Published : 12 Feb 2022, 07:15 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে অন্যান্য বিভাগের (ক, খ, গ) ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে 'ঘ' ইউনিটে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত গত কয়েক দিনে মিডিয়ায় এসেছে এবং 'ঘ' ইউনিটে ভর্তি আসলে কীভাবে হবে সেই প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। সাব-কমিটি তৈরি করা হয়েছে এ বিষয়ে মাত্র, তারা পরীক্ষার আগে নিশ্চয়ই কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন।
'ঘ' ইউনিটটি ব্যবহৃত হয় এক অনুষদ থেকে অন্য অনুষদে ভর্তি হতে। এটা মূলত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ব্যবসায় শিক্ষা, কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে যেতে ব্যবহার করে। আবার, ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে কলা বা সামাজিক বিজ্ঞানে আসতে। আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলাম ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত এবং 'ঘ' ইউনিটের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞানে এসেছিলাম। অর্থাৎ, এই সদ্য বিলুপ্ত 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাটি ২০০৫ সালে আমাকেও দিতে হয়েছিল। পরীক্ষাটি মূলত চার ভাগে ভাগ করা থাকত; অর্ধেক অংশ থাকত সাধারণ জ্ঞানের ওপর– আন্তর্জাতিক এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে। অনেকটাই বিসিএস পরীক্ষার মতো সিস্টেমে নেওয়া হতো। এই পরীক্ষাটির প্রিপারেশন নিতে আমি কয়েক মাস ঘরবন্দী হয়ে বহু দেশের নদী-ফুল-ফল-লতা-রাজধানীর নাম মুখস্থ করেছিলাম। তাতে আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার কত বেড়েছে জানি না, কিন্তু পরীক্ষাটিতে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে আমি কিছু পোস্টারে ছবি পেয়েছিলাম। দুয়েকটি কোচিং সেন্টারে সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলাম।
সংক্ষেপে, বলতে চাচ্ছি, এই পরীক্ষাটি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। পরীক্ষাটি যেভাবে নেওয়া হয়, তাতে একজন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কীভাবে সামাজিক বিজ্ঞানে ভর্তির জন্য তৈরি হয়, তা এই সিস্টেমের মধ্যে থেকে গিয়েও আমি বুঝিনি। আমি কতটা ভালো অর্থনীতিবিদ বা পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট হতে পারি, তা নিশ্চয়ই আমি কত ভালো বিভিন্ন দেশের মুদ্রার নাম মুখস্থ করতে পারি, এর উপর নির্ভর করে না। তবুও, পরীক্ষাটি নতুনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ না রেখে এবং কোনো সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা না দিয়ে হঠাৎ করে বাতিল করে দেওয়ার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরদর্শিতা দেখতে পাচ্ছি।
প্রথমত, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সিস্টেমটি আজও অনেকটাই বিভ্রান্তিকর। একটা প্রচণ্ড মানসিক এবং শারীরিক চাপের মধ্যে থেকে আমাদের তরুণ-কিশোরদের যেতে হয়। তার ওপর আছে বিশাল অর্থ অপচয়ের প্রশ্ন। ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে বদলানো দরকার। কিন্তু বাতিল করার আগে ভাবতে হবে আমাদের বিকল্প কী– আমরা কী বদলাতে চাচ্ছি এবং কেন। আমাদের মূল লক্ষ্য কী এবং কোন সাবজেক্টের জন্য বিশেষ কী প্রয়োজন। আমার প্রস্তাবনায় ভর্তি পরীক্ষা 'কেন্দ্রিক' হতে পারে, যেভাবে বাইরের অনেক দেশেই হয়। স্যাট-এর মাধ্যমে আমেরিকান স্কুলগুলো সারা দুনিয়া থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে। এতে প্রশ্ন থাকে জেনারেল লজিকের ওপর, ইংরেজিতে দক্ষতার ওপর এবং রাইটিং কম্পোজিশনের ওপর। সাবজেক্ট ওরিয়েন্টেড করতে চাইলে একে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ভিত্তিকও করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনও একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান থেকে অর্থনীতিতে আসতে চাইলে দেখা হবে সমাজ এবং অর্থনীতি বিশ্লেষণের মতো কাজে তার নলেজ কতখানি। আবার ইংলিশে আসতে চাইলে দেখা হবে তার সাহিত্যের নলেজ কতখানি এবং আগ্রহ কতখানি। কিন্তু একজন ছাত্র 'ক' ইউনিটে ফিজিক্স/কেমিস্ট্রি পরীক্ষা দিয়ে 'ঘ' ইউনিটে অর্থনীতি/ফাইন্যান্সে কীভাবে আসবে, এই প্রস্তাব খুবই অপরিষ্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরিষ্কার প্রস্তাব আশা করছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনে এটা অনেক বড় একটা ধাপ, খেয়ালমত পরিবর্তন করা উচিত হবে না।
আমাদের আরেকটি মূল সমস্যা হলো ভর্তি পরীক্ষার পর আমরা শিক্ষার্থীদের সাবজেক্ট চয়েসের একটি মাত্র সুযোগ দেই। কোনও ক্লাস না করে, কোনও আইডিয়া ছাড়া আমাদের মেজর ঠিক করে ফেলা হয় ১৮/১৯ বছর বয়সে। এবং, মোটামুটি সাবজেক্টটি ভালো না লাগলে বা আগ্রহ না জন্মালে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা ভিন্ন উপায় থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর ভাবা উচিত আমরা কীভাবে এর থেকে উত্তরণ করতে পারি। সাবজেক্ট চয়েস ইমিডিয়েট না করে এক বা দুই সেমিস্টার পরে কি করা যেতে পারে? প্রথম ১/২ সেমিস্টার কি আমাদের শিক্ষার্থীরা সব বিভাগে সাবজেক্ট নিয়ে নিজের পছন্দমতো যোগ্যতা অনুযায়ী কিছুতে মেজর করতে পারে? মেজর পরিবর্তন করার সুযোগ না রেখে আমরা অনেক তরুণকে হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাবজেক্ট চয়েস এবং পরিবর্তনের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো হঠকারিতার মাধ্যমে দ্রুত না নিয়ে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে, প্রয়োজনে এক্সপেরিমেন্ট করে ধীরে ধীরে নেওয়া উচিত। প্রতিটা পরিবর্তনের পেছনে যত্ন এবং বৈজ্ঞানিক ভাবনার দরকার আছে। হঠাৎ করে 'ঘ' ইউনিটের পরীক্ষা বাতিল করা এবং বাতিল করে নতুন কী পদ্ধতি নেওয়া হবে তার কোনও বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত না নেওয়াকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনে করছি না। এটা আমাদের ছাত্রদের আবারও 'গিনিপিগ' বানানোর একটি উপায় হয়ে যেন না দাঁড়ায়।