জ্বলন্ত নগরী, নির্বাক মানবিকতা

কত লোকের প্রাণ গেছে বা কত লোক প্রাণ হারাবে তার কোনো হিসেব নেই। এই কি নাগরিক জীবন? আজ সিদ্দিক বাজার কাল হয়তো আর কোথাও।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 March 2023, 02:02 PM
Updated : 9 March 2023, 02:02 PM

মৃত্যুপুরি ঢাকা নগরী। বিডিনিউজে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর একটি সংবাদের অংশবিশেষ এমন: “সময় তখন আনুমানিক পৌনে পাঁচটা। অন্য সময়ের মতই যানজটে ঠাসা গুলিস্তানের সড়ক। বাস-রিকশার পাশাপাশি প্রাইভেটকার ও ঠেলাগাড়ি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এসময় হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সবকিছু, ধোঁয়ায় কয়েক হাত দূরেও জিনিসও দৃষ্টিসামীর বাইরে চলে যায়।

মঙ্গলবার বিকালে বিকট সেই শব্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই উবারের গাড়ি চালক আনোয়ার হোসেন দেখলেন, তার গাড়ির উপর উড়ে এসে পড়েছেন পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এক লোক; ভেতর থেকে দেখলেন লোকটার মাথা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় আনোয়ারের ভাবনায় খেলে গেল মাথার উপর কোনো ভবন বুঝি ধসে পড়েছে। এ আতঙ্কে ওই অবস্থায় কিছুদূর চালিয়ে এসে সড়কের একপাশে থামালেন গাড়ি।

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের নর্থ সাউথ রোডে মঙ্গলবার বিকালে সাত তলা ভবনে বিকট বিস্ফোরণের পর কিছু অংশ ধসে পড়ার সময় আশেপাশে উপস্থিত আনোয়ারের মত অনেকই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন; চারিদিক ধুলোয় ঢেকে যাওয়ায় অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসেছিল তাদের মধ্যে।”

এখন পর্যন্ত সত্যিকারের হতাহত মানুষের সংখ্যা পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিভীষিকা চলছে। প্রায় চার ঘণ্টা সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে রাত নয়টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ভবনের বেসমেন্ট ও নিচতলার অনেকটাই ধসে গেছে। ভবনের কলামগুলোও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। যার জন্য তারা ঢুকতে পারছেন না। তারা রাজউক ও সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ মত নিয়েছেন। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে একটু ‘স্টাবল করে’ বাকি উদ্ধার অভিযান করা হবে।

এই বিভীষিকাময় দৃশ্যপটের কোনো কারণ এখনো চূড়ান্ত বলে জানা যায়নি। এর জবাব দেবে কে? প্রথমেই বলে রাখি কারও দ্বারাই সমস্যার সমাধান হতো না। বা মৃত মানুষেরা জেগে উঠতেন না। আহতরা ভালো হয়ে যেতেন না। কিন্তু দায়-দায়িত্ব বলে তো একটা কথা আছে। পবিত্র রজনীর পবিত্রতার আলো নিভিয়ে এমন নির্মম মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? কারা নেবে এর দায়? যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন শুরু হয় পারস্পরিক দোষারোপের পালা। জনগণ দায়ী করে প্রশাসনকে আর প্রশাসন দোষ দেয় জনগণের। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখছি না।

জনবহুল ঢাকা যে অনেক আগেই বাসযোগ্যতা হারিয়েছে এটা যারা বলেন তারা নাকি সরকারের দুশমন। যারা মনে করেন জনচাপে ঢাকা ভেঙ্গে পড়বে তারাও শত্রু। বন্ধুরা এখন কোথায়? যারা ঢাকাকে সিঙ্গাপুর মনে করেন, ঘোষণা দেন আমরা সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে আগে বাড়ছি তাদের কেউ এসব এলাকায় বসবাস করেন না। তাদের বসবাস পশ এলাকায়। তারা সুবিধাভোগী। আর বেশিরভাগ কর্তাদের আরেক নিবাস দেশের বাইরে। ফলে তারা দুশ্চিন্তাহীন। আমাদের মতো আমজনতা দেশের বাইরে থাকলে কত প্রশ্ন তাদের বেলায় লা জবাব। ওই সব কথা থাক। কথা হচ্ছে এভাবে দায় এড়িয়ে মানুষের জীবননাশ হতে দেয়া কি উন্নয়ন? না সফলতা?

ঢাকার জন্য কোনো পরিকল্পনা আছে কি না সেটারও কোনো সদুত্তর মেলে না। যে যেখানে যেভাবে পারছে লুটপাটে ব্যস্ত। আর এই ব্যস্ততার ফাঁকেই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত এক বিশাল নগরী। এখন মাঝে মাঝে এসব ঘটনা ঘটবে, হয়তো একদিন অনেক বড় আকারেরও ঘটবে। কিন্তু টনক নড়বে না। প্রতিবাদ করার মতো একটি শক্তিও এখন আর সক্রিয় নেই। পশ্চিমা দেশে উন্নয়ন আর সমঅধিকার নিশ্চিত হবার পর তারা রাজনীতি বিমুখ হয়েছে। আমাদের বেলায় কি তাই? আমাদের দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বাদ-প্রতিবাদ বন্ধ। ওই দায় তুলে দেয়া হয়েছে পোষ্য কিছু মিডিয়ার ঘাড়ে। যারা মিনমিনে গলায় দশটা প্রশংসার পর একটা সত্য বলে হয়তোবা। তাও খুব কায়দা করে। এখন আসলেই কারো কোনো জবাবদিহিতা নাই।

পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা টিভি দেখলেই বোঝা সম্ভব। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, সাত তলা ভবেনর বেসমেন্টে মূল বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তাদের ধারণা। সেখান আজ পানি জমে গেছে বলে জানান ফায়ার সা‌র্ভিসের ঢাকা জো‌নের উপপ‌রিচালক দিনম‌নি শর্মা। তিনি বলেন, “বেসমেন্টে সম্ভবত পানি ধরে রাখার জায়গা ছিল। সেটা নষ্ট হয়ে পানি ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা এখন পরিস্কার করার কাজ শুরু হয়েছে।”

কত লোকের প্রাণ গেছে বা কত লোক প্রাণ হারাবে তার কোনো হিসেব নেই। এই কি নাগরিক জীবন? আজ সিদ্দিক বাজার কাল হয়তো আর কোথাও। এ যেন রোজকার এক ঘটনা! আমরা দেশের বাইরে থেকে যে আঁচ আর উত্তাপ পাই দেশের মানুষ হয়তো তা অনুভব করে না। যাদের জীবন নিয়ত এমন দগ্ধ তারা কেন টের পাবেন? এসব কথা খুলে বলার সাহসও নেই আজ।

বাংলাদেশর মানুষ এমনিতেই বাজার দরে ক্লান্ত। সামনে রমজান। এর মধ্যে যদি এমন ঘটনা ঘটতে থাকে তা কি কারও জন্য শুভ হবে? আশার খবর এটুকু, ঢাকা জেলার প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের নগদ ৫০ হাজার টাকা; যারা গুরুতর আহত হয়েছেন, তাদের নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং যারা সামান্য আহত হয়েছেন, তাদের ১৫ হাজার টাকা করে প্রদান করছি।”

দুর্ঘটনায় সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে জেলা প্রশাসন একটি সহায়তা বুথ স্থাপন করেছে বলে জানান মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, এই বুথে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা রয়েছেন। বুথ থেকে যারা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা, যানবাহন সহায়তাসহ সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

এসব এখন যাদের কাছে তুচ্ছ তাদের কথা ভাবুন। যাদের স্বজন চলে গেছেন, পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটি চলে গেছেন তাদের জন্য এই টাকা সান্ত্বনা ছাড়া আর কি হতে পারে?

এবারের দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের সমাজ আর প্রশাসন দুই মেরুতে বাস করেন। এই অপরিকল্পিত নগরীর কর্তারা বেশিরভাগ সময় এসব বিষয়কে অতটা গুরুত্বই দেন না। তারচেয়ে বরং নিয়তিনির্ভর মৃত্যু মেনে নেয়াই যেন কাজের কাজ। ঢাকা এমনিতেই তার সুনাম হারিয়েছে। এসব ঘটনা তাকে আরও মলিন করবে। অবশ্য তাতে বড় মানুষদের কি যায় আসে? যত আপদ গরীব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। আহারে মানুষ!