Published : 02 May 2022, 07:16 PM
এবারে দুর্গাপূজার অর্থনীতির দিকে একটু তাকাই। ভারতবর্ষের বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। শুধু প্রবাসী বাঙালিরাই নন, কলকাতার দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক এ উৎসব পালন করতে আসেন। কেবল কলকাতা মহানগরেই পূজা হয় প্রায় পাঁচ হাজার মণ্ডপে। প্রতিমা শিল্পী, প্যান্ডেল নির্মাতা, আলোকসজ্জা কর্মী, পোশাক কর্মী- কত অসংখ্য মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। খাবার, পর্যটন, ফুল- অনেক অনেক অনুষঙ্গ। কলকাতার কোনও কোনও মণ্ডপে নাকি পূজার আয়োজনে ব্যয় হয় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি ভারতীয় রুপি। প্রতিদিন সবগুলো মণ্ডপে দর্শনার্থী আসেন এক থেকে দুই লাখ। পূজা উদযাপন কমিটির আয়ের প্রধান উৎস করপোরেট স্পন্সরশিপ এবং প্যান্ডেলের বাইরের বিজ্ঞাপন। স্যুভেনির বিজ্ঞাপন এবং এলাকাবাসীর চাঁদাও আছে এর সাথে। টেলিভিশন স্বত্বও নাকি বিক্রি হয়।
দুর্গাপূজার উৎসবকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি কী ভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তা নিয়ে ২০১৩ সালে অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বা 'অ্যাসোচ্যাম' একটা রিপোর্ট বের করেছিল। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী তখন পশ্চিবঙ্গের দুর্গাপূজা শিল্প ছিল ৪০ হাজার কোটি ভারতীয় রুপির। দুর্গাপূজার অর্থনীতির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৩৫ শতাংশ ধরা হয়। গত ২০১৯-এ এটা ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা, যা পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি-র ১০ শতাংশেরও বেশি।
ব্রাজিলের অর্থনীতিতে রাজধানী রিও ডি জেনিরো'র 'রিও কার্নিভাল'- এর মতো জগদ্বিখ্যাত চাকচিক্যের অবদানও ২ শতাংশের কম। প্রতি বসন্তে চেরি ব্লসম অর্থাৎ চেরিফুল ফোটার উৎসব 'হানামি' জাপানকে জুগিয়ে চলেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রধানত পর্যটন থেকে। তবু তার পরিমাণটা জাপানের জিডিপি-র সোয়া দুই শতাংশের আশেপাশে।
জার্মানির জিডিপি-তে ব্যাভারিয়ার বিশ্ববিখ্যাত 'অক্টোবার ফেস্ট'-এর অবদান মোটামুটি ১.৩৫ শতাংশের মতো। আর আমেরিকার নিউ অরলিন্স-এর 'মারডি গ্রাস' (Mardi Gras) উৎসব সে শহরের জিডিপি-তে জোগান দেয় দেড় শতাংশের মতো।
আমার সবসময়ই মনে হয়, সৌদি আরবের 'হজ ইকোনমি'র মতো না হলেও, বিশাল সম্ভাবনা ছিল আমাদের বিশ্ব ইজতেমার। অর্থনীতিতে খুব বড় অবদান ফেলার কথা থাকলেও আমরা সেটাকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।
রোজার ঈদের ব্যাপারে বলা যায়, দুনিয়ার আর কোনো উৎসবের সামষ্টিক অর্থনীতি-ই কিন্তু দেশের বাজেটের অর্ধেকের সমান না। সাথে রয়েছে এর বিশাল সামাজিক পরিব্যাপ্তি। এখানেই ঈদুল ফিতর ব্যতিক্রম। তাই রোজার ঈদের তুলনা চলতে পারে কেবল কমপক্ষে বিশ কোটি জনসংখ্যার কোনো পশ্চিমা দেশের ক্রিসমাস বা চাইনিজ় নিউ ইয়ারের সঙ্গে।
দুর্গাপূজার উৎসবের সময় অনেক পর্যবেক্ষক, ব্লগার ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতারা আসেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। পূজা উপলক্ষে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল 'গ্রেটেস্ট পাবলিক শো অন আর্থ'- দুর্গাপূজার ওপরে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে। আমাদের কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া বা দিনাজপুরের গোরা শহীদ ময়দান মাঠের ঈদুল ফিতরের জামাত নিয়েও ডকুমেন্টারি করা যায়। ঈদে বাড়ি যাওয়ার নানারকম বিচিত্র পদ্ধতি নিয়েও একটা ভিডিও বানানো যায়।
মানুষ কেন, কীসের টানে শতসহস্র দুর্ভোগের পরেও পাগলের মতো প্রতিবার নাড়ির সম্পর্কের কাছে ফিরে যায় এর কোন ব্যাখ্যা কেউ জানে না। একে ছড়িয়ে দেয়ার আইডিয়া কারো মাথায় কি আছে? আমরা পিছিয়ে আছি এইসব জায়গার মার্কেটিংয়ে। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের 'রোজার ঈদ' অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য একটা বিস্ময়।
পৃথিবীর আর কোথাও কি বিচ্ছিন্নভাবে কোনও একটা ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব একটা দেশ কিংবা এর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবনস্পন্দনকে এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে?