Published : 03 May 2021, 10:59 PM
দুই দশকের বেশি সময় ধরে জাতিসংঘের স্বীকৃতি ও ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে দেশে ৩ মে দিনটি বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্ত গণমাধ্যমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সরকারকে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে মনে করিয়ে দেওয়া। মুক্ত গণমাধ্যম দিবস প্রসঙ্গে মোটা দাগে এমন কথা বলা হলেও মতপ্রকাশের মাধ্যম দুই যুগ পরে এসে আমূল বদলে গেছে তথ্য প্রযুক্তির বৈপ্লবিক আবিষ্কার, বিকাশে ও প্রসারে। এখন গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিস্তৃত নিয়ন্ত্রিত অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কার্যকর।
সঙ্গত প্রশ্ন জাগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি মূলধারার গণমাধ্যমকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে? ক্ষেত্রবিশেষে তা সত্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সত্য নয়। সেটা আবার কেমনে? ধরুন, কোন খবর গণমাধ্যমের সীমিত যোগাযোগ বলয় এবং সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে সময়মত চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি মানুষের হাতের মুঠোয় সামাজিক যোগাযোগ থাকার কারণে তা মুহূর্তে প্রচার পেয়ে যায়। তার মানে কি গণমাধ্যমের গুরুত্ব কমে গেল? তা অবশ্যই নয়। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দায়িত্বশীল মহলের পেশাদারী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তথা বা উপাত্ত বা খবর যাচাই বাছাই না হয়ে প্রচার পাবার কারণে ভুয়া প্রচারণা, মিথ্যা রটনা, কুৎসা ছড়ানো, হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন, গুজব ছড়ানো, কলহ বাড়ানো, অরাজকতা সৃষ্টি করার মত সম্ভাবনা থাকে। কার্যত এমনটা অহরহ ঘটেও থাকে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরকে গণমাধ্যমের বিকল্প গ্রহণযোগ্য কোন সূত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবার আপাত সঙ্গত কোনও সুযোগ নাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ খপ্পর থেকে রক্ষা পেতে হলে দরকার দায়িত্বশীল পেশাদারী গণমাধ্যম। কিন্তু বলগাহীন নীতি ও দায় বিবর্জিত পুঁজিবাদী নব্য উদারনৈতিক গণব্যবস্থাপনায় সরকারের ভেতরে বাইরে নানা খপ্পরের কবলে থাকে গণমাধ্যমের নাটাই। আর এ নাটাইয়ে কার হাতে কিভাবে পড়ে, সে অনুযায়ীই আমাদের গণমাধ্যম নড়েচড়ে।
আমাদের দেশের সর্বাদিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিকগুলোর একটির সম্পাদকীয় পর্যায়ের একজন নীতিনির্ধারক কর্তা সম্পাদক হাল আমলে তার পত্রিকার মালিকের জন্মদিন উপলক্ষে কিছু কথা লিখেছেন। কথাগুলোর অংশবিশেষ এরকম-
… কাজ করার সুবাদে কাছ থেকে দেখেছি শিশুর মতোন কোমল মানবিক মন। দেহ থেকে মন তার এতোটাই বড় যে সবাই বলেন, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্তই তার কলিজা। ৩১ জানুয়ারী ছিল আমাদের প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলায় যেতে পারিনি। আমি তার শতায়ু কামনা করি।
এ ঘটনার পর দেখা গেল খোদ এ মালিক মহোদয় একটি আত্মহত্যা প্ররোচিত মামলার একমাত্র আসামী। শুধু তাই নয়, তার ব্যবসাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জমি দখল, ঘুষ, দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। এতকিছু কি খোদ সম্পাদক মহোদয়ের জানার বাইরে? আলবৎ নয়। ওই যে বলেছিলাম, মাজেজা হচ্ছে নাটাই যার হাতে তিনি যেভাবে তার আঙুল নাড়াবেন নাটাইয়ে তো সেভাবেই টান পড়বে। আর আকাশের ঘুড়ি সেভাবেই উড়ে।
আমাদের গণমাধ্যম আর গণমাধ্যমের সম্পাদকদের হয়েছে তেমন দশা। তাই সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের দেশের প্রায় ক্ষেত্রে সম্পাদকদের সম্পাদকীয় নীতি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর পেশাদারিত্ব সম্পর্কে নানা বুলি আওড়ানো কেবলই কথার কথা।
এ অবস্থা কি একদিনে হয়েছে? অবশ্যই নয়। গণমাধ্যম আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট দেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম দশকেই ঘটেছিল।
আমাদের দেশের মুক্ত গণমাধ্যমের সংকটের কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ বাকশালের প্রসঙ্গ টানেন। এ বিষয়টাও আমি খোলাসা করতে চাই। ১৯৭১ স্বাধীনতার পর যে বাস্তবতায় বাকশাল কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল যথার্থ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপের তাৎপর্য মেনে নিয়ে গণমাধ্যমকেও সেই পরিবর্তিত কাঠামোর মাধ্যমে আনা সঙ্গত ছিল। যারা বাকশাল কর্মসূচির অধীনে গণমাধ্যমকে পরিবর্তিত কাঠামোর অংশ করায় সমালোচনা করেছিলেন, হাঙ্গামা করেছিলেন, সেই তারাই ১৯৭৫ এর ট্রাজেডির পর সামরিক সরকারের কাছ থেকে সুযোগ নিয়েছেন, চাকরি নিয়েছেন, প্লট নিয়েছেন, পুরস্কার নিয়েছেন, রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। এমন কি মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত করেছেন! এসব তারা করেছেন গণমাধ্যমে তাদের পরিচিত অবস্থান ও নামকে ব্যবহার করে। তাহলে গণমাধ্যমের নীতি আর মানদণ্ড কোথায় গেল?
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেড় দশকে দুই সামরিক স্বৈরাচারের শাসনামলে গণমাধ্যমের দুটি ধারা বলবৎ ছিল। একটি ধারা সরকারমুখী সুযোগ সুবিধা ভাগিয়ে নেওয়ার দল। আরেকটা মূলধারার পেশাদারী গণমাধ্যম। দ্বিতীয় ধারাটি নানা বিপদ আপদ আর খড়্গ মাথায় নিয়ে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের জানমাল রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন, সময়ে সময়ে বিপদেও পড়েছেন। তারপরও পেশাদারী ঐক্যটা ছিল। সাংবাদিক ইউনিয়নে পেশাদারি ঐক্যবদ্ধ প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ছিল। 'সম্পাদক' পদটির একটি প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা আর বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবমূর্তি ছিল। এখনকার সম্পাদকরা সামান্য কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া সেই মর্যাদা আর ভাবমূর্তি খুইয়ে বসেছেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সম্পাদকরা ডান-বামে না তাকিয়ে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করেন? তারা যেমন পাঠকের স্বার্থ দেখেন না, তেমনি দেখেন না অধীনস্ত গণমাধ্যমের কর্মীদের অধিকার। তারা মুখে মুখে জাতীয় স্বার্থের কথা বললেও, এই 'জাতীয়' মানে মালিকের জাতীয় স্বার্থ। এটা করতে গিয়ে তারা পেশাদারী বিবর্জিত নির্লজ্জ দৃষ্টিকটূ সাংবাদিকতার চর্চা করে থাকেন। অনেক সময় কর্পোরেট শত্রুতা সাধনও করে থাকেন। এক কর্পোরেট গোষ্ঠীর গণমাধ্যম প্রতিপক্ষ কর্পোরেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসত্য, মিথ্যা, কুৎসাপূর্ণ প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন ছেপে থাকেন। এরকম চর্চায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে এক সম্পাদক তার নিজের প্রতিষ্ঠিত কাগজ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু তাতে কী? মালিকরা যে ধরনের নির্লজ্জ অপেশাদার পুতুল সম্পাদক চান সেরকম সম্পাদক তো অভাব নাই।
সস্তা জনপ্রিয় কথা-সাহিত্যের পরিচিত একটি নাম যিনি ওই কাগজের তৃতীয় কাতারের সাংবাদিক ছিলেন হয়ে গেলেন সম্পাদক। ইনি সব সরকারের আমলে বোল এবং চাল পাল্টে চলায় পটু। আর মালিকদের পছন্দ এরকম মানের সম্পাদক। যে কারণে যাদের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সুনাম আছে, লেখার হাত আছে, পেশাদার সম্পাদক হবার হিম্মত আছে, তাদের চাহিদা বর্তমান গণমাধ্যেমের বাজারে মালিকদের কাছে নাই।
কারা এসব গণমাধ্যেমের মালিক? খুব অল্প সময়ে ফুলে ফেপে ওঠা অবৈধ টাকার মালিক নব্য কর্পোরেট গোষ্ঠী। এদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের বিস্তর অভিযোগ। জন্মই যাদের আজন্ম পাপের মত ব্যবসায়িক উত্থান তাদের, এদের কাছ থেকে পেশাদারী বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম আশা করাটাই একটা বাহুল্য চাওয়া। আমরা এ বাহুল্য চাওয়াতেই আছি।
এবার সাংবাদিকতার ঐক্য-অনৈক্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯৯০ দশকে গণতান্ত্রিক শাসনামলে এসে সাংবাদিকরা তাদের ঐক্য খোয়ালেন। ইউনিয়ন ভাগ হয়ে গেল। বিপরীতে একের পর এক সংগঠন দাঁড়াতে শুরু করল। কতরকম প্রতিবেদক সংগঠন যে আছে তার একটা দীর্ঘ তালিকা হবে। কিন্তু এর কোনোটা কি গণমাধ্যমের পেশাদরী বা সামগ্রিক পেশাদারী স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে? গণমাধ্যেমের কর্মীদের চাকরি বরাবর ঠুনকো অবস্থায় থাকে। না সম্পাদক তাদের রক্ষা করে, না কোনও পেশাদারী ইউনিয়ন বা সংগঠন তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রাখে। এরকম বাস্তবতায় একটি গণমাধ্যেমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই বা কি; কিংবা এর কর্মীদের কাছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে কি? সুকান্তের কবিতার লাইনের মত নয় কি- 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি'।
কিছু কিছু সম্পাদক দেশি বিদেশি নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এ যোগাযোগ তারা করেন তাদের মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এবং নিজের কিছু সুবিধা পাইয়ে নেওয়ার খায়েশ থেকে। যে কারণে দেশের বা গণমাধ্যমের সংকটে তেমন কোন সম্পাদক এ মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া বিরল, যারা একটি যুগান্তকারী অবস্থান নিতে পারেন। আমরা যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু আপত্তিকর ধারার কথাই ধরি, তাহলে পরিস্কার হবে বিষয়টা। এ বিষয়ে সম্পাদকেরা নমঃ নমঃ আপত্তি জানিয়ে থাকে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো কোন প্রতিবাদী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। কারণ তাদের সেই নৈতিক সাহসের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সম্পাদকদের সম্পদের হিসেব চেয়ে বসলে, অনেকের ঘুম যে হারাম হয়ে যাবে। এটা কি সম্পাদকরা জানেন না?
তাই কোনও গণমাধ্যমের উপর বা কোন পেশাদারী সম্পাদকের বিরুদ্ধে নিতান্তই হয়রানির উদ্দেশে কোন কর্তৃপক্ষ পর্যায় থেকে বা ব্যবসায়ী মহল থেকে হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নিলেও বাকি গণমাধ্যমগুলো চুপ থাকে। যদিও সম্পাদক পরিষদ এবং এডিটরর্স গিল্ড নামে দুটো সংগঠন রয়েছে। কিন্তু এই দুটি প্লাটফর্ম সম্পাদকীয় উন্নয়ন সাধনে উল্লেখযোগ্য কি ভূমিকা রেখেছে, আমার জানা নাই। পেশাদারী গণমাধ্যেমের বিরুদ্ধে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে বিবদমান বাধা আর গলদগুলো চিহ্নিত করে ধারাবাহিক কোন পদক্ষেপ তারা কি নিতে পেরেছেন? তাহলে?
এ সময়ে বড় একজন ব্যবসায়ী একটি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে একটি ফৌজদারী মামলার একমাত্র আসামী। এ ঘটনা কেন্দ্র করে আমাদের গণমাধ্যম তিন ভাগে বিভক্ত। ওই আসামীর মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলো খবরটি বেমালুম চেপে যাচ্ছে। কতিপয় গণমাধ্যম মূল ঘটনার থেকে চোখ সরাতে অন্যকিছু চটকদার কিছু ছাপছে। আর শেষোক্ত গণমাধ্যমগুলো খবরটি ছাপছে যথাসাধ্য প্রচলিত ধারা বজায় রেখে।
আরো একটি উদাহরণ দিতে চাই, গণমাধ্যমের সম্পাদকদের জন্যে ২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামল ছিল কষ্টিপাথরের কাল। ওই সময় নিউএইজ এবং বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম এর মত দুই একটি কাগজ ছাড়া বেশির ভাগ গণমাধ্যম একটি সংস্থার পাঠানো খবর কোন রকম যাচাই-বাছাই ছাড়া হুবহু ছেপেছে। এটাকেও কি সম্পাদকীয় নীতির উদাহরণ বলব?
কোন কোন সম্পাদক আবার বিদেশি দূতাবাসের মনোযোগ রক্ষা করে চলেন। কেউ কেউ আবার সম্পাদকের পদ ব্যবহার করে সরকারের পতনের প্রকল্পে অংশ নিয়ে থাকেন। দুনিয়ার কোন দেশে সম্পাদকদের এরকম বারোয়ারি নিশানা, আমি জানি না। এরকম বারোয়ারি নিশানা নিয়ে আর যাই হোক, মানসম্মত পেশাদারী স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ হতে পারে না।
এক সময় পত্রিকাগুলোর নিজস্ব সম্পাদকীয় প্যানেল থাকত। সম্পাদকীয় পাতায় নিজস্ব লেখার বাইরে কোন লেখা ছাপা হতো না- বিশেষ করে সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় বিভাগে। উপসম্পাদকীয়ে সেই ঐতিহ্য এখন কি আছে? বরং নানা পদধারীদের ছবকীয় লেখার ছাড়ছড়ি।
আগে কোন খবর বা লেখায় কেউ ক্ষুব্ধ হলে প্রতিবাদ পাঠানোর এবং তা ছাপানোর রেওয়াজ ছিল। এখন কোন প্রভাবহীন, পদহীন বিক্ষুদ্ধ কেউ প্রতিবাদ পাঠালে উপেক্ষা করা হয়। অন্যদিকে প্রভাবশালী বা পদধারী কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন করলে পত্রিকাগুলো লেখা প্রত্যাহার করে নেয়। এরকম লেজগুটানো প্রবণতার শেষ কোথায়?
