Published : 01 Jul 2021, 09:36 PM
আমি গর্বিত- আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ গুনে অনন্য। আরো পরিষ্কার করে যদি বলি- এ বিদ্যাপীঠ পৃথিবীর সকল বিশ্ববিদ্যালয়, সকল শিক্ষায়তন থেকে একেবারেই আলাদা। কেন আলাদা? কারণ আজ থেকে শতবর্ষ আগে জন্ম নেওয়া এ বিদ্যায়তন অধ্যয়নের পাশাপাশি বিস্ময়কর রকমের ঘটনাবহুল।
মায়ের ভাষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এ শিক্ষাঙ্গনেই। এ ক্যাম্পাসের রাজপথে বাংলা ভাষার প্রশ্নে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন রফিক-শফিক- সালাম-বরকতেরা। মাতৃভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার যে মুখ্যবার্তা তা দেশের সীমা ছাড়িয়ে ইউনেস্কোর মাধ্যমে আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কি গৌরবের- এও স্বীকৃতির নাভিমূল প্রোথিত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এ ক্যাম্পাসের এক প্রান্তে অসাম্প্রদায়িক সম্মিলনীর বার্তা নিয়ে সেই বায়ান্ন সাল থেকে সারা জাতিকে আবাহন করে চলেছে জাতীয় শহীদ মিনার।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে বীজ উপ্ত হয়েছিল গত শতাব্দীর মধ্যাহ্নে- এ শিক্ষালয়ের চৌহদ্দী ঘিরে তা ক্রমে বিকশিত হয়েছে। শিক্ষা আন্দোলন, রবীন্দ্র-বিরোধী অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন-স্বাধিকারের আন্দোলন পেরিয়ে 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা'য় আত্মপরিচয় খোঁজার প্রতিটি সোপানে এ ক্যাম্পাস জড়িয়ে রয়েছে।
এ ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে একাত্তরে সংঘটিত বিশ্বের নিষ্ঠুরতম জেনোসাইডের চিহ্ন। মুক্তিকামী শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মাটি। জগন্নাথ হল, ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), রোকেয়া হল ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের চিহ্নিত স্থান। আঘাতের প্রথম প্রহরেই তারা নাম জানা অজানা শিক্ষার্থী কর্মচারীর পাশাপাশি হত্যা করেছে সর্বঅধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ সাদেক, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য প্রমুখকে। স্ত্রী-পুত্র পুত্রবধূসহ হত্যা করেছে রাজনীতির সূতিকাগার ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদন দে-কে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর আল বদর ও আল শামস বাহিনী অপহরণ করে নৃশংস অত্যাচার, এর পরে হত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী, দেশপ্রেমিক, সুপরিচিত এক ঝাঁক অধ্যাপক/শিক্ষককে। সেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে সর্বঅধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুর্ আনোয়ার পাশা, রাশেদুল হাসা্ সন্তোষ ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহম্ সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের অন্যতম। এই হত্যা অভিযানের শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজাও। বিজয়ের অব্যবহিত পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে শনাক্ত করতে পারা এ অধ্যাপকদের কয়েকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত আছেন।
এই ক্যাম্পাসেই চিরশায়িত আছেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জ্ঞানতাপস ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
এই ক্যাম্পাসের চৌহদ্দীতে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, এই প্রাঙ্গণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পন করেছিল, এ উদ্যানেই যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমনি গোলাম আজমের প্রতিকী বিচার করতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালত বসেছিল। ক্যাম্পাসের সীমার ভেতরে শাহবাগ লাগোয়া রাস্তা জুড়ে ফুঁসে উঠেছিল গণ জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। ঊন্সত্তরের গণ অভ্যুত্থানেও ছিল এই ক্যাম্পাসের সক্রিয় যুক্ততা।
মধুদা নেই, কিন্তু মধুর ক্যান্টিন এখনো শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আবার প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিও চাঙ্গা হয়েছে। নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের শোণিতে নানা পর্যায়ে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে মুখরিত হয়েছে এ ক্যাম্পাস। এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে নানা পর্যায়ে নানাভাবে জেগে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এত এত অর্জনের নজির বিশ্বের আর কোন শিক্ষাঙ্গনের নেই।
তবে আশঙ্কার কথা, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণের সমূহ ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটেছে- অবশ্য যা আমার ধারণায় সাময়িক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবারো স্বমহিমায় জেগে উঠবে, আবারো মেধাবী, অসম্প্রদায়িক, সংস্কৃতিপ্রেমী, দেশপ্রেমিক, জাগ্রত তারুণ্যে ভরপুর হয়ে উঠবে।
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১৯৮৭ সনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমরা যুক্ত হবার পরে অধ্যায়নের পাশাপাশি অগণিত ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি, সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে জড়িত হতে পেরেছি। অম্ল-তিক্ত-মধুর নানাধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সব ছাপিয়ে ভালোবাসি এ ক্যাম্পাসকে, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। মহাকালের আঁচলতলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে অমূল্য সঞ্চয় জমা করতে পেরেছে – তার বদৌলতে চিরদিন অনন্য হিসেবে টিকে থাকবে এ পবিত্র শিক্ষায়তন।
সর্বশেষে, আমার প্রত্যাশা ও প্রস্তাব- ঘটনাবহুল, ঐতিহাসিক, অনন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সার্বিক প্রাঙ্গণ অদূর ভবিষ্যতে ইউনেস্কোর মাধ্যমে 'ইনট্যানজিবল হেরিটেজ' হিসেবে ঘোষিত হোক- যাতে বিশ্ববাসী জানতে পারে এ অনন্যসাধারণ বহুধা অর্জন, ঘটনার সূতিকাগার এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে।
জয় হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।