Published : 03 May 2022, 07:42 PM
কোভিড-১৯ এর উপদ্রব শেষ হতে না হতেই আলোচনায় এসে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মহামারীকে পেছনে ফেলে ইউক্রেইনের যুদ্ধ এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। অপরিচিত করোনাভাইরাস মানব জাতির এতদিনে অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সংহার করেছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। যু্দ্ধের অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও আরও অনেক আঞ্চলিক ও দুই পক্ষের যুদ্ধ হয়েছে। জীবন ও সম্পদের ক্ষতি ছাড়া যুদ্ধ আর কী উপকারে এসেছে? আমরা বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য যুদ্ধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়েই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
কোনও দৈব-দুর্বিপাক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলেকয়ে আসে না। বিশেষ করে করোনার মতো প্যানডেমিক তো নয়ই। পৃথিবীর কারোই কল্পনাতেও ছিল না যে, এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তবে এটাই সত্য যে কারণেই আমাদের জানা হয়েছে দেশে দেশে স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে করোনার কী প্রভাব- তার বিস্তারিত হিসাবনিকাশ হওয়ার আগেই ইউক্রেইন যুদ্ধ পৃথিবীর অর্থনীতিতে ধাক্কা দিতে এগিয়ে এসেছে। এই যুদ্ধের জন্য কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিতর্ক করা যাবে বিস্তর কিন্তু তাতে বিপদ কিছু কমবে না।
ইতিহাস থেকে আমাদের একটা বিষয় জেনেছি, যুদ্ধ বা মহামারীর মতো বিপর্যয়ে বহু দেশেরই অর্থনৈতিক গতিপথ সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। এতদিন যারা জিতেছিল, তারা চলে যেতে পারে পরাজিতের কাতারে। আবার যারা পিছিয়ে ছিল তারা হয়ে উঠতে পারে নতুন বিজয়ী। করোনা ও ইউক্রেইন যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা কী হবে- তার আগাম চিত্র আঁকা সম্ভব না হলে এটা বলা যায় যে, সামনের সময় কঠিন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কে কীভাবে পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে নিতে পারে, তার উপরই নির্ভর করবে অনেক কিছু ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের রাজনীতিবিদ ও সমাজচিন্তকদের ভাবতে হবে। তাৎক্ষণিক বা স্বতঃস্ফূর্তা পরিহার করে বিষয়ের গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থনীতি যাতে ভঙ্গুর অবস্থায় না যায় তা নিয়ে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখতে হবে সাধারণ মানুষ যেন অনাবশ্যক কষ্ট না পায়। সংকট সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলে সরকারের একক চেষ্টায় তা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। নাগরিক শক্তিকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে নাগরিক সমাজকেও যথাযথ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিক শক্তির সহযোগিতার একটি নতুন ধারা গড়ে ওঠার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে।
ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা করেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলে আমরা সুফল পেয়েছি। দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত তথা সাধারণ জনগণের ঘাড়ে সব বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করা ঠিক নয়। জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন আবশ্যক ছিল, তেমনি অর্থনীতির চাকা সচল না রাখলেও জীবন চলতো না। জীবন ও জীবিকার একটি সুসমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। আমাদের অনেকের মধ্যেই নিয়ম-বিধি না মানার এক ধরনের উগ্র মানসিকতা রয়েছে। একজন নিয়মের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখালে, বিধি ভঙ্গ করলে তা যে অনেকের জীবন বিপন্নের কারণ হতে পারে সেটা আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। স্বেচ্ছায় নিয়ম না মানলে সব সময় ভয় দেখিয়ে সেটা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে সরকার বাড়াবাড়ি করেনি। কেউ কেউ তখন এনিয়ে বিরূপ সমালোচনা করলেও এখন বোঝা যাচ্ছে সমন্বয়ের কাজটি খারাপ হয়নি।
আমাদের দেশে কাগজে কলমে অনেক দিন ধরে লকডাউন চললেও বাস্তবে খুব কড়াকড়ি আরোপ করা যায়নি। মানুষের চলাচল, এবং ঘোরাফেরা একেবারে বন্ধ হয়নি। বাজারে উপচে পড়া ভিড় সবসময় দেখা গেছে। সরকার কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা বা অন্য সহায়তা দিয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল না তা-ও জোর দিয়ে বলা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ সময় টানা বন্ধ থাকায় শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে বেশি। অনেক শিক্ষার্থী পাঠবিমুখ হয়েছে। অনেকে ঝরে পড়েছে। বাল্য বিয়ে বেড়েছে। এই বিষয়গুলো এখন বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। এবার ঈদে অনেকেই গত সময়ের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে করোনার সময় যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা তখন কর্মহীন হয়েছেন, তাদের বিষয়েও সরকারকে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে।
বেসরকারি ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে সরকারি সহায়তা দিতে হবে। অসংগঠিত এবং ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। কৃষিক্ষেত্র এবং ছোট ছোট কারখানাগুলো যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সব মনোযোগ যেন পোশাক শিল্প বা সংগঠিত খাতের দিকে না থাকে। যাদের কথা বলার সুযোগ নেই, যাদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই– তাদের হয়ে তো সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
দুনিয়াভর যে ওলটপালট চলছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা যদি কোনো ভুল পদক্ষেপ নেই সেটা সাধারণ ভুল হবে না। সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ মিলবে না। আজকের একটা ভুল পদক্ষেপ স্থির করে দেবে, আগামী কয়েক দশক দেশের অর্থনীতি কোন কক্ষপথে চলবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকার মতো হবে না। কিন্তু শ্রীলংকা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
কোভিড-১৯ এর বিপর্যয় নিশ্চয়ই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই সময়টা আসলে সহানুভূতির, সহৃদয়তার, ভালোবাসার, বিবেকের। কুসংস্কার বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতাকে জায়গা করে দেওয়ার। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানবিক সাম্যের নীতির পথে আবারো এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রে সমান মানবিকতার পরিচয় দিতে যেমন পারছি না, তেমনি অন্ধ বিশ্বাসও পরিহার করতে পারছি না। নানামুখী দ্বন্দ্ব আমাদের সামনে যে বৃত্ত এঁকে দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এই বৃত্ত ভাঙার মতো সাহসী আমরা হতে পারবো বলেও মনে হয় না। তবে এটা ঠিক যে, করোনা-পরবর্তী পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক থাকবে না। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে নানা বাঁকবদল ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। পুঁজিবাদ তার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে দুনিয়াজোড়া আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়তো পারবে না। বাজার অর্থনীতির রমরমা অবস্থাও হয়তো বহাল থাকবে না। রাষ্ট্রই যে নিদানকালে বড় ভরসা সেটা বোঝা গেছে। তাই বিশ্ব রাজনীতি আবার এক বিকল্প শক্তিকেন্দ্রের সন্ধান করবে বলেই মনে হয়। তবে ইউক্রেইন যুদ্ধ কীভাবে সমাপ্ত হয়, বড় শক্তিগুলোর নতুন কোনো বিন্যাস ঘটে কি না, তা-ও দেখতে হবে।
আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশেও নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা লক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। চিরাচরিত পন্থায় প্রচলিত কাঠামোর ওপর অল্পবিস্তর প্রসাধনী লেপন করে উত্তরণের পথ খু্ঁজলে সুফল পাওয়া যাবে না। একই ভুল পথে দুই বার হাঁটলে সেটা হবে গুরুতর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে তেমন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আছে কি? নেতৃত্ব আকাশ থেকে পড়ে না। এই সংকটকালেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দেউলিয়াপনাই প্রকট হয়ে দেখা গেল। এত এত দল, এত এত নেতা- সবাই কোথায় লাপাত্তা। এই দুঃসময়ে শীতঘুমে যাওয়া দল ও নেতাদের খারিজ করতে হবে। বিপদমুক্ত দেশে এরা মানুষের সামনে দাঁড়ালে তাদের বর্জন করার প্রশ্ন আসবে। বিপদ দেখলে যারা শামুকের মতো নিজেদের খোলসের মধ্যে গুটিয়ে নেন তাদের নির্বাসনে পাঠাতে হবে।
এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতির হাল ধরে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বেই সব কিছু চলছে। মানুষের আশা-ভরসা শুধু তার ওপরই। দেশে কার্যকর বিরোধী দল নেই। একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি সম্ভবত সরকারও চায় না। তবে গণতন্ত্রের জন্য এটা খুব স্বাস্থ্যকর অবস্থা নয়। প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বের শাসন সরকারের জন্য স্বস্তিকর হলেও, এটা প্রকৃত গণতন্ত্রকামীদের শিরপীড়ার কারণ। এটা মজবুত কাঠামো নয়। প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই সেটা বোঝেন। আবার নিজের অসহায়ত্বও তিনি বোঝেন। তার দল এবং সহযোগী নেতৃত্বের দুর্বলতাও তার অজানা নয়। তিনি ছাড়া আর সবাইকে কেনা যায়- এমন খেদোক্তি তার নিজের। তার চারপাশে কাজের লোক কম। নানা ধান্দার লোক বেশি। 'আমি কী পাবো', 'ও পেয়েছে আমি কেন পাবো না'- এই মনোভাব যাদের- তাদের দূর না করলে 'পাওয়া' এবং 'খাওয়া'র প্রতিযোগিতায় সব বরবাদ হয়ে যাবে। হয়তো এরমধ্যে তা অনেকাংশে তা গেছেও। যেসব সুবিধাভোগী মন্ত্রী, এমপি, নেতা এখন মানুষের পাশে নেই তাদের সবাইকে পরবর্তী রাজনীতিতেও নিরাপদ দূরত্বেই রাখতে হবে। বিশাল দল আওয়ামী লীগের দাপুটে সব নেতারা কোথায়? এতোবড় দলে এতো এতো নেতা থাকতে সচিবদের কেন জেলার সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে হলো? এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। এই ক্রান্তিকালে যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতকে তারা শক্তিশালী করতে না পারেন তাহলে এই সুবিধাভোগীরা দেশের বা দলের কী কাজে লাগবে? প্রধানমন্ত্রীকে ভেবে দেখতে হবে মুখোশে ঢাকা মুখ নিয়ে তিনি কতদিন চলবেন?
ব্যর্থতা দলবাজি দুর্নীতির অভিযোগ শাসকদের বিরুদ্ধে থাকে। বড় বিপর্যয় হলে কাদা ছোঁড়াছুড়িও রাজনীতির চিরকালীন বৈশিষ্ট্য। তবে ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি মুক্ত থাকার জন্য বিতরণ ব্যবস্থায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে। স্বচ্ছতা সুশাসনের প্রধান শর্ত। কোন শ্রেণির মানুষকে, কোন খাতে কতো সাহায্য করা হচ্ছে তা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রচার করা উচিত। সন্দেহবাদীরা যাতে সত্যাসত্য যাচাই করতে পারে।
খাদ্য জনগণের মূল চাহিদা। তাই চাল থেকেই মতলবি রাজনীতি সস্তা 'ভিটামিন' সংগ্রহ করে থাকে। তাই চাল নিয়ে সামান্য অনিয়মও প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। আবার দলের যেসব অর্বাচীন নেতা-কর্মী ত্রাণ সহায়তা কিংবা ধান কাটার নামে 'হাইস্যকর' ফটোসেশন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন তথ্য গোপন করা কঠিন সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিসক্রিয়। তথ্যের অত্যাচারে মাথা গুলিয়ে যাওয়ার অবস্থা। মানুষের অনাহারে থাকার নাটুকে ভিডিও ভাইরাল হতে পারে। বাসন্তী নাটকের কথা মনে রাখতে হবে। রাজনীতি এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যা দুর্যোগেও থেমে থাকে না। মাথা গলানোর ছিদ্র বের করতে যারা সক্রিয় তাদের প্রতিহত করার প্রজ্ঞা যিনি দেখাতে পারবেন, তিনিই তো আগামীর রাজনীতির কাণ্ডারি হবেন।