Published : 11 Feb 2022, 05:32 PM
ভারতের সুর সম্রাজ্ঞী নামে যথার্থই পরিচিত তিনি, ৩০ হাজার গানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক গানের গায়িকার স্বীকৃতি পেয়েছেন গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। তিনি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের বহুসংগীত প্রেমির মন ভেঙে দিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ৯২ বছর বয়সে তার প্রস্থানের বয়স হলেও তার প্রস্থানকে অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারছেন না কারণ তার স্থান পূরণ হওয়ার নয়।
মারাঠি ভাষার এই সংগীত কিংবদন্তি মূলত হিন্দি গানের গায়িকা হলেও বাংলাসহ তিনি ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষায় গান করে হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা, পেয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ খেতাব 'ভারত রত্ন'। তার কণ্ঠস্বরই তার সাফল্যের বড় কারণ, যার জন্য তিনি পেয়েছিলেন 'কোকিল-কণ্ঠি' পরিচয়। ছোট বেলা থেকে যে সব গায়ক-গায়িকার গান শুনে বড় হয়েছি, তাদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত মুখোপধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সতিনাথ, মানবেন্দ্র, লতা, সন্ধ্যা, গিতা দত্ত, প্রতিমা বন্দোপধ্যায়, উৎপলা, আলপনা, মান্না দে, শচিন কর্ত্তা, মোহাম্মদ রফি প্রমুখ। তালিকার শীর্ষে ছিলেন হেমন্ত, লতা, সন্ধ্যা, গিতা, প্রতিমা আর তাই তাদের বিষয়ে নষ্টালজিয়া এবং আবেগের অনুভূতি থাকাই স্বাভাবিক যার কারণে লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণ এবং সন্ধ্যা মুখোপধ্যায়ের অসুস্থতা, উভয়ই আমাদের নিক্ষেপ করেছে বেদনার সমুদ্রে।
৬০-এর দশকে তৈরি মোঘল-ই-আজম ছবিটি আর্থিক অর্জনে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গের পেছনে নিশ্চিতভাবে লতার গাওয়া 'পেয়ার কিয়াতো ডরনা কিয়া' গানটি এবং তার সাথে মধুবালার নাচ, যে বহুলাংশে কৃতিত্বের দাবিদার তা অনস্বীকার্য। সাজা ছবিতে তার গাওয়া 'তুম না জানে কিস জাহা মে খো গায়ে' গানটিকে কোনদিনও কেউ হার মানাতে পারবে না। তার গাওয়া হিন্দি গান 'আয়গা আনে ওয়ালি', নাগিন ছবির 'মান দোলে', 'ইয়ে জিন্দে উসি কি হ্যায়, 'আজারে পরদেশি', পাকিজা ছবির গান 'চালতে চালতে', 'এক পেয়ার কি নগমা হ্যায়', 'জো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পরেগা' (মোহাম্মদ রফির সাথে দ্বৈতকণ্ঠে) প্রভৃতি গান কখনোও ম্লান হওয়ার নয়। বাংলা সংগীত জগতে তার আগমন ঘটে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে 'আকাশ প্রদীপ জ্বলে' গানের মাধ্যমে যে গানটি শুরুতেই বাজিমাত করেছিল। পরে তিনি বহু বাংলা গান গেয়েছেন সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শচীন দেব বর্মণের সুরে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- 'না যেও না, রজনি এখনো বাকি', 'প্রেম একবার এসেছিল নিরবে', 'নিঝুম সন্ধ্যায়', 'ও পলাশ ও শিমুল', 'মোর ময়না গো', 'গোপী যেন মনোচোর', 'রঙিলা বাঁশিতে কে ডাকে', 'কে প্রথম কাছে এসেছে', 'কত যে কথা ছিল', ক্ষুদিরাম ছবির গান 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি', 'সাত ভাই চম্পা জাগরে', 'যারে উড়ে যারে পাখি', দ্বীপ জ্বেলে যাই ছবিতে 'আর যেন নেই কোন ভাবনা', 'কেন কিছু কথা বলো না', 'না মনো লাগে না', 'নদীর দুই কিনারে', 'বাঁশি কেন গায়, আমারে কাঁদায়', 'মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে', 'ছন্দে যে তুই', 'আমি যে কে তোমারই' , 'ভালবাসার আগুন জ্বেলে', 'আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন', 'চল মন আনমনা', 'যদিও রজনী', 'ওগো আর কিছুতো নয়' সহ আরো অনেক গান।
