Published : 11 Oct 2021, 06:52 AM
মুজাহিদদের হটিয়ে তালেবান মিলিশিয়ারা প্রথমবার কাবুলের দখল নেয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯২ সালে মার্কিন সমর্থিত মুজাহিদ বাহিনীর হাতে কাবুলের মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে। এর মধ্যে দিয়ে দেশটিতে সেক্যুলার শাসনের অবসান হয়।
মুজাহিদরা কমিউনিস্টদের 'রিপাবলিক অব আফগানিস্তানের' এর জায়গায় 'ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তান' প্রতিষ্ঠা করে। মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ ভারতে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কাবুলে জাতিসঙ্ঘ অফিসে আশ্রয় নেন।
ক্ষমতা দখলের পর মুজাহিদরা সেক্যুলার আফগানিস্তানের খোলনলচে বদলে শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গড়বার উদ্যোগ নেয়। পোশাকসহ নারীদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতির বিরুদ্ধে বহু মানুষের ক্ষোভ ছিল। তারা সোভিয়েত বাহিনীকে 'দখলদার বাহিনী' হিসেবে দেখছিল।
এ ক্ষোভকে আরও উস্কে দেবার জন্য পশ্চিমা দুনিয়া ব্যাপকভাবে 'ধর্ম কার্ড' ব্যবহার করে। পশ্চিমা মিডিয়া ক্রমাগতভাবে কমিউনিস্ট সরকারকে ধর্ম-বিরোধী হিসেবে প্রচার করতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলি মুজাহিদদের সোভিয়েতবিরোধী জেহাদকে শুধু অস্ত্র, অর্থ দিয়েই নয়—তাত্ত্বিকভাবেও এর সমর্থনে শক্ত ভিত্তি তৈরি করে।
আফগান জনগণের বড় অংশটি মুজাহিদদের দেখেছিল 'মুক্তিবাহিনী' হিসেবে। তাদের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত 'দখলদারিত্বে'র অবসান ঘটবে, 'নাস্তিক্যতবাদের' জায়গায় 'ধর্ম-ভিত্তিক' রাষ্ট্র হবে, জনগণ সেখানে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। এ ধরনের একটা সরলীকৃত হিসাব মুজাহিদ এবং পশ্চিমা দুনিয়া দাঁড় করিয়েছিল—বেশিরভাগ জনগণের কাছে সেটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
সার্বিকভাবে নারীদের কাছে বোঝাপড়ার বিষয়টা অবশ্য কিছুটা জটিল ছিল। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসে আইন করে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমানাধিকারকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার মূলভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। ফলে একদিকে নারীর কর্মসংস্থান এবং অপরদিকে নারী শিক্ষার প্রসারের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নারীদের জন্য অপ্রচলিত পেশা, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতেও নারীদের বড় সংখ্যায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এর সবকিছুই রক্ষণশীল আফগান সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানকে ইসলাম ধর্মবিরোধী বলে মুজাহিদরা প্রচার চালায়। পশ্চিমা মিডিয়া এবং নীতিনির্ধাকরা এ ধরণের প্রচারের বিরুদ্ধে নীরব থাকে।
এসব প্রচার সত্ত্বেও অনেক আফগান নারী মুজাহিদরা ক্ষমতায় আসলে রাষ্ট্র এবং সমাজে আবার তাদের অধঃস্তন অবস্থা তৈরি হবে—এ বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেননি। সোভিয়েত 'দখলদারিত্ব' থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটাতে হবে, এটাই হয়ে উঠে তাদের মূল লক্ষ্য।
স্বপ্ন এবং বাস্তবের যোগসূত্র মেলাতে না পারবার কারণে এমনকি অনেক উচ্চশিক্ষিত এবং মেধা মননে প্রগতিশীল নারীও ধরে নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট মুক্ত দেশে তারা আরো অধিক স্বাধীনতা না পেলেও অন্তত কমিউনিস্ট শাসনামলে অর্জিত স্বাধীনতাগুলো বহাল থাকবে। অনেক নারীর কাছে মুজাহিদ নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ হয়ে উঠেছিলেন স্বপ্নের 'বীরপুরুষ'।
