Published : 04 Oct 2021, 03:41 PM
মানুষ থেকেই মানুষ আসে।
বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়
তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়। । (শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়)
মানুষে মানুষে পার্থক্য গড়ে দেয় শিরদাঁড়া, আর এই শিরদাঁড়ায় শক্তি যোগায় শিক্ষা। শিক্ষাদানে আবহমানের অবিকল্প শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকের বঞ্চনা কালের বিবেচনায় আবহমানের না হলেও বেশ পুরনো। সরকারি বেসরকারি দ্বন্দ্ব এমপিওভুক্তি হওয়া না হওয়া, পদ বঞ্চনা, টাইম স্কেল-সংক্রান্ত নানা জটিলতার জালে জর্জরিত শিক্ষক সমাজ। প্রেসক্লাবের সামনে সাদা কাপড় পরে সম্মানিত শিক্ষকেরা যখন অনশন করেন তখন ভাবনায় আসে লাখো-কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সরকার শিক্ষকদের প্রতি কি একটু মানবিক হতে পারে না? পাঠদানে ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে জীবিকার ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাতে তারা পড়ে থাকেন পথে।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সময়পোযোগী শিক্ষানীতি (কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন) বাস্তবায়নের পথে ইতিবাচকভাবেই এগুচ্ছিলেন কিন্তু পঁচাত্তরের হত্যালীলা সব থামিয়ে দেয়। প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের শুরু করেন বঙ্গবন্ধু আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন হয়েছে। কারিকুলাম বারবার বদলেছে, আবারো বদলাবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে– আরো চলুক শিক্ষায় স্বর্ণালী সময় আনতে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। সমযোগ্যতায় চাকরি করলে আর সমপরিমাণ শ্রম দিলে বেতন-ভাতায় বৈষম্য সৃষ্টি করা কাম্য নয়, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এর অন্যতম মর্মকথা।
প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে দক্ষতা বৃদ্ধিতে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকের যোগ্যতার পার্থক্যের মতো বেতনেও পার্থক্য থাকা বাঞ্চনীয়। কিন্তু নতুন বেতন কাঠামোয় উল্টো প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বেতন কমে গেছে। এক শিক্ষক ক্ষোভের সাথে বলছিলেন, 'প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা বাড়ে সত্য, এর ভিত্তিতে বেতনও বাড়া উচিত উল্টো যদি কমে যায় তাহলে এমন প্রশিক্ষণ কেন নেব?' পরিহাসের সুরে বলেন, 'এই প্রশিক্ষণের সার্টিফিকেট প্রত্যাহারের আবেদন করতে হবে মনে হচ্ছে।' যদিও গত ২৬ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক ভার্চূয়াল সভায় বলা হয় ডিপিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেন বেতন না কমে সেজন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের ১৩টি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আদতে প্রশিক্ষণ নিয়েও বেতন কমে যাওয়ার সমস্যার সমাধান করা না হলে তারা সারা চাকরিজীবনে এবং পেনশনে প্রায় পাঁচ শতাংশ হারে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হবেন।
জাতীয় স্কেলের ১৩তম গ্রেডে শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি। ১৩তম গ্রেডের নতুন এই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে গ্রেডের সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। এই আইনজীবী নিবন্ধকার পূর্ববর্তী এক রীটে একই বিষয় নিয়ে পিটিশান প্রস্তুতকালে জানতে পারে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সফটওয়্যার 'আইবাস প্লাস প্লাসের' মাধ্যমে বেতন নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু এ সফটওয়্যারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের আলাদা কোনো গ্রেড নির্ধারণ করা নেই। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগবিধি অনুযায়ী, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের চেয়ে এক গ্রেড নিচে বেতন পেয়ে থাকেন। চাকরিকালে যেদিন তিনি প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হন, সেদিন থেকে উচ্চতর গ্রেডে তার বেতন নির্ধারণ করা হয়। শৈশবের গণিতের হাতেখড়ি যে শিক্ষকের হাতে তাদের জন্য নীতি নির্ধারকের চেয়ারে বসে বেতন ভাতার জটিল হিসাব সহজ ও সুলভ করার সময় যেন বিস্মৃতির অটল পাহাড় সামনে এসে দাঁড়ায়।
চাকরিবিধির (বিএসআর ৪২ (১), (২)) ধারা অনুযায়ী, বেতন উচ্চতর গ্রেডে হলেও উচ্চ ধাপ আর নিম্ন ধাপের অসামঞ্জস্যতায় শিক্ষকদের প্রকৃত মূল বেতন না বেড়ে উল্টো কমে যায়। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের আগের পে-স্কেলে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হতো স্কেলভিত্তিক। তখন মূল বেতন সাময়িকভাবে কমলেও ইনক্রিমেন্টের হার বেড়ে ক্ষতি এক সময় পুষিয়ে যেত। কিন্তু চলতি পে-স্কেলে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হয় মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে। সেক্ষেত্রে গ্রেড যত ওপরেই হোক না কেন, মূল বেতনে একবার পিছিয়ে পড়লে, তার ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না। এই সব জটিল গাণিতিক হিসাব শিক্ষকদের যেন ললাট লিখন।
কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের বঞ্চনা আরো প্রকট। বিধি অনুযায়ী যোগদানের পর প্রভাষক পদে ৮ বছর পূর্ণ হলে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু সেখানে পদোন্নতির ৫:২ অনুপাত প্রথার কারণে অনেকে ২০/২২ বছরেও পদোন্নতি পান না। প্রভাষক হয়ে চাকুরি শুরু করে প্রভাষক হিসেবেই অবসরে যান অনেকে। তবে অপেক্ষাকৃত নতুন কলেজের প্রভাষকগণ অনেকে ৮ বছরে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। নতুন আইনে পদোন্নতি নীতিতে সেই অনুপাত ব্যবস্থা জিইয়ে রাখা হয়েছে। বেতন সংক্রান্ত বেদনার বর্ণনায় শুধু নিবন্ধের আকারই বড়াবে কিন্তু শিক্ষকদের বঞ্চনার দুঃখ যাত্রায় যতি টানবে কি?
সভ্যতার পত্তন ও বিকাশের ধারাবাহিকতায় শিক্ষকতা মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে শিক্ষকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক একটি সনদ গৃহীত হয়। সম্মিলিত ফোরাম এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের নিরন্তর আন্দোলনের ফলে ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবরকে ইউনেসকো বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালে স্বাক্ষরিত শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিলের প্রতি চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রতিটি রাষ্ট্র সমানভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। বাকি পৃথিবী যেখানে শিক্ষা সংক্রান্ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যস্ত সেখানে আমাদের শিক্ষক সমাজ মানসম্পন্ন জীবন যাপনের জন্য ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। মনে রাখা দরকার সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিশ্চয়তার সঙ্গে কাজের প্রতি নিবেদন ও উৎপাদনশীলতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের হয়ে ওঠার কিংবা সক্ষমতার যাত্রা শুরুর বিন্দুতে থাকেন আমাদের মহান শিক্ষকেরা। কিন্তু আমাদের সমূহ অমনোযোগে ভালো নেই শিক্ষকগণ।