Published : 13 Jun 2021, 06:06 PM
সৃষ্টির সকল বোঝাপড়া কর্ম নিয়ে। এ কর্ম আরও নান্দনিক হয়ে উঠে ধর্ম এবং সামাজিক শৃঙ্খলের আয়নায়। যেখানে একে ধর্মীয়ভাবে পাপ-পুণ্যে ও সামাজিকভাবে নৈতিকতা-অনৈতিকতার বাটখারায় ওজন করা হয়। তবে তামাশার বিষয় হল, এই কর্মফল প্রত্যেক মানুষে মানুষে আলাদা হলেও এরা নিজেদের ছেড়ে অন্যের জীবন সীমানায় মাপজোক বা সমালোচনায় বেশি তৎপর। কাজী নজরুল ইসলাম একে বিদ্রুপ করে বলে গেছেন, 'আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি'।
সম্প্রতি এমন কিছু পাপ-পুণ্য বা নৈতিক-অনৈতিকতার ফলাফল দেখেছে সম্ভাবনার বাংলাদেশ। যেখানে দেশের 'স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' এর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে কয়েক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আগমনকে কেন্দ্র করে সম্পদের অপচয়, উস্কানি এবং বিশৃঙ্খলা করতে দেখা গেছে।
বিষয়গুলোকে আপাতভাবে তুচ্ছ মনে হলেও এগুলোকে নিরীক্ষণ করার যৌক্তিকতা ব্যাপক। যেমন- নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। কাজেই রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাকে স্বাগত জানানো দেশের রাষ্ট্রীয় কায়দা কানুনেই পরে। আর তাকে নিয়ে যে উত্তেজনা সেটা তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই এসব বিবেচনার দায় সেদেশের আইন-আদালত ও জনগণের। তাছাড়া ইসলামেও অতিথির মর্যাদা অনেক উঁচুতে।
আর এই একবিংশ শতকে এসেও যদি নিজেদের স্বার্থ না বুঝে অন্যের ঘরের আগুন খুঁচে খুঁচে নিজের ঘরে এনে ঘর পোড়ানোর বন্দোবস্ত করা হয়, তবে আইয়ামে জাহেলিয়ার সময় আসন্ন। এটি দেশকে এবং এ প্রজন্মকে পেছনের দিকেই নিয়ে যাবে। তবে এরপরও প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুপ্রতিম কারো জন্যে কোন বার্তা দিতে চাইলে তা শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশের রেওয়াজ-রীতিরও আছে। ভিন্নভাবে বললে, প্রতিবেশী বন্ধুদের দুঃখে এই দেশেও যে দুঃখ করবার মানুষ আছে সেটা শান্তিপূর্ণভাবেও জানানো সুযোগ ছিল।
কিন্তু এ ধরনের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে মৌলবাদীরা যে নৈরাজ্য সম্পন্ন হিংস্রতা এবং তাণ্ডব চালিয়েছেন তাতে বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে নুন খুঁজতেই ভাত শেষ। তারা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি'তে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে গরু ভোজের মাধ্যমে স্বাগত জানানোর মত ঘটনা ঘটিয়েছে ! অর্থাৎ অন্যের ধর্মকে আঘাত করে নিজেদের ধর্ম এবং আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছেন।
অথচ নবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.) তার বিদায়ী হজের ভাষণেও যেকোনো স্থানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করবার দায়িত্ব সেখানকার সংখ্যাগুরুদের বলে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। অন্য ধর্ম এবং মানুষকে হেফাজতের কথা বলে গেছেন। সেখানে অন্যের ধর্মকে আঘাত করে এ ধরনের 'স্বাগত আয়োজন' (!) এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি, সেটা ময়না তদন্তের আদলে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তাছাড়া এই ইস্যুর উপর ভর করে দেশের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবের দিনেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সমূহে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ এবং জনগণের জানমালের উপর হামলা-হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
দৃশ্যমান বাস্তবতায় এসবই হেফাজত ইসলাম এবং মামুনুল হকের নির্দেশনায় বাস্তবায়িত। শুধু তাই নয় নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবি করলেও অর্থ এবং রাজনৈতিক মদতেই যে এই নারকীয় বীভৎসতা চালিয়েছেন সেটাও মামুনুল হক স্বীকার করেছেন। তাছাড়া ব্যাংকের কাড়ি কাড়ি টাকা আর নারীর নেশায় এরা যে ইসলাম এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছিলেন সেটাও আজ জনতার কাছে স্পষ্ট।
কাজেই এখন প্রয়োজন বিচ্যুত শিক্ষার্থীদের নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানানো। পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে তাদের সকল কিছুকে প্রাথমিকভাবে আরবি হরফে অনুবাদ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সকলের কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো যে বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। সেহিসেবেই বৈশ্বিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মাঝেও 'স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী-বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী' উদযাপনে এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানেরা দেশে এসেছেন। অর্থাৎ এটা বৈশ্বিকভাবে আমাদের আরও গুরুত্ববহ হয়ে উঠার ইঙ্গিত।
তবে এও সত্য যে এমন বোধকে উচ্চকিতভাবে জাগ্রত বা ছড়িয়ে দিতে দেখা যায়নি। প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের বিপরীতে প্রগতিশীলদের অগ্নিকাপন অনুভূত হয়নি। একারণে প্রগতিশীলদের নিয়ে সাধারণের মনে আহমদ ছফার উদ্ধৃতি উঁকি দিয়েছে, 'যারা মৌলবাদী তারা শতকরা ১০০ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ ১০ ভাগ প্রগতিশীল, ৫০ ভাগ সুবিধাবাদী, ১৫ ভাগ কাপুরুষ, ৫ ভাগ একেবারে জড় বুদ্ধিসম্পন্ন'।
শুধু তাই নয় এখানে কথায় কথায় কাফের এবং নাস্তিক বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু, এবং আওয়ামী লীগকে ৭১ এর মতই ইসলামের দুশমন হিসেবে গুজব ছড়াতে দেখা গেছে। অথচ মুসলিমদের সুবিধার জন্যে বায়তুল মোকারম, তাবলীগের জন্যে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জায়গা নিশ্চিত করা, কাকরাইলের মসজিদ সম্প্রসারণ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্যে আলাদা শিক্ষা বোর্ড নির্মাণসহ অসংখ্য উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়টায় হজ পালনের সুবিধার্থে 'হিজবুল বাহার' নামে জাহাজ ক্রয় করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। যা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই সামরিক শাসকরা 'প্রমোদতরী' হিসেবে ব্যবহার করেছে !
পিতার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ৫৬০ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, যা মুসলিম উম্মাহর ১৪ শ বছরের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। মসজিদের ইমামদের বেতনের আওতায় আনাসহ অসংখ্য উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কাজেই এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণে সর্বক্ষেত্রে যৌক্তিক অংশগ্রহণ জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রগতিশীল শ্রেণির ব্যাপক জাগরণ আবশ্যক। আর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের সেশনজট এবং সাম্প্রদায়িক গলাগলি দূর করতে ছাত্র সংগঠনগুলোর সৃজনশীল আচরণ প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে ফিরিয়ে আনতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়। তখনই মিলবে মুক্তি, সাড়া মিলবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের।