আর তাতে সহজ অংকে লাভবান হবে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। অংকটি বড় সহজ। যে অংকের শুরু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর। এর সাথে একটি উপরি পাওনা আছে বটে। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া জায়গা জমি। ভোট কমার সাথে সম্পদ বৃদ্ধির হিসেব যারা বোঝে তাদের খুব বেশি বোকা ভাবা ঠিক হবে না। আমরা চাই নড়াইলের ঘটনাটি দেশে এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনা হোক। একই সাথে প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করা হোক। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণেই যুগে যুগে এই উপমহাদেশে বলি হয়েছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ। এই ঘৃণ্য অপকর্মের অবসান চাই।
শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী রতন সিদ্দিকীর ওপর আক্রমণের বিষয়টি আমরা সকলে জানি। ওই ঘটনাটিও ছিল পরিকল্পিত। এর কয়েকদিন পর প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, শুক্রবারগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। আর আমি বলতে চাই, বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে একাত্তরের, মুক্তিযুদ্ধের, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশটাই বুঝি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।