বেশ কিছু রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন লতা। যার মধ্যে ভানুসিংহের পদাবলির 'শাওন গগণে ঘোর ঘনঘটা', 'মরণ রে তুহু মম শ্যাম সম" এবং আরো অনেক। বেশ কটি পল্লীগীতি এবং ভাটিয়ালি গানও তিনি গেয়েছিলেন, ঠিক আব্বাস উদ্দিনের স্টাইলেই। অনেকে ভেবে থাকেন বাংলার সুর সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখার্জির সাথে লতার বৈরিতা ছিল, যেটি ঠিক নয়। তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ জন ছিলেন বলে বর্তমানে চিকিৎসারত সন্ধ্যাকে লতার মৃত্যু সংবাদ দেয়া হয়নি। 'তারানা' নামক ছবিতে এই দুই কিংবদন্তি শিল্পী দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন হিন্দি গান 'বোল পাপিহে বোল'। লতাজি সন্ধ্যার মতো অতটা কঠোর অসাম্প্রদায়িক না হলেও, তিনিও যে বহুলাংশে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তার বহু প্রমাণ রয়েছে। সন্ধ্যা যেমন মুসলিম ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির হাতে তালিম নিয়েছিলেন, লতাও তেমনি ওস্তাদ আমানত খাঁর এবং পরবর্তীতে নূরজাহানের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। জীবনের একটি বড় সময় তিনি মোহাম্মদ রফির সহশিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। ভারতের কঠোর অসাম্প্রদায়িক গীতিকার সাহীর লুধিআনভির গীত রচনায় তিনি 'আল্লাহ তেরে নাম, ঈশ্বর তেরে নাম' গানটি গেয়ে ভারতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাছাড়া ভারতের চিত্রজগতে খ্যাতনামা মুসলিম অভিনেতা ইউসুফ খান (দীলিপ কুমার), শাহরুখ খান, সালমান খান এবং আমির খানের সাথে ছিল তার গভীর সখ্যতা। বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনের সাথেও ছিল তার সখ্যতা । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যোদ্ধা এবং পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের জন্য মোহাম্মদ রফি, হেমন্ত, সন্ধ্যা, কিশোর কুমার, মান্না দে, মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্র, সতিনাথ প্রমুখের সাথে গান গেয়ে অর্থ তুলেছিলেন, যার কারণে তাকে ২০১২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি এবং সম্মাননা পদক দেয়। আমাদের মুক্তির পরপরই ১৯৭২ সালে তিনি মাদার ইন্ডিয়া খ্যাত চিত্রনায়ক, একই ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী নার্গিস দত্তের স্বামী, পরবর্তীতে ভারত সরকারের মন্ত্রী, সুনীল দত্তের সাথে বাংলাদেশে আগমন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তার সাথে সাক্ষাত করে। সে সময়ে তিনি বাংলাদেশে তৈরি 'রক্তাক্ত বাংলা' ছবির জন্য সলিল চৌধুরীর সুরে ' ও দাদাভাই মূর্তি বানাও' গানটি গেয়ে বাংলার মানুষের আরো কাছে পৌঁছে ছিলেন। তিনি বিশ্বের বহু দেশে গান গেয়েছেন, সম্মাননাও পেয়েছেন অগণিত। অনন্য মধুর কণ্ঠস্বর নিশ্চিতভাবে তার সাফল্যের মূল হলেও সেটিই যে একমাত্র সম্বল ছিল, তা নয়। কেননা ঠিক হুবহু কণ্ঠস্বরের অধিকারিনী আরেক মারাঠি শিল্পী সুমন কল্যাণপুর কিন্তু লতার কাছাকাছিও যেতে পারেননি। অনেকে অবশ্য মনে করেন লতার সাথে কণ্ঠের মিলের কারণেই সুমন বেশি দূর উঠতে পারেননি। তার দুই সহোদরা আশা ভোসলে এবং উষা মঙ্গেশকর সংগীত শিল্পী হলেও লতার উচ্চতার কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। ভারতীয় সংগীত জগতের তিন বাঙালি প্রবাদ পুরুষ হেমন্ত মুখোপধ্যায়, সলিল চৌধুরী এবং কিশোর কুমারের সাথে ছিল লতার রাখি-বন্ধনের মতোই হৃদ্যতা। হেমন্ত সংগীত পরিচালক হিসেবে লতাকে দিয়ে যত গান গাইয়েছেন, সন্ধ্যা অথবা গিতা দত্তকে দিয়েও ততো গান করাননি। যে দুটি হিন্দি ছবির সংগীত পরিচালনা করে হেমন্ত ভারতের শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, সেই ছবি দুইটি যথা 'নাগিন' এবং 'বিশ সাল বাদ' ছবিতে নারী কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন লতা, যার মধ্যে 'মান দোলে' গানটি চিরঞ্জীব হয়ে আছে, চিরঞ্জীব হয়ে আছে 'মেরা দিল ইয়ে পুকারে- আজা' গানটিও।
তার মহাপ্রয়াণে শুধু যে এই উপমহাদেশের জনগণ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজনই শোক সাগরে ভেসেছেন, তা নয় তার মৃত্যু গোটা বিশ্বের বহু ভাষার বহু মানুষকে ব্যথিত করেছে। মানবী লতা মঙ্গেশকর চলে গেলেও তার স্মৃতি থাকবে চিরজাগ্রত। কবিগুরুর ভাষায় মানুষ আজীবন বলবে 'নয়নসমুখে তুমি নাই,/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই'।