Published : 27 Oct 2021, 06:50 PM
দেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এই লেখাটি লিখতে বসেছি। ২০২১ সালে পৌঁছে আমাদের দেখতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব। আমাদের বলতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। অনেক আগেই কি এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না?
মানবজাতি মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমানোর আয়োজন করছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তর ভেদ করে যখন দূর থেকে দেখছে নীল গ্রহটিকে, যখন গড়ে তুলছে মহাকাশ স্টেশন তখন পৃথিবীকে দেখছে একটি একক সত্তা হিসেবে। এখানে কি চোখে পড়ে কোনো বিভেদ? মানুষ কতটা ক্ষুদ্র তা বোধকরি সে বুঝতে পারে যখন অনেক উপর থেকে দেখে। মহাকাশযানে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা অসংখ্য মানুষেরই রয়েছে। আকাশ থেকে ঘরবাড়ি কত ছোট দেখায়, দশতলা আর পনের তলার তফাৎ যে বুঝতে পারা যায় না সে অভিজ্ঞতা বিমানযাত্রীর রয়েছে। মানসিকভাবেও যদি আমরা উচ্চতায় উঠতে পারি তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদও ভুলতে পারব নিঃসন্দেহে।
১৯৭১ সালে আমরা জাতিগতভাবে মানসিক উচ্চতায় উঠতে পেরেছিলাম। তাই তখন হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ ভোলা সম্ভব হয়েছিল। এরপর আমরা ক্রমশ খণ্ডিত হয়েছি, ক্ষুদ্র হয়েছি।
যখনি দেশে কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা অস্থিরতা দেখা দেয় তখনই আমরা কয়েকজন মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে যেখানে যত ধর্মীয় নজির আছে তা তুলে ধরতে থাকি। আমার প্রশ্ন হলো কেন সারা বছর সম্প্রীতির পক্ষে এই নজিরগুলো অন্ধকারে পড়ে থাকে?
কেন আমরা সারা বছর ধরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে কাজ চালিয়ে যাই না? আমার মনে পড়ছে, নাসিরনগরের ঘটনার পর আমার বৃদ্ধ বাবা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ বলেছিলেন, 'এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের আয়োজন করা। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, গারো, চাকমা, সাঁওতাল, মুন্ডাসহ যত সম্প্রদায় রয়েছে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে মেলবন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে দেশের সর্বত্র। এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলাভাষী জনগণের মধ্যেও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমরা একই মহান সংস্কৃতির ধারক এটা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে। একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে।' তিনি যখন একথাটি বলেছিলেন তখন তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়। তার বয়স তখন ছিল নব্বই বছর। তিনি বলেছিলেন, 'দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে এটা খুবই গুরুতর বিষয়। এটা অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছর পর যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় তাহলে সে লজ্জা আমাদের দেশের প্রত্যেকের। প্রশাসনের উচিত ছিল তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটা তারা করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার জন্য তাদের কড়া শাস্তি দেওয়া দরকার।'
আমার নব্বই বছরের দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ বাবা যে সত্যটি বুঝতে পেরেছিলেন সেটা কি সরকার বা দেশের কর্তাব্যক্তিরা এখনও বুঝতে পারেননি?
আমার এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে বাংলাদেশটা কার? এই দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো মহান দার্শনিককে। এদেশের জন্য শহীদ হয়েছেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদা প্রসাদ সাহা, নূতন চন্দ্র সিংহ এর মতো অনেক মহান ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতার এত বছর পর এখন কি চিন্তা করতে হবে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন কি না। এদেশের অসংখ্য বধ্যভূমিতে হিন্দু মুসলমানের রক্ত কি একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়নি? একই জন্মভূমির মাটিতে কি তাদের শবদেহ পড়ে থাকেনি? হিন্দু ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কি একই সঙ্গে একই ঘাতকের হাতে প্রাণ দেননি? তাহলে এত বছর পর আমাদের মধ্যে এই বিভেদের বিষাক্ত কাঁটাগাছ কোথা থেকে গজাচ্ছে?
