Published : 17 Feb 2022, 04:56 PM
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকশন ১৩ ফেব্রুয়ারি (২০২২) ঢাকায় মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে বলেছেন- জবাবদিহি এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনসহ যে দেশে অবাধ ও গণতান্ত্রিক সমাজ থাকে, সেখানেই দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা দেখা যায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিকশিত হয়।
বাংলাদেশকে ব্রিটিশ হাইকশিনার খুব ভাল করেই জানেন যে তার দেশ আমাদের এ ভূখণ্ডকে একটানা ১৯০ বছর শাসন-শোষণ করেছে। 'মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান'- এ গান তো ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য আত্মদান করা বীরদের স্মরণ করেই লেখা।
১৯৪৭ সালে যখন তারা ভারতবর্ষ ছেড়ে যায়, 'এক সময় সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা' এ ভূখণ্ড ছিল অর্থনীতি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবায় মারাত্মকভাবে পিছিয়ে। প্রায় সবকিছুতে পরনির্ভর। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। খাদ্যে প্রচুর ঘাটতি। শতভাগ শিক্ষিতের দেশ ব্রিটেনের অনুসৃত নীতির কারণে আমাদের দেশের ৫ শতাংশ নারী-পুরুষও ভালভাবে লিখতে-পড়তে পারতেন না।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ১৯৪৭ সালের পর আরও দুই যুগ সহ্য করতে হয়েছে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের নিষ্ঠুর শাসন- শোষণ। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে লোকসংখ্যা বেশি, রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পাট উৎপন্ন হয় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজধানী, সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সদর দপ্তর- সব অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙালিকে বলা হলো- উর্দু শিখতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। 'ইসলামী সংহতির জন্য' এর বিকল্প নেই। আর্মি-নেভির জন্য বাজেটের অর্ধেক বেশি ব্যয় হয়। কিন্তু এই বাজেটের ৯০ ভাগের বেশি হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
বাঙালিরা প্রতিবাদী হয়। রাজপথে সোচ্চার হয়। দমননীতি তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশেষভাবে এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন ভাল করেই জানেন- পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও এ ভূখণ্ডে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও ছিল না। বাংলাদেশের অস্তিত্বের পাঁচ দশকের প্রায় তিন দশক শাসনকার্য পরিচালনা করে সামরিক শাসক এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। এ সব অপশক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পূর্ণ সমর্থন ভোগ করেছে। বলা যায়, কেবল ২০১৪ সালের 'বিতর্কিত' ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে।
হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ; সঙ্গে মিছিল-সমাবেশ- এ সব বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ জীবনের অপরিহার্য অংশ। 'সাত দশকের হরতাল ও বাংলাদেশের রাজনীতি', এই শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেছি ২০১৮ সালে। বাংলা একাডেমি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এ গ্রন্থে ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল- এই ৭০ বছরের জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় হরতাল এবং প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিবরণ রয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ২০১৫, এই সময়কালে জাতীয় পর্যায়ে অন্তত ৬০৫টি হরতালের কথা জানতে পেরেছি সংবাদপত্রের সূত্রে। আর এ সময়ে স্থানীয় হরতাল হয়েছে অন্তত ১৬১৯টি।
২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ ডেকেছিল। জনগণের তরফে এ কর্মসূচিতে সাড়া মেলেনি। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়- 'হরতাল-অবরোধে যানজট'। ১৫ মার্চ (২০১৫) 'সমকাল' পত্রিকা প্রতিবেদনে বলা হয়- 'অবরোধ কার্যকর নেই, পেট্রল বোমা আছে'। যানবাহনে পেট্রলবোমা কিংবা ককটেল বিস্ফোরণ ছাড়া কোথাও নেই বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধের চিহ্ন। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক। ট্রেন চলছে সময়সূচি অনুযায়ী। নেই কোনও মিছিল-সমাবেশ। স্বাভাবিক সময়ের প্রতিচ্ছবি সর্বত্র। সমকাল ৬ এপ্রিল লিখেছে- 'অবরোধের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে ৫ এপ্রিল। জনজীবনে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই। তিন মাসে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে ১৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।'
রবার্ট ডিকসনের ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই চায় না যে বাংলাদেশে পেট্রল বোমার যুগ ফিরে আসুক। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে পৌঁছে যাচ্ছে- এ উত্তরণের পেছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রধান নিয়ামক, সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটানা ১৩ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তার দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্ব বিশ্বসমাজ স্বীকার করে নিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ করবো নিজস্ব অর্থে- বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেই এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বব্যাংক এ সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছিল, সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো লিখেছে, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত। রায়ের বিচারক লিখেছেন- অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছু নয়।'
