Published : 13 Mar 2022, 05:12 PM
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন চীনকে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত না করে বরং সহযোগী ভাবা উচিত। তার ভাষায়, চীন-ভারত তিক্ততা উভয় দেশের জনগণের মৌলিক স্বার্থের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আরো বলেছেন, কিছু শক্তি ভারত-চীন প্রতিযোগিতা জিইয়ে রাখতে চায়।
বিশ্ব মঞ্চে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের আবির্ভাব এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরাজমান অস্থির অবস্থার মুহূর্তে চীনামন্ত্রীর এ উক্তি নিশ্চয়ই মঙ্গল বার্তা বহন সম, কেননা চীন ও ভারত দুটি পরমাণু ক্ষমতাসম্পন্ন দেশে যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ ফুটে উঠলে তার প্রতিক্রিয়া গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বাংলাদেশের জন্যও সমূহ বিপদ ডেকে আনবে, কেননা চীন এবং ভারত দুটি দেশই আমাদের এতো নিকটবর্তী যে সেখানে আণবিক বোমার বিস্ফোরণের ধ্বংসকর প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। তাছাড়া এ দুই দেশে যুদ্ধ হলে তাতে অন্যান্য দেশও জড়িয়ে পড়লে, তা বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে।
১৯৬২ সালে ভারত চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬২- র ভারত আর ২০২২- এর ভারতের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এমনকি ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও, যে কারণেই হোক, চীন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় শেষ পর্যন্ত ভারত আক্রমণ করতে সাহস পায়নি, পাকিস্তানের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও। ভারতে সামরিক শক্তির বৃদ্ধির সত্যটি এখন অনুভব করতে পারছে চীন। শুধু আণবিক ক্ষমতাই নয়, ভারত অন্যান্য অস্ত্র যথা- ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান যুদ্ধের জন্যও অনেকখানি এগিয়ে গেছে, চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে। এ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় চীনের অবস্থা একটু বেশি অগ্রগামী হলেও, ভারতকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো নয়, আর সম্ভবত এ সকল বিবেচনায়ই চীনের নতুন আহ্বান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- চীনকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়?
ইতিহাস ঘেঁটে চীনের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেশটির কথায় বিশ্বাস আনা কঠিন। চীন যে আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আয়তনের দেশ, তা কিন্তু চীনের আগ্রাসী এবং অন্যের ভূমি সামরিক শক্তি দিয়ে দখলের ফল। 'জিনজিয়াং' নাম দিয়ে চীন তুর্কি বংশোদ্ভুত যে অঞ্চলটি দখলে রেখেছে, সেটি চীনের সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী এলাকার একটি। সেখানে প্রচুর গ্যাস সম্পদে ভরপুর।
উইঘুর নামে পরিচিতি পাওয়া তুর্কি (আর্য)-দের একটি উপগোত্রের বিশাল জনগোষ্ঠি অষ্টম শতকে তাদের আদিভূমি পরিত্যাগ করে, চীনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায়, যা এখন তাকলা মাকন মরু অঞ্চল নামে পরিচিত এবং তারিম অববাহিকার আশেপাশে বসতি স্থাপন করে, যার নামকরণ করা হয়েছিল জুনগারিয়া এবং চিয়ানশোন।