মুজাহিদরা ক্ষমতা দখলের পরপরই আফগান জনগণের স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু করে। ক্ষমতা দখলের সাথেই সাথেই তারা দুর্নীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ জনগণের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, নারী নির্যাতন ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়। আহমেদ শাহ মাসুদ এবং তার বাহিনী সম্পর্কে নারীদের দ্রুতই মোহভঙ্গ ঘটে। তারা বুঝতে পারেন, এতদিন তাদের যে স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা ছিল, তার কিছই আর অবশিষ্ট নেই।
মুজাহিদরা নানা দল এবং উপদলে বিভক্ত ছিল। ইসলামের কথা বলে ক্ষমতা দখল করলেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে এসমস্ত দল এবং উপদলে নিজেদের মাঝে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সবারই লক্ষ্য ছিল বাকিদেরকে হটিয়ে নিজেদের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারলে তাদের নেতারা দেশের পুরো সম্পদের ভাগিদার হতে পারবেন। সাধারণ মুজাহিদ যোদ্ধারা এ সময় বুঝে উঠতে পারছিল না, তারা আসলে ঠিক কি কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
মুজাহিদদের নানা অংশের মাঝে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে বিভীষিকা নেমে আসে। কাবুলের অর্ধেকসহ বহু শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নারীদের জীবনে নেমে আসে চরম অনিরাপত্তা। মুজাহিদদের হাতে বহু নারী ধর্ষণের শিকার হন। জনগণ এ অবস্থা থেকে দিশেহারা হয়ে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে থাকে।
এমতাবস্থায় মার্কিন অর্থ সহায়তায় পাকিস্তানে স্থাপিত মাদ্রাসার ছাত্র মোল্লা মোহাম্মদ ওমর এবং আব্দুল গনি বারদার (বর্তমান ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী) অল্প কিছু অনুসারী নিয়ে মুজাহিদদের থেকে বের হয়ে গিয়ে কান্দাহারে ১৯৯৪ সালে তালেবান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স (আইএসএই) এ সংগঠন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তালেবানকে আইএসএই এর "ব্রেন চাইল্ড" মনে করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবেই আফগানিস্তানে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব প্রবল। পাকিস্তান আশা করেছিল, পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদরা ক্ষমতাসীন হলে তারা নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হবার পরে দেখা গেল তারাও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আফগান জনগণের সেন্টিমেন্টের সাথে সাযুজ্য রেখে কমিউনিস্ট সরকারের মত তাদের মাঝেও 'ভারতপন্থি' মনোভাব প্রবল হয়ে উঠে।
পাকিস্তান সুযোগ খুঁজছিল তাদের অনুগত বাহিনী তৈরি করে কাবুলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবার। মোল্লা ওমর এবং বারদারদের মুজাহিদ বাহিনী থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত তাদের সামনে এ সুযোগ তৈরি করে। আইএসআই তালেবদের (আরবি শব্দ তালেবানের এক বচন তালেব বা ছাত্র) অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রদাণ করে। পাকিস্তানের সহায়তায় প্রতিষ্ঠার অতি অল্প সময় পরেই ১৯৯৬ সালে মুজাহিদদের হটিয়ে তালেবরা কাবুল দখল নিতে সমর্থ হয়।
তালেবান যখন কাবুল দখল করে তখন জনগণ মুজাহিদ শাসনে এক চরম নৈরাজ্যকর অবস্থায় ছিল। তারা যেকোনও মূল্যে এর অবসান চাচ্ছিল। তারা মনে করেছিল, তালেবরা ক্ষমতায় আসলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবে।
স্থিতিশীলতার জন্য আফগান জনগণ তখন উন্মুখ ছিল। ফলে, তালেবান যখন ক্ষমতা দখল করে, জনগণের একটা অংশের সমর্থন তারা পেয়েছিল। কিন্তু তালেবদের ক্ষমতা দখলের অল্প কিছুদিনের মাঝেই তাদের মোহভঙ্গ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম শাসন ইসলামের নাম ব্যবহার করে তালেবরা আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠা করে। এর পূর্বে উত্তর কোরিয়াকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম বর্বর রেজিম মনে করা হত—যেখানে সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে কিম বংশের একচ্ছত্র আধিপত্য বা 'নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তালেবদের প্রথম শাসনামলের বর্বরতা উত্তর কোরিয়াকেও ছাড়িয়ে যায়। একমাত্র পলপটের অধীন কম্বোডিয়ার সাথেই তালেবান শাসনের তুলনা করা চলে।