অথচ ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুতে ঋণচুক্তি বাতিলের পর বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'ভবিষ্যতে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ঋণ পেতে হলে বাংলাদেশকে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার তো করতেই হবে, একইসঙ্গে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যা অনুষ্ঠিত হয়) কোন পদ্ধতিতে হবে এবং তা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে কী-না সে বিষয়েও শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।'
বিশ্ব্যাংকের সে সময়ের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, সে বিষয়ে তার কাছে বাংলাদেশের অঙ্গীকার দাবি করেছিলেন। এর এক যুগ পর বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন (২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকায় দাবি করছেন, 'বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক এবং নির্দলীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন পরিচালনাসহ অবাধ ও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের জোরালো অঙ্গীকার নির্বাচনকালীন প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে।' [প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২]
তিনি 'সব রাজনৈতিক দলের' কথা বলেছেন। যারা ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল এবং যারা তা সমর্থন করেছিল, তাদেরকেও তিনি রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছেন? যে জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এবং যে দলের নেতা-কর্মীরা গণহত্যা-ধর্ষ-লুটপাটে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল- তাদেরকেও কি বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার প্রদানের পক্ষে তিনি সওয়াল করছেন?
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে যারা চক্রান্ত করেছিল, যারা ধর্মের নামে অনাচার করে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দাবি তোলে তাদের জন্য কি তিনি রাজনৈতিক অধিকার দাবি করেন?
বিএনপির গঠনতন্ত্রে একটি ভালো ধারা ছিল- দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলে কেউ জাতীয় বা স্থানীয় কোন ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না এবং দলে কোনো পদ পাবে না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি গঠনতন্ত্র থেকে এ ধারাটি বাদ দিয়েছে।
বিবিসির আকবর হেসেন ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই তারেক রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন।
বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ 'কারাগারে কেমন ছিলাম' (২০০৭-২০০৮) গ্রন্থে লিখেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারেটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শুধু দুই ছেলের মুক্তি নয়, তাদের বিদেশে পাঠানোর বিষয়েও খালেদা জিয়া ছিলেন অনড়। বিদেশ যাত্রার কয়েক ঘণ্টা আগে তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্মমহাসচিবের পদ থেকে ইস্তফা দেন।'
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান কেবল দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হননি, তারা দণ্ডিত হয়েছেন এবং সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেও হেরে গেছেন। বিএনপি কীভাবে তাদের দলের শীর্ষপদে আসীন করল? রবার্ট ডিকসন কি তার দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইতে পারেন না যে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত ব্যক্তি কীভাবে লন্ডনে বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে?
বিএনপি রাজনীতিতে সন্ত্রাসের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনার সরকারকে অসাংবিধানিক পন্থায় উৎখাতের জন্য তারা বার বার সহিংস পথ অনুসরণ করেছে। এ দলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী জামায়াতে ইসলামীকে ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোটের অংশ করেছে। জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক অপশক্তিকেও বিএনপি প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। যে র্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গাত্রদাহ, সেই বাহিনী বিএনপির আমলেই সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ সবার জানা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক ভয়ংকর সব অপরাধ দমনে এ বাহিনীর সাফল্য সকলেই স্বীকার করে। একটি 'মানবাধিকার সংগঠনের' শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, 'র্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে তারা কয়েকটি স্থানে অনুসন্ধান করেছেন। দেখা গেছে, র্যাবের কৌশল সমর্থনযোগ্য না হলেও যে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে স্থানীয় জনগণ বেজায় খুশি। কিন্তু "র্যাবের পক্ষে যাবে" বিধায় এ রিপোর্ট প্রকাশ করা যায়নি।'
কেবল পেট্রলবোমা সন্ত্রাস নয়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা ট্রিবিউন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর লিখেছে-
According to both FBI and RCMP reports, Moudud played a key role behind Canada-based Niko securing the contract to explore gas fields in Bangladesh. BNP Chairperson Khaleda Zia, then the prime minister, and her son Tarique Rahman received a part of kickbacks via a proxy, paid by the Canada-based Niko Resources Ltd to get lease of some Sylhet gas fields, an investigation conducted by the US Federal Bureau of Investigation (FBI) has found. According to the investigation reports, seen by the Dhaka Tribune, BNP leader and the then law minister Moudud Ahmed played a key role behind Canada-based Niko securing the contract.
বিএনপির কয়েকজন নেতার নাম এসেছে প্যারাডাইস পেপার, পানামা পেপারস ও প্যান্ডেরা পেপারস- এ। তারা বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করেছেন, এমন তথ্য রয়েছে এতে। বিএনপির সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন অনেকেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করেন। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা আমদানি-রপ্তানির সুযোগ নিয়ে অর্থ পাচার করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছেন, এমন ব্যক্তিরাও এ অভিযোগে অভিযুক্ত।
কিন্তু বিষয়টিকে অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। যে সব দেশে অর্থ পাচার হয় বাংলাদেশ এবং আরও অনেক দেশ থেকে, সে সব দেশের সরকারও কেন এর দায় বহন করবে না? কোন দেশ থেকে অন্যায়ভাবে কেউ অর্থ পাচার করে অন্য দেশে নিয়ে গেলে সেটা অপরাধ। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়ার সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এ অপরাধে যুক্তদের নিজ নিজ দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে না? কানাডায় 'বেগম পাড়া' গড়ে তুলতে অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। যারা এ অর্থ নিজ নিজ দেশ থেকে পাচার করে নিয়েছেন অন্যায়ভাবে, তাদের কেন শাস্তি দেওয়া হয় না?
আরেকটি বিষয় বলি। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট ডিকসন ১৩ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, বিনিয়োগকারীরা দেখতে চায় যে দেশে তারা অর্থ খাটায় সেখানে আইনের শাসন রয়েছে কিনা। খুব ন্যায্য কথা। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে যে উপনিবেশে পরিণত করেছিল, সেটা আইনের শাসন অনুযায়ী হয়েছিল- এমনটি কেউ বলবে না। কিন্তু তাতে বিনিয়োগ আটকে থাকেনি। বাংলাদেশ থেকে যে সব পোশাক ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডায় যায়, তার উৎপাদক-মালিকরা নির্মম শোষণ করে শ্রমিকদের ওপর। এই পোশাক উন্নত দেশগুলোর বায়াররা কিনে নেয় এবং বিপুল মুনাফা করে। এই শোষকদের বিরুদ্ধে রবার্ট ডিকসনের ব্রিটিশ সরকার কিংবা জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র সরকার কি কোনো ব্যবস্থা নেয়?
রবার্ট ডিকসনের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, বহু বছর বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখন দৃশ্যপট দলে গেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জরিপ সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ একটি পয়সাও ঋণ পায়নি। এক সময় খাদ্য সহায়তা মিলত। অন্য খাতে অনুদানও মিলত। কিন্তু এখন বাংলাদেশ কারও কাছে হাত বাড়ায় না ঝড়-বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে। বাংলাদেশ নিজের খাবার নিজে উৎপাদন করে। আমদানি ব্যয়ের অর্থ মেটাতে আইএমএফ-এর কাছে হাত পাততে হয় না। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পে নিজেই অর্থের ব্যবস্থা করতে পারে।
এমন চিত্র কি কারও গাত্রদাহ তৈরি করে?
২০১৯-২০ বা ২০২০-২১ অর্থ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন বাংলাদেশকে একটি পয়সা ঋণ না দিলেও চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান প্রচুর ঋণ সরবরাহ করেছে বাংলাদেশকে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাশিয়া দিয়েছে ৮৫ কোটি ডলার, চীন দিয়েছে ৪০ কোটি ডলার। জাপান এবং ভারতও ঋণ দিয়েছে প্রচুর পরিমাণে। তাদের রাষ্ট্রদূতরা কেউই কিন্তু মিট দ্য প্রেস আয়োজন করে বাংলাদেশ কী করবে এবং কী করবে না, তার ছবক দেয় না। তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার যেমন জানে, তেমনি বদলে যাওয়া বিশ্বকেও অনুভব করতে পারে।