একটি গল্প বলে লেখাটা শেষ করছি।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস এবং একটি গল্প
সব জায়গায় ঝাড়িঝুড়ি মারি। পার পেয়ে যাই। সমস্যা হয় না। সকলেই বাহবা দেয়। সমস্যা হলো নিজের ঘরে। একদিকে আমার বউ। অন্যদিকে আমার মেয়েটা। ইনি আবার মায়ের চেয়ে এক কাঠি সরেস। এতদিন ছোট ছিল এটা-সেটা বলে পার পেয়ে যেতাম।
নিজের মত চলব সে সুযোগ নাই। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়ে তো নয় ঘরের শত্রু বিভীষণ। এখন আমার মেয়ের কথা শুনলে তো আমার ক্যারিয়ারের বারটা বাজবে। আর না শুনলে বাবা মেয়ে আগুনে কাঁঠালে বিচি।
আপনাদের একটা ঘটনা খোলাসা করে বলি, তাহলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। তেসরা মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এ নিয়ে আমার পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। চমৎকার হয়েছে লেখাটা। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সেমিনারে বক্তৃতা করলাম; রাতে টেলিভিশনে টকশোতে কথা বললাম। সব ঠিক আছে। অনেকে বাহবা দিল, টেলিফোন করল। সেই সঙ্গে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস, লাইকের পর লাইক, খোশ মেজাজে ঘুমাতে গেলাম। সকালে নাস্তার টেবিলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা হতেই সব কিছু গুবলেট করে দিল।
আব্বু, আচ্ছা তুমি একটা কথা বল তো, তুমি যা বল, তোমার পত্রিকায় যা লিখ, তা কি নিজে বিশ্বাস কর? তা কি নিজে মান?
– মানে?
– মানে হলো গতকাল ছিল তেসরা মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। তোমার সেমিনারে যেতে পারিনি আমি। রাতে তোমার টকশো শুনেছি। সকালে তোমার পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়লাম। পুরোটাই একটা দ্বিমুখিতা, এক্কেবারে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড!
– কি বলছিস?
– বলা শেষ হয়নি আব্বু। ধৈর্য্য ধরে শুনো। তোমার অফিসের সবচেয়ে মেধাবী আর সৎ সাংবাদিক ছেলেটার চাকরি খেলে কেন? গতকালকেই তেসরা মে তারিখে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে।
– তাহলে শোন, তুই তো জানিস আমি হচ্ছি বেতনভুক্ত সম্পাদক। ছেলেটার কোনো লেখায় মালিকদের একজনের আপত্তি ছিল। আমাকে বলেছিল, ছেলেটাকে সতর্ক করে দিতে। আমি ছেলেটাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম বটে।
– এরপরে আরো দুটো লেখা ছেলেটা লিখেছে। আমি দেশের বাইরে ছিলাম। লেখা দুটো ছাপাও হয়েছে। এতে মালিকরা ভয়ঙ্কর রকম ক্ষেপে গেছে। তুই তো আমার মেয়ে, তোকে খুলেই বলি-
মালিকদের একজন বিদেশি ওষুধের লেভেল আমদানী করে। কিন্তু ওষুধটা দেশেই তৈরি হয়। অথচ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওষুধ হিসেবে বাজারে ছাড়ছে। এক্কেবারে তেলের দরে জল বিক্রি যাকে বলে। এ ঘটনা ছেলেটা একটা লেখায় ফাঁস করে দিয়েছে। যদিও সে নির্দিষ্ট করে কোনও কোম্পানির নাম উল্লেখ করেনি। তাহলে বোঝ। মালিকপক্ষ আমাকে ডেকে বলল- এক্ষুণি ছেলেটাকে বিদেয় করুন।
– বুঝেছি বাবা। বিদেয় করেছ, ভালো করেছে। নিজের চাকরি রক্ষা করেছ। একই সঙ্গে এরকম দ্বিমুখী সুশীল সম্পাদক সাজা বন্ধ কর। মানুষ এসব ভণ্ডামি বোঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুরা এসব নিয়ে ছেড়ে কথা বলে না। এসব আমার ভালো লাগে না এদকম।
এই কথা বলেই নাস্তার টেবিলে এমন জোড়ে ঘুষি দিল- নাস্তা, থালা গ্লাস সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।
মেয়েটাও হরহর করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।