পরে এলাকাটি পূর্ব তুর্কিমিনিস্তান এবং কখনো মোগলিস্তান নামেও পরিচিতি পেয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রিত এলাকা এক সময় চীনের দেয়াল থেকে পূর্ব কাজাকিস্তান এবং উত্তর কাজাগিস্তান থেকে দক্ষিণ সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এক সময় এ সম্প্রদায় তিব্বত এবং মঙ্গোলিয়ার অংশ বিশেষে রাজত্ব করেছে, যা 'উইঘুর খানেট' সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। তবে পরে চেঙ্গিস খান ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল এবং তুর্কি উপজাতিদের একত্র করে মোঙ্গল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করলে, উইঘুররা মোঙ্গল বশ্যতা মেনে নেয়। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার বংশধর কুবলাই খান চীনা অঞ্চলে ইউনান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও মোঙ্গল রাজা আরিক বোকার আলাদাভাবে উইঘুরদের বসতি এলাকা দখলে রেখেছিলেন।
অতপর চাগতাই খানেট নামে মোঙ্গল অধিপতিরা এলাকাটি বহু বছর দখলে রাখার পর ১৭ শতকে মাঞ্জুরিয়ান রক্তের ধারক চীনের কুইং রাজবংশের সম্রাটরা বহু বছর যুদ্ধ এবং ব্যাপক গণহত্যার আশ্রয় নিয়ে ১৭৫০ সালে কুখ্যাত জুনগারিয়া গণহত্যার মধ্য দিয়ে উইঘুরদের বসতভূমি দখল করে উইঘুরদের ওপর হত্যা ও ধর্ষণযজ্ঞ চালাতে থাকে। ১৭৬৫ সালে উইঘুর জনগণ মাঞ্জুরিয়ান কুইং শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে মাঞ্জু কুইং সম্রাটের নির্দেশে উইঘুর পুরুষদের হত্যা এবং নারীদের গণধর্ষণ এবং নারী ও শিশুদের দাসত্বে নেওয়া হয়। এরপর ১৮৬২ সালে উইঘুর জনগোষ্ঠি ইয়াকুব বেগের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে, যা ডানগান বিদ্রোহ নামে পরিচিত, কুইং সাম্রাজ্যের কর্মকর্তাদের উইঘুর অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে, কিন্তু ১৮৭৬ সালে চীনা সৈন্যরা উইঘুরদের অঞ্চল পুনর্দখল করে এর চীনা নাম দেয় 'জিন জিয়াং', যার বাংলা ভাষায় অর্থ 'নতুন রাজ্য'। উইঘুরদের ডানগান বিদ্রোহের মূলে ছিল ১৭৬৫ সালে চীনা কর্মকর্তাদের দ্বারা এক উইঘুর মহিলার গণধর্ষণের অপঘটনা। তখন চীনের মাঞ্জু সম্প্রদায়ের কুইং সম্রাটের নির্দেশে অগণিত উইঘুর পুরুষকে হত্যা করা হয়, অসংখ্য নারীকে গণধর্ষণ করা এবং দাসিতে পরিণত করা হয়, বহু শিশুকে হত্যা এবং দাস হিসাবে শৃঙ্খলিত করা হয়। এহেন নির্মমতা, অমানবিকতা, বর্বরতা এবং নির্যাতনের ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল।
এগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও দুঃখজনক হলো এই যে, ১৯১২ সালে জিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে মাঞ্জু বংশীয় কুইং রাজবংশের পতনের পর চীনে রাজতন্ত্রের অবসানের পরেও, এবং সব শেষে ১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কম্যুনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও উইঘুরদের উপর সেই মাঞ্জু-কুইং সম্রাটদের অনুকরণে চীনা শাসকরা এখনো চালাচ্ছে অমানবিক নির্যাতন, এখনো চলছে উইঘুর নারীদের গণধর্ষণ, চলছে গায়ের জোরে বন্ধ্যাকরণ, গণগ্রেপ্তার এবং বন্দিকরণ, তাদের ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির ওপর চলমান রয়েছে আক্রমণ। অঞ্চলটিকে নামেমাত্র স্বায়ত্তশাসিত বলা হচ্ছে। উইঘুর জনগোষ্ঠি তাদের হৃত স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার দাবিতে এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে, এবং উইঘুরদের উপর গণহত্যা ও গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে বিশ্ব বিবেক। যদিও তুরস্ক এবং পাকিস্তানসহ বহু দেশ চীনের বিরুদ্ধে কোন কথাই বলছে না, চীনের অর্থের দিকে তাকিয়ে।
চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের ইতিহাসেও রয়েছে নির্মমতার স্বাক্ষর।
