Published : 06 Nov 2021, 07:38 PM
বিজিবিতে চাকরি করতো ছেলেটি। মধ্যবিত্ত মা–বাবার হয়ত শিক্ষিত পুত্রটিকে নিয়ে অনেক আশা ছিল। ভালো চাকরি করে সে নিজে ভালো থাকবে, বিয়ে করে সংসার সাজাবে। বাবা–মাকে দেবে অর্থনৈতিক এবং মানসিক শান্তি। কিন্তু বাস্তবে তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। ছেলেটি যা আয় করতো তা দিয়ে জীবন চললেও মানসিক শান্তি ছিল না। মায়ের চিকিৎসার খরচ চালানো, একদিন শখ করে একটু ভালো খাওয়া, কারও জন্য পছন্দ করে একটা উপহার কেনা – এই ছোটখাট চাহিদা ও শখগুলো তার পূরণ হচ্ছিল না। তাকে সবসময় নানাবিধ খরচ চালানো নিয়ে চিন্তায় থাকতে হতো। মানসিক এই চাপ নিতে না পেরে সস্প্রতি ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। পত্রিকার পাতায় তার হাসিমুখ ছবিটার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মফস্বল থেকে আসা বন্ধুদের চেহারা মনে পড়ছিল। হাসিখুশি কিন্তু একটু লাজুক, পরিচ্ছন্ন পোশাক গায়ে, সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল – মফস্বলের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষিত ছেলেরা বোধহয় এ রকমই দেখতে হয়।
অর্থনৈতিক চাপ আর একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করতে না পারার কষ্ট নিয়ে শারিরীকভাবে এ তরুণটি মরে গেল। কিন্তু এ সমাজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরা মানসিকভাবে মারা যায়। সেই কৈশোরে বা যৌবনের শুরুতে জহির রায়হান বা হুমায়ূন আহমেদের বইতে নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ, কবি, শিক্ষকদের গল্পের নায়ক হিসেবে পেতাম। শিক্ষিত এবং যোগ্য হওয়ার পরও তারা স্বল্প টাকা বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হতেন। কোনোমতে চলা সংসারে প্রতিনিয়ত নানাবিধ মানসিক কষ্টে গুমড়ে মরতেন। ভাবতেই অবাক লাগে এখনও এ দেশে অসংখ্য নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবার সেই একই পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করে। হ্যাঁ, দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। বেতন স্কেল এবং গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। যোগ্যতা এবং পছন্দ অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার সুযোগও এখন যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু একই সঙ্গে সমাজে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যের দাম, চিকিৎসাব্যয়সহ জীবনযাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় সব খরচ। ফলে আয় বাড়ছে ঠিকই কিন্তু তা দিয়ে পরিবার নিয়ে একটু স্বাচ্ছন্দে দিন কাটানো, নিজের মনের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করা, সন্তানকে একটু ভালো পরিবেশে বড় করা – এই সামান্য কিন্তু স্বস্তিময় জীবনের যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো এখনও অসংখ্য পরিবার পূরণ করতে পারছে না।
উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে দেশে অতিদারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ১০.৫ শতাংশে, মাত্র ২০ বছর আগে অর্থাৎ ২০০০ সালে এই হার ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ গতবছর কোভিড–১৯ অতিমারি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর আমরা দেখলাম পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে অসংখ্য গরীব পরিবার গরীবতর হলো। দারিদ্রসীমার একটু উপরে থাকা অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে দরিদ্র ক্যাটাগরিতে চলে এলো।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতি পুনরায় গতিশীল হয়ে উঠেছে, কিন্তু আয় হারানো জনগোষ্ঠীর সবাই তাদের পুরনো পেশায় ফেরত যেতে পারেননি বা তাদের সকলের কর্মসংস্থানও হয়নি। কোভিড–১৯ অতিমারি তাই আমাদের সামনে দারিদ্র্যের একটি নতুন বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশিত করেছে। শুধু খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারার নাম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি নয়। বড় কোনো অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক অভিঘাত বা বিপর্যয় আঘাত হানলে তা মোকাবিলা করে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ধরে রাখতে পারাটাও টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম সূচক। তাই, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বজুড়ে চলমান দারিদ্র্য বিমোচন এবং জীবিকায়ন কার্যক্রম বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক অভিঘাত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় সহ্য করতে পারার ক্ষমতা কতটুকু তৈরি করতে পেরেছে তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। এটা দরিদ্র বা অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একইভাবে যে মেয়েটি গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামে ফিরে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন বা যে স্কুল শিক্ষক লকডাউনের সময় বন্ধ হওয়া তার স্কুলটি আর না খোলায় এখনও তার যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো কাজে যুক্ত হতে পারেননি, তাদের জীবিকায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সম্প্রতি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস এবং ব্র্যাক ইনিস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত এবং বিশ্বব্যাপি সুপরিচিত একটি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে ১০ বছর আগে অংশ নেওয়া কিছু অতিদরিদ্র পরিবারের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। এই পরিবারগুলো কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত সহায়তা এবং লব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহার করে পরবর্তীতে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। গবেষণাটিতে দেখা হয়েছে, কোভিড–১৯ মহামারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট পরিবারগুলো মোকাবিলা করতে পারছে কিনা। এতে দেখা গেছে প্রাক্তন সদস্যদের মধ্যে যারা টেকসইভাবে অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন, আয়মূলক পেশায় যোগদান বা এন্টারপ্রাইজ পরিচালনা করে নিয়মিত এবং স্থিতিশীলভাবে অর্থ উপার্জন করছেন এবং যাদের উপার্জনশীল সম্পদ, যেমন: গবাদি পশু, কৃষি জমি ইত্যাদি আছে; তারা অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবেলা করে এই সংকটকাল ভালোভাবে পার করতে পেরেছেন। ব্র্যাকের আলট্রা–পুওর গ্র্যাজুয়েশন নামক এ কর্মসূচির কর্মীরাও কোভিড–১৯ অতিমারি চলাকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত প্রাক্তন সদস্যদের ভিজিট করেছেন। তারাও এ জনগোষ্ঠীকে সহনশীলভাবে অভিঘাত মোকাবেলা করতে দেখেছেন। অতিদরিদ্র থাকা অবস্থায় কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার পর সেখান এই সদস্যরা সঞ্চয়ের অভ্যাস করা, পরিবারের ফাইন্যানসিয়াল প্ল্যানিং বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা ইত্যাদি সংক্রান্ত যে জ্ঞান ও হাতে কলমে শিক্ষা অর্জন করেছেন, মূলত সেগুলোই তাদেরকে সহায়তা করেছে এই সংকটকালটি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্থিতিশীলভাবে সঙ্গে পার করতে।
অর্থাৎ, যেকোনও অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক অভিঘাত মোকাবেলা করতে হলে সঞ্চয় রাখা, যথাযথ ফাইন্যানসিয়াল প্ল্যানিং করা, ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোভিড–১৯ অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ দেশে অতিদরিদ্র থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত অবস্থায় থাকা মানুষেরা কোনো অপ্রত্যাশিত অভিঘাত থেকে নিজেদের আর্থসামাজিক অবস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করতে পারছে না। আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হওয়ায় খরচের খাতা ভরে যাচ্ছে আর সঞ্চয়ের পেয়ালা শূন্য রয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ হলো দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমকে এখনও অধিকাংশক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা বা অনুদান প্রদান এবং বড়জোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ মানব উন্নয়ন সূচকের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন ওতোপ্রতোভাবে সংশ্লিষ্ট। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ইত্যাদিসহ সকল প্রকার সেবা এবং প্রাপ্য অধিকারে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অভিগম্যতা যত বাড়বে ততই তারা দারিদ্র্যের শৃংখল ভেঙে টেকসইভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে, যেকোনো বিপর্যয় বা অভিঘাতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়া, তাদের এর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সকল অবস্থানে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু এ রকম কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আমাদের তেমন একটা নেই। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে এখনও সকল জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা নিশ্চিত করাও সম্ভব হয়নি। এগুলো মূলত উপকারভোগীদের স্বল্পমেয়াদে সহায়তা দিয়ে থাকে। কার্যকর এবং টেকসইভাবে দীর্ঘমেয়াদে উপকারভোগীদের দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বের করে আনতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ এবং চলমান কর্মসূচিগুলোর মধ্যে প্রযোজ্যগুলোকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করতে সরকারিভাবে ইতিমধ্যে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। একে সাধুবাদ জানিয়ে এই উদ্যোগে বেসরকারি সংস্থাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ সরকার তার অষ্টম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে অতিদরিদ্রের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ভিশন–২০৪১ অনুযায়ী ২০৩১–এর মধ্যে দেশ থেকে অতিদারিদ্র্য সম্পূর্ণভাবে বিমোচন করতে হবে। বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে বিশ্বের সামনে রোল মডেল, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দারিদ্র্যের ধরন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন নতুন ফ্রন্টিয়ার তৈরি হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে শহরাঞ্চলে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়বে। এ মানুষগুলোর জন্য শহরে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং তাদের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কাজ এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে আসন্ন বড় অভিঘাত হিসেবে দেখা দিতে চলেছে। বাংলাদেশ গ্লোবাল র্যাংকিয়ে বিশ্বের ষষ্ঠ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক সেক্টর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন সেক্টরকে যেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে তার জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। নতুবা এগুলোর অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে দেশে দারিদ্র্যের হার নতুন করে বেড়ে যাবে। এই লক্ষ্যে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাসহ সকল স্টেকল্ডারদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন একটাই। সেই জীবনে একটু মানসিক শান্তি, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ আর পিতা–মাতা–পুত্র–কন্যাকে নিয়ে সুখী জীবন কাটাতে পারা প্রতিটি মানুষের অধিকার। ধনী, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র– সকল অর্থনৈতিক অবস্থানে বসবাস করা প্রতিটি মানুষের সেই অধিকার যেন পূরণ হয় তা নিশ্চিত করতেও তাই সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারকে সম্মিলিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।