স্বাধীন বাংলাদেশে এই বিষবৃক্ষ বপন করেছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং স্বৈরশাসক এরশাদ। সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং পরে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জারি করে আঘাত করা হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আঘাত করা হচ্ছে এখন গুজব ছড়িয়ে। রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, পীরগঞ্জ সবগুলো ঘটনায় আমরা দেখলাম গুজবের দানব ফেইসবুকের উপর ভর করেছে। আর গুজবের পাখায় ভর করে মানুষের বসতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হায়নার দল।
কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভাবায়, সেটা হলো আমাদের দেশের অনেক মানুষের মনের ভেতর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটা দানো নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে। যে কোনো সুযোগে বোতল খুলে সেই দৈত্য বেরিয়ে আসে। যদি মনের ভেতরে বিদ্বেষের রাক্ষস ঘুমিয়ে না থাকত তাহলে তো গুজবের খোঁচায় তার জেগে ওঠার কথা নয়।
তাহলে বলতে হয়, এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক। তারা মুখে যতই উদারতা দেখাক অনেকেই গুজবে কান দিয়ে লাফিয়ে ওঠে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ভাংচুরে এবং তলে তলে তাদের উদ্দেশ্য হলো সম্পত্তি দখল করা। এদের মধ্যেই এখন আমাদের মূল কাজ সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করা উচিত। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো নিষ্ক্রিয় থাকার অপরাধ। আপনি কতটা অসাম্প্রদায়িক এটা বোঝা যাবে তখনি যখন আপনি সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, আপনার সন্তানের সামনে আপনি নিজে কখনও কোনো সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন কিনা। কিংবা, আপনার সন্তান যদি কোনো সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে বা তার বন্ধুদের বা স্কুলের এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা আপনাকে বলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব থেকে বের করে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা। যদি আপনি যে কোনো সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে বা ঘটনায় নিষ্ক্রিয় থাকেন তাহলে বুঝতে হবে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ার পিছনে আপনার দায়ও রয়েছে।
বাংলাদেশে এই ঘাপটি মারা সাম্প্রদায়িকদের ভিড়ে এখন আামি এবং আমাদের মতো মানুষরাই হয়ে পড়ছি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। এখানে বলতে চাই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু শব্দ দুটিও যথেষ্ট আপত্তিকর। বাংলাদেশটা সকলের। এখানে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু ভেদাভেদ টানাই উচিত নয়। আর যদি সংখ্যালঘুর কথা বলতে হয় তাহলে বলি আমরা যারা ঈদের দিনে সেমাই খাই, নতুন কাপড় পরি, রোজা রাখি, নামাজ পড়ি, আবার মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পূজা মণ্ডপে, রথের মেলায়, কীর্তনের আসরে, প্রবারণায় ফানুস উড়াতে, ক্রিসমাসে গাছ সাজাতে উৎসাহ নিয়ে অংশ নিই, কিংবা যারা হিন্দু হয়ে পূজা করা সত্ত্বেও মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার খাই, মহরমের মেলায় যাই অথবা আমরা যারা বৈসাবিতে আনন্দ করি এবং যারা নারী-পুরুষের ও সব মানুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করি সেই আমরাই ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে গেছি। আমরা যারা একসময় বাম রাজনীতিতে মনেপ্রাণে বিশ্বাস রেখেছি, আমরা যারা সাম্প্রদায়িকতার তিলমাত্রও অন্তরে পোষণ করি না সেই আমরাই সংখ্যালঘু।
আমি এবং আমরা সংখ্যালঘু হয়েছি জন্মমুহূর্তে পরিবার থেকে, সংখ্যালঘু হয়েছি নিজস্ব অর্জন লেখাপড়া থেকে, সংখ্যালঘু হয়েছি সেইদিন থেকে যেদিন আমরা হিন্দু বা মুসলমানের চেয়ে মানুষ হয়ে উঠেছি। যেদিন আমরা এবং আমাদের মতো মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু হয়ে উঠতে পারব একমাত্র সেদিনই বাংলাদেশকে আামরা সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক বলতে পারব। সেদিন কত দূরে? আর কতদিন আমাকে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হবে?
আরেকটি কথা পাশ্ববর্তী কোনো দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন থাকা এক ব্যাপার, আর সেই নজির তুলে ধরে নিজের দেশে অশান্তি সৃষ্টি করা, গুজব ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। দ্বিতীয়টি হলো অপরাধ। গুজব ছড়ানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মতো যে কোনো অপতৎপরতা অপরাধ। গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধ বিষয়ে সচেতন হোন। আপনি যে সম্প্রদায়েরই হোন না কেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখুন। নিজের ধর্ম পালন করার অর্থ এই নয় যে আপনি অন্যের ধর্ম পালনে বা পালন না করাকে আঘাত করবেন।