ঐতিহাসিকভাবে তিব্বত কখনো চীনের অংশ ছিল না, তিব্বতীরা চীনের কোন সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, যদিও সময় সময় চীন এ অঞ্চল দখলে নিয়েছিল। এক সময় তিব্বত ছিল চীনের কুইং রাজের আশ্রিত রাজ্য, চীনের অংশ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে উপনিবেশ এবং আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা আলাদা। ১৯১২ সালে কুইং রাজ শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী কুইংদের সকল এলাকা চীনের সার্বভৌমত্বে চলে যায়। কিন্তু চীনের নতুন অ-রাজতান্ত্রিক সরকার তিব্বতের উপর তখনই তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। তিব্বত অতীতে তাদের ধর্মগুরু দালাই লামার শাসনাধীন ছিল, কুইং রাজবংশের পতনের পর দালাই লামা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে উল্লেখ করেন তিব্বত আর চীনের আশ্রিত রাজ্য নয়। সে সময় তিব্বত মঙ্গোলিয়ার সাথে চুক্তি করে উভয় দেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সে মোতাবেক চীন আন্তর্জাতিক আইনে একটি স্বাধীন সার্বভৌম মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। অষ্টাদশ শতকে চীনের কুইং রাজবংশ সামরিক বল প্রয়োগ করেই তিব্বতকে চীনের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল, যুংগার খানাটকে উচ্ছেদ করে, যুক্তরাজ্য যেমন বহু অঞ্চলকে উপনিবেশ না করে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল।
১৯১১-১২ সালে তিব্বত সেনাবাহিনী তিব্বতে অবস্থানরত কুইং গেরিসনে আক্রমণ চালায়। এরপর ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশ তিব্বতের সাথে চুক্তি করে তিব্বতের কেন্দ্রীয় এলাকা পরিত্যাগ করে। কুইং রাজবংশকে পরাস্ত করে চীনের নতুন সরকার তিব্বতের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অংশ হিসেবে দালাই লামাকে তার পদবী অক্ষুণ্ণ রেখে তিব্বতের উপর আধিপত্ত রক্ষার কথা বললে দালাই লামা পরিষ্কার বলে দেন তিনি তিব্বতের স্বাধীনতা ম্লান হতে দেবেন না। ১৯১৩ সালে সিমলাতে ব্রিটিশ, চীন এবং তিব্বতের মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন এবং চুক্তি হয়, যাতে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই যোগ দেয়, আর চীন স্বাক্ষর করেছিল সাক্ষী হিসেবে। এই চুক্তিও ব্রিটিশ এবং চীন কর্তৃক তিব্বতের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির প্রমাণ বটে।
৬ শতক থেকে, যখন অঞ্চলটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে, ঝিংঝং- এর ইয়ারলুং রাজ বংশের শাসনে তিব্বত সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ৭ম শতকে তিব্বত চীন দেশে দূতও পাঠিয়েছিল। ৯ শতকে তিব্বত সাম্রাজ্য বেশ শক্তিশালী ছিল, যা তখন তিব্বত মালভূমির বাইরেও এর ক্ষমতা প্রসারিত করেছিল। দাবি করা হয় বাংলার রাজা ধর্ম পালও তিব্বতের বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন। ১২ শতকে তিব্বতের দূত চেঙ্গিস খানের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে চেঙ্গিস তাদের আটক করে। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর অল্প আগে মোঙ্গলরা তিব্বতের কিছু অংশ দখলে নিলে তিবব্বতীরা চেঙ্গিস খানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও, ১২৪১ সালে উখেদাই খানের মৃত্যুর পর মোঙ্গল শাসকরা তাদের উত্তরাধিকারের অবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্য মঙ্গোলিয়ায় ফিরে গেলে সেই সুযোগে তিব্বত আবার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
তবে ১২৪৪ সালে মোঙ্গলরা পুনরায় তিব্বত আক্রমণ করে এবং ১২৪৯ সালে পুরো তিব্বত দখলে নেয়। মোঙ্গল ইউয়ান রাজবংশ তখন চীনে তাদের শাসন প্রসারিত করলেও মোঙ্গলরা তিব্বতকে ভিন্নভাবে শাসন করতো। তিব্বতে মোঙ্গল আধিপত্য ছিল পরোক্ষ, কেননা ধর্ম গুরু সাক্য লামাই ছিল ক্ষমতার উৎস। ১২৬০ সালে চেঙ্গিসের বংশধর কুবলাই খান তিব্বতের এক বৌদ্ধ গুরুকে তার ধর্ম শিক্ষক রূপে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইউয়ান রাজবংশের পতনের পর ১৪ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত দালাই লামারা তিব্বতের মূল শাসকে রূপান্তরিত হন। পরবর্তী ৪০০ বছর তিব্বত দালাই লামাদের শাসনে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। ১৭ শতকে স্বাধীন তিব্বত লাদাখও আক্রমণ করেছিল। ১৭২০ সালে চীনের কুইং রাজাগণ তিব্বত দখল করেছিলেন, যা ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এমনকি কুইং রাজারাও তিব্বত শাসন করতেন পরোক্ষভাবে, তিব্বতে আমবান নামক একটি রাজ প্রতিনিধির দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে। ক্ষমতা মূলত দালাই লামাদের হাতেই থাকতো, যারা কুইং রাজাদের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। ২০ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ এবং রাশিয়া তিব্বতের উপর নিজ নিজ প্রভূত্ব স্থাপনের চেষ্টার প্রতিযোগিতায় নামলে, ব্রিটিশ কর্নেল ফ্রান্সিস ইয়াং হাসবেন্ড তিব্বতে অভিযান চালিয়ে তিব্বতকে ব্রিটিশপন্থি এক বাণিজ্য চুক্তিতে বাধ্য করেন। তখন চীনের কুইং রাজাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন তারা তিব্বতের সার্বভৌমত্বের মালিক এবং এটিই ছিল আধুনিককালে তিব্বতের সার্বভৌমত্বের উপর প্রথম চীনা দাবি। এর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সৈন্যরা লাসা আক্রমণ করলে ১৩তম দালাই লামা মোঙ্গলিয়ায় এবং পরে বেজিংয়ে পালিয়ে যান ১৯০৮ সালে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ-তিব্বত চুক্তির পর ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ-চীন চুক্তি হয়। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ এবং রাশিয়া মেনে নেন যে, তারা চীনের মধ্যস্থতা ছাড়া তিব্বতের সাথে কোন আলোচনায় যাবেন না। এসব চুক্তি প্রমাণ করে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। ১৯১১ সালে চীনে কুইং রাজ্যের পতনের তাদের সকল সৈন্যরা তিব্বত ছেড়ে চলে যান। ১৯১২ সালে দালাই লামা তিব্বতে ফেরেন এবং কুইং-এর রাজ প্রতিনিধি আমবান এবং সকল চীনা সৈন্য বহিষ্কার করেন। ১৯১৩ সালে দালাই লামা এ মর্মে ফরমান জারি করেন যে চীন এবং তিব্বত কেউ কারো অধিস্তন নহে। পরবর্তী ৩৬ বছর তিব্বত মূলত স্বাধীন দেশ হিসেবে বিরাজ করে, যদিও ১৯৩০ সালে চীন তিব্বতের উপর দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৯১৪ সালে তিব্বত সরকার ব্রিটিশ সরকারের সাথে সিমলা চুক্তি সাক্ষর করে, যার ফলে বৃটিশ ভারত এবং তিব্বতের সীমানা বিভক্তির জন্য ম্যাকমেহন লাইন টানা হয়।
সেই চুক্তিতে চীন সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেছিল, যাকে তিব্বতের স্বাধীনতায় চীনা স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য করা যায়, যদিও পরবর্তীতে চীনের বিপ্লবী সরকার সিমলা চুক্তি এবং ম্যাকমেহন লাইন অস্বীকার করে, আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করে। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নতুনভাবে তার প্রাচীন নগ্ন আগ্রাসন নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জনগণ চীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর চীন তিব্বতিদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করে, এমনকি তাদের ফসল নষ্ট করে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। চীন তিব্বতের ভাষা ও সংস্কৃতির উপরও খড়গ চালাচ্ছে, যেমনটি করা হচ্ছে উইঘুর জনগোষ্ঠির উপর।
চীন যে ভূমি দখলের ব্যাপারে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও ছাড় দেয় না তার প্রমাণ- পাকিস্তানে গোয়েদার উপকূলে পাকিস্তানি দ্বীপ দখল, যার কারণে স্থানীয় লোকেরা চীনা নাগরিক এবং কনস্যুলেট অফিসে আক্রমণ চালিয়েছে। চীন নেপালের ভূমিও দখল করেছে বলে সম্প্রতি নেপাল সরকার অভিযোগ করেছেন। অথচ নেপালের সাথে চীন শুধু গভীর সখ্যতাই গড়েনি, নেপালে চীনা রাষ্ট্রদূত নির্লজ্জের মতো খোলাখুলিভাবে নেপালের রাজনীতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে, সফল হয়নি যদিও। সম্প্রতি চীন-ভুটানের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেছে বলে সেদেশের সরকার অভিযোগ করেছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশন এর বিধানসমূহ ভঙ্গ করে দক্ষিণ সাগর, সমুদ্র আইনের দৃষ্টিতে যা সকল দেশের জন্য উন্মুক্ত, চীন সেই মহাসাগরকে নিজ দেশের একক সার্বভৌম অংশ বলে দাবি করে বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা করছে, যার জন্য অস্ট্রেলিয়াসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই প্রমুখ রাষ্ট্রের সাথে চীনের অনেকটাই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এ প্রেক্ষাপটেই ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা এবং কোয়াড মোর্চা গড়ে উঠেছে। চীন তাইওয়ান দখলেরও অপচেষ্টায় লিপ্ত। দেশটি এখনো আন্তর্জাতিক আইন খেলাপ করে, ম্যাকমেহন লাইন অস্বীকার করে ভারতের অংশ বিশেষ শুধু দাবিই করছে না, সেখানে প্রতিনিয়ত আক্রমণও চালাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটি দেশ অন্য একটি দেশকে নিজের দখলে নিলে, দখলকৃত দেশ অতীতে যে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তা মেনে নিতে বাধ্য। সেই অর্থে চীন ১৯১৪ সালে সিমলা চুক্তি এবং ম্যাকমেহন লাইন মানতে বাধ্য বটে। তাছাড়া ১৯৫৮ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই 'হিন্দি-চিনি ভাই ভাই' তত্ত্বের প্রতি সমর্থন দিয়ে ম্যাকমেহন লাইন সাদৃশ্য একটি সীমানার প্রতি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, যা 'নিয়ন্ত্রণ রেখা' হিসেবে পরিচিত। তারপরও চীন সেই 'হিন্দি-চিনি ভাই ভাই' তত্ত্বের ওপর ছুরিকাঘাত করে আকস্মিকভাবে ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ করে তাদের নগ্ন আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবমাননার কথা প্রমাণ করে। যে চীন এখনও প্রতিনিয়ত ভারতের সীমানা লংঘন করছে, সীমানায় সেনা মোতায়েন এবং ছাউনি গড়ে তুলছে, সে দেশটি কিভাবে ভারতকে তাদের অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়, তা গবেষণার বিষয় বৈকি। এ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রীংলা যথার্থই উল্লেখ করেছেন সম্পর্কের উন্নতির জন্য সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্বস্তির পরিস্থিতি আবশ্যক এবং ভারত-চীন সম্পর্কের ভিত্তি হবে পারস্পরিক সম্মান, স্পর্শকাতরতা ও স্বার্থ। এরই মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং মরিশাস সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা, সুরক্ষা, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবেলার জন্য যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তা একটি নুতন কোয়াডেরই প্রতিরূপ, এতে বাংলাদেশ ও সিসিলি পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে।
অর্থাৎ একটির জায়গায় এখন দুটি কোয়াড হলো। আমাদের সৌভাগ্য চীনের সাথে আমাদের সীমান্ত নেই। থাকলে চীন আমাদের ভূমিও দখল করতো। চীন একই নীল-নকশা নিয়ে সিরিয়ায় অনুপ্রবেশের চেষ্টায় লিপ্ত বলে খবর পাওয়া গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে এই এলাকায়, তথা বিশ্বময় যুদ্ধের পদধ্বনি বন্ধ করতে হলে চীনকেই অন-আগ্রাসী ভূমিকা বর্জন করতে হবে, আন্তর্জাতিক মহাসাগরে তাদের বে-আইনি দাবি পরিত্যাগ করতে হবে, ভারতের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাবও পরিবর্তন করে এই অঞ্চলে শান্তির পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।