শীতল যুদ্ধের সময় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়া যেকোন মূল্যে সমাজতন্ত্রের বিস্তার ঠেকানোর প্রচেষ্টা নেয়। এর অংশ হিসেবে তারা 'ইসলামপন্থি' দলগুলোকে মদদ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে—যারা সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী-পুরুষ সমানাধিকার ইত্যাদি পশ্চিমা মূল্যবোধের ঘোর বিরোধী।
সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে প্রথমে মুজাহিদ এবং পরে তালেবানের হাতে কাবুলের পতন ঘটবার পর এদের সাথে সম্পর্ক কী হবে- এ বিষয়ে পশ্চিমা দুনিয়া অনেকটা অস্পষ্টতায় থাকে। ফলে পশ্চিমের কাছে নাজিবুল্লাহ পরবর্তী আফগানিস্তান অনেকটা 'পরিত্যক্ত' রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয়। পশ্চিমা দুনিয়া হঠাৎ করেই যেন আফগানিস্তান নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ কমে গেলেও সারা দুনিয়ার "ইসলামপন্থী" সংগঠনগূলোর পশ্চিম সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নানাবিধ কারণে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার পতন ঘটলেও তারা ধরে নেয় যে তাদের কারণেই এটা ঘটেছে। তারা আরো ধরে নেয়, যেহেতু তারা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটাতে পেরেছে, সেহেতু তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী দুনিয়ারও পতন ঘটাতে পারবে।
'ইসলামপন্থি'দের এ ধরনের চিন্তার তাত্ত্বিক ভিত্তি জোগান দেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন। তিনি তার 'সভ্যতার দ্বন্দ্ব' তত্ত্বে সোভিয়েত পরবর্তী দুনিয়ায় আটটি প্রধান সভ্যতাকে চিহ্নিত করেন। এ আটটির মাঝে 'পশ্চিমা দুনিয়া' বনাম 'মুসলিম বিশ্বে'র দ্বন্দ্ব, শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রধান দ্বন্দ্ব হবে বলে উল্লেখ করেন।
হান্টিংটনের তত্ত্ব 'ইসলামপন্থি'দের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাদের রাজনীতিতে এটি গতি সঞ্চার করে। এ সময় থেকেই সারা দুনিয়ার 'ইসলামপন্থি' দল এবং সংগঠনগুলোর পশ্চিমা বিরোধী শ্লোগান, বক্তব্য, কর্মসূচি বৃদ্ধি পায়। আগের সোভিয়েত বিরোধী শ্লোগানের বদলে তারা মার্কিন বিরোধী শ্লোগান দিতে শুরু করে।
পশ্চিমা দুনিয়ার মদদে যে সমস্ত ধর্মভিত্তিক, সন্ত্রাস নির্ভর সংগঠনের জন্ম হয় তারা এ সময় আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে। পশ্চিমা দুনিয়া ধরে নিয়েছিল সন্ত্রাস নির্ভর সংগঠনগুলো শুধু কমিউনিস্টদেরই টার্গেট করবে। কিন্তু সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে তারা নিজেরাই যে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে, এটা তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না।
এ প্রেক্ষাপটেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ এর সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটে। এটি ছিল তৎকালীন বুশ প্রশাসনের সামনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ হামলার সাথে জড়িত প্রায় সবাই ছিল সৌদি নাগরিক। কোন আফগান এর সাথে কোনওভাবেই যুক্ত ছিল না। খুব রহস্যজনক কারণে ওসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সৌদি নাগরিককে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করা হয়।
তালেবান কাবুল দখলের পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর অনেক নেতাকর্মী আফগানিস্তানকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন তাদেরই একজন। আল কায়েদা এ হামলার সাথে যুক্ত না থাকলেও, তিনি ৯/১১ এর হামলাকে সমর্থন করেন এবং যারা হামলা চালিয়েছে তাদের প্রশংসা করে বিবৃতি দেন।
বিশ্বের নানা প্রান্তের "ইসলামপন্থি" দলের নেতাকর্মীদের এ হামলার ব্যাপারে উল্লসিত হতে দেখা যায়। এ ঘটনাকে নিন্দা করে কোন 'ইসলামপন্থি' দলকেই বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। এমনকি অনেক বামপন্থির মাঝেও এক ধরনের চাপা উল্লাস পরিলক্ষিত হয়।
লাদেনের বক্তব্যে কিংকর্তব্য মার্কিন প্রশাসন হালে পানি পায়। তারা 'প্রতিশোধ' নেবার জন্য 'সফট টার্গেট' খুঁজে পায়। আমেরিকা থেকে লাদেনকে তাদের কাছে হস্তান্তরের বার্তা দেওয়া হয়। তালেবান সেটা অস্বীকার করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তানে হামলা চালায় এবং ২০০১ এর ১২ নভেম্বর কাবুলের দখল নেয়।
আজকে আশরাফ গানির সরকার যেমন বিনাযুদ্ধে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়, তেমনি তালেবান বাহিনীও সেদিন বিনাযুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
মার্কিন বাহিনী ক্ষমতায় এসে তাদের মদদপুষ্ট মুজাহিদদের আবার ক্ষমতায় বসায়। কাবুল তালেবান নিয়ন্ত্রণে থাকবার সময় দেশটির উত্তরের ১০ শতাংশের মত এলাকা মুজাহিদদের বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এজন্য ওইসময় তাদেরকে 'নর্দার্ন অ্যালায়েন্স' বলা হত।
২০ বছর মার্কিন ও তাদের মিত্রবাহিনী এ মুজাহিদদের পাহারা দিয়ে ক্ষমতায় রাখে। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হবার ২০ বছর পর মার্কিন ও তার মিত্রবাহিনীর প্রত্যাহার চলার সময় কাবুলের দখলে আবার তালেবদের হাতে এসেছে। প্রথমবার ক্ষমতা দখলের কয়েক বছর পর তাদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল: এবার কি তারা কাবুলের দখল নিজেদের হাতে রাখতে পারবে?
১৫ আগস্ট কাবুল দখল করবার তিন সপ্তাহ পর তালেবান সরকার গঠন করে। ক্ষমতা দখল করবার পর প্রথমদিকে তারা একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিল, এবার তারা আগেরবারের মত কঠোরভাবে তাদের ব্যাখ্যাকৃত শরীয়া আইনের প্রয়োগ ঘটাবে না। কিন্তু সরকারে অধিক 'কট্টরপন্থি' হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্তির মধ্যে দিয়ে তারা স্পষ্ট করেছে যে, আগের অবস্থান থেকে তারা মোটেও বদলায়নি।
সরকারে এমন বেশ কিছু নেতাকে রাখা হয়েছে- যেমন, মোল্লা আব্দুল গনি বারদার, মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখন্দ, সিরাজুদ্দিন হাক্কানি- যাদের নাম জাতিসংঘের 'ব্লক লিস্ট' অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় রয়েছে। কেবিনেটে কোন নারী প্রতিনিধি রাখা হয় নাই। তেমনি রাখা হয় নাই, ধর্মীয় সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের কাউকে। আফগানিস্তানের ৫৫টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তাজিক এবং হাজারা থেকে একজন প্রতিনিধি ছাড়া বাকি সব সদস্য নেওয়া হয়েছে সংখ্যগুরু পশতুন সম্প্রদায় থেকে।
গেরিলা যুদ্ধে অভ্যস্ত, সরকার পরিচালনায় অনভিজ্ঞ তালেবদের সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালঞ্জ দেশের অর্থনীতি। গত এক দশক ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও তা আফগান অর্থনীতিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেনি। আফগান জনগণের মাথাপিছু আয় ৪৯৩ মার্কিন ডলার। দেশটির জিডিপির ৯০ শতাংশই হচ্ছে ঋণ। বাৎসরিক বাজেটের ৮০ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দাতা রাষ্ট্রের অর্থ সাহায্য নির্ভর।
এই যখন অবস্থা, তখন মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রসহ সমস্ত দাতা রাষ্ট্র এবং বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর ফলে সমস্ত রকম অর্থনৈতিক সাহয্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, বৈধভাবে দেশটিতে রেমিটেন্স পাঠাবার সমস্ত পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আফগান কেন্দ্রিয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলারের মত। এর মধ্যে ৯ বিলিয়ন ডলারের উপর গচ্ছিত আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের কাছে। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি (অর্থমন্ত্রী) ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, আফগান ব্যাংকের অর্থ তালেবান সরকারের কাছে ফেরত দেওয়ার কোন অভিপ্রায় তার সরকারের নেই।
আফগান কেন্দ্রিয় ব্যাংকের নিজেদের নোট ছাপাবার ক্ষমতা নেই। তারা অন্য দেশ থেকে নোট ছাপিয়ে আনে। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে একটি পোলিশ ফার্ম থেকে এ বছর ২ বিলিয়ন আফগানি (আফগান কারেন্সি) এবং আগামী বছর ফরাসি কোম্পানি থেকে ১০০ বিলয়ন আফগানি আসার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এ টাকা আসবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তালেবান বাহিনী ক্ষমতা দখলের পরে যারা আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি। আফগান ব্যাংকগুলোর অবস্থা আশরাফ গানির সরকারের সময়েই বেশ করুণ ছিল। অর্থের অভাবে শেষ দুই মাস গানি সরকার সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারিদের বেতন দিতে পারেনি। তার ওপর দেশ থেকে যারা বের হয়ে গেছেন, তারা চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব অর্থ ব্যাংকগুলো থেকে তুলে নিয়ে যেতে। ফলে দেশটিতে দেখা দিয়েছে প্রবল অর্থ সংকট।
আফগানিস্তান হচ্ছে আমদানি নির্ভর রাষ্ট্র। অর্থ সংকট বিশেষত তালেবান সরকারের হাতে বিদেশি কারেন্সি ডলার এবং ইউরো না থাকবার ফলে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি দুরূহ হয়ে গিয়েছে। ফলে সারা দেশে দেখা দিয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্যের ভয়াবহ সংকট। এতে খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। হাসাপাতালগুলো সব ধরনের ওষুধ শুন্য। দেশটিতে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ সংকট।
অর্থ না থাকায় তালেবান সরকার কর্মকর্তা/কর্মচারিদের বেতন দিতে পারছে না। মানুষকে তার নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি করে দিতে হচ্ছে অর্থ সংগ্রহের জন্য। সামনের শীতে দেশটি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৩ কোটি ৯০ লাখ আফগানের জীবনরক্ষার চ্যালেঞ্জ এখন তালেবদের হাতে।
তালেবান সরকারকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি কোন আফগান দুতাবাস বা কূটনীতিক তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেনি। গানি সরকারের পতনের পরে অর্থাভাবে দুনিয়ার সব আফগান দূতাবাস এ মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে।
তালেবান সরকার যখন এরকম বিছিন্ন, তখন চীন এবং পাকিস্তান এগিয়ে এসেছে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। চীন ইতিমধ্যে ৩১ মিলিয়ন ডলারের জরুরি সাহায্য দিয়েছে। এছাড়া ৩০ লাখ ডোজ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দিবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
গণচীন খনিজসহ বিভিন্ন খাতে আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চীন তার বিনিয়োগের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। আবার একই সাথে উদ্বিগ্ন তালেবান দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে পূর্ব 'তুর্কেস্তান ইসলামি আন্দোলনে'র (চরমপন্থি উইঘুর আন্দোলন) পালে জোর হাওয়া লাগে কিনা—এ বিষয়ে। এ সমস্ত কিছু চীনকে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি বা তাদের সাথে কাজ করার বিষয়ে দ্বিধান্বিত করেছে। যদিও প্রায় সব রাষ্ট্র তাদের দূতাবাস গুটিয়ে নিলেও চীন পাকিস্তান, কাতার এবং রাশিয়ার মত তাদের দূতাবাস কাবুলে খোলা রেখেছে।
তালেবদের প্রতি রাশিয়ার নীতি হচ্ছে, 'শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র'। তালেবরা মার্কিন বিরোধী; তারা সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী বড় বড় মুজাহিদ নেতাদের হত্যা করেছে। এ সমস্ত কিছুর জন্য রাশিয়া তার দূতাবাস খোলা রাখলেও তালেবান সরকারকে কোনরূপ আর্থিক সহায়তা দেয়নি বা তাদেরকে স্বীকৃতিও দেয়নি। এমনকি তাদের নাম সন্ত্রাসবাদীর তালিকা থেকেও বাদ দেয়নি। চীনের মত রাশিয়াও উদ্বিগ্ন তালেবান শাসন দীর্ঘ হলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতি দানা বাধে কিনা, এ প্রশ্নে।
তালেবান সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন এমনকি খোদ পাকিস্তানও। তালেবদের নানাভাবে মদদ দিলেও এখন তালেবান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে পাকিস্তান। সম্প্রতি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলা জোরদার করেছে।
তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা সংহত করতে পারলে সেটা আগামী দিনে পাকিস্তানের জন্য বিপদ হয়ে যাবে কিনা, এ বিষয়টা আইএসআইসহ দেশটির নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভাবিত করছে। তাই পাকিস্তান গতবারের মত এবার তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি। আবার স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয়ও তারা করছে।
স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি কাতারও। উল্লেখ্য, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ যে তিনটি রাষ্ট্র প্রথমবার গঠিত তালেবান সরকার স্বীকৃতি দিয়েছিল কাতার তাদের অন্যতম। আর যুবরাজ সালমানের নেতৃত্বাধীন সৌদি আরব ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছে, তালেবান বিষয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই।
আফগানিস্তান যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে চীন এবং পাকিস্তানের সামান্য প্রতীকি সাহায্য তার থেকে উত্তরণে কোন ভূমিকা পালন করবে না। যেকোন সরকার এমনকি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক সরকারের টিকে থাকবার অন্যতম মূলশর্ত হচ্ছে, জনগণের সামনে তাদের এ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পারা যে, তাদের শাসনেই দেশ ও জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।
তালেবরা ক্ষমতায় থাকলে দেশে স্থিতিশীলতা আর শান্তি বজায় থাকবে, এর বাইরে আরো কোন কিছু তারা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। স্থিতিশীলতার কথা যত বলা হচ্ছে, ক্ষুধার্ত জনগণ তত শরীয়া আইনের আরো কঠোর প্রয়োগ নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে।
অজানা অন্ধকার ভবিষ্যতের ভয়ে দলে দলে মানুষ সীমানা পাড়ি দিয়ে পাশের দেশগুলোতে চলে যাবার চেষ্টা করছে। আমলা, বুদ্ধিজীবীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যাপকহারে দেশ ত্যাগ রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টিকে সামনের দিনগুলোতে আরো দুরূহ করে তুলবে।
মার্কিন ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে কোন উদারনৈতিক ধারার সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলের জন্ম দিতে পারেনি। মুজাহিদ এবং তালেবদের দীর্ঘ শাসন আফগানিস্তানের মাটি থেকে বামপন্থিদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করেছে। এখন দেশটিতে যত বিবাদমান দল, উপদল রয়েছে সবাই 'ইসলামপন্থি'।
আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট যত গভীর হতে থাকবে নানা মতের 'ইসলামপন্থি'দের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত যেমন বৃদ্ধি পেতে পারে, তেমন বৃদ্ধি পেতে পারে তালেবদের নানা গোষ্ঠির মাঝে দ্বন্দ্ব—যেমনটা ঘটেছিল মুজাহিদরা যখন ক্ষমতায় ছিল তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠির মাঝে। এর আলামত ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ইসলামিক স্টেট—খোরশান শাখা তালেবান সরকারকে ইসলাম বিরোধী ঘোষণা করে কাবুলসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা জোরদার করেছে। সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন হাক্কানি নেটওয়ার্কের সাথে তালেবদের অর্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সামনের দিনগুলোতে বৃদ্ধি পেতে পারে। এরা ২০১৬ সালে তালেবদের সাথে যোগ দিয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত মুজাহিদরাও পশ্চিমের মদদে আবারো সংগঠিত হবার চেষ্টা করবে। সবকিছু মিলে আগামী দিনগুলোয় আফগানিস্তান হয়ে উঠতে যাচ্ছে বিভিন্ন 'ইসলামপন্থি দল এবং গোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধক্ষেত্র।