Published : 13 Apr 2021, 12:53 AM
এক
এক বছর আগের ঘটনা, মনে আছে হয়তো অনেকেরই। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের 'নিখোঁজ' হওয়া, গভীর রাতে আকস্মিকভাবে বেনাপোল সীমান্তে 'উদয়' হওয়া, বিজিবি ধরে পুলিশে হস্তান্তর, গ্রেপ্তার, আজব মামলা, পিছমোড়া করে দুই হাত বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া এবং অবশেষে কারাগারে প্রেরণ। এ পুরো ঘটনাটি অনভিপ্রেত এবং বেদনাদায়ক।
এরপর আমার একসময়ের সহকর্মী সাংবাদিক আহসান কবিরের ছোট ভাই কার্টুন শিল্পী আহমেদ কবির কিশোরসহ কয়েকজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের ঘটনাটিও মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে । কিশোর আমার সঙ্গেও কাজ করেছেন। এরা কী অপরাধ করেছেন আমি জানি না। তারা সরকারের জন্য কী এমন বিপদজনক কাজ করেছেন যে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মামলা-হামলার আশ্রয় নিতে হলো? সরকার এতো নার্ভাস থাকলে তো মহামুশকিল। 'ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা'- দেশে এমন পরিস্থিতি কারা তৈরি করছে? সরকার নিজেদের জনপ্রিয় বলে দাবি করে। কোনও জনপ্রিয় সরকারের দেশ চালাতে হাঁটু কাঁপার কথা নয়। সাংবাদিক বা স্বাধীনভাবে যারা লেখালেখি করেন তাদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কি এসবে অনুমোদন আছে? নাকি হুঁকোর চেয়ে ছিলিমের গরম বেশি-সেটাই আমাদের দেখতে হচ্ছে?
সরকারে থাকলে বিরোধিতা হবেই। বিরোধিতার চেয়ে প্রশংসা অনেক সময় বেশি ক্ষতির কারণ হয়। যে সরকার শুধু প্রশংসা শুনতে চায়- সে তো হীরক রাজা। হীরক রাজা প্রজাদের মগজ ধোলাই করে নিজেকে 'ভগবান' বানানোর চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত 'খানখান' হয়েছে।
কারো বিরুদ্ধে যদি গুরুতর কোনো অসদাচরণের অভিযোগ থাকে, কেউ যদি শান্তি ও স্থিতি বিনষ্ট করার মতো কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে সেটা স্পষ্ট করে সবাইকে জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অবশ্যই, কেউই আইনের উর্দ্ধে নয়। তবে ভৌতিক অভিযোগে কাউকে অন্যায় হয়রানি করা চলবে না।
দেশের গণমাধ্যমগুলোতে এখন একধরনের সংকট চলছে, অস্থিরতা চলছে। এরজন্য কে দায়ী, কেন এমন হচ্ছে- তা ভিন্ন আলোচনা। বর্তমান বাস্তবতা হলো কয়েকটি গণমাধ্যমে কর্মী ছাঁটাই চলছে। অনেক গণমাধ্যমই সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিচ্ছে না। করেনাকালে একদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বেতন না পাওয়ার শঙ্কায় তাদের জীবন আসলে দুঃসহ। কয়েকজন সাংবাদিক করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকেই করোনা-আক্রান্ত। মালিক পক্ষের কাছে যখন অধিক সংবেদনশীলতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তখন তারা কঠোরতার পরিচয় দিচ্ছেন। সাংবাদিকদের সুবিধা-অসুবিধার দিক সরকারকেও সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সরকার যেসব গণমাধ্যমে দেদারসে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, ভুয়া প্রচার সংখ্যা দেখিয়ে যারা বেশি মূল্যের বিজ্ঞাপন বাগিয়ে নিচ্ছে, শুল্কমুক্ত নিউজপ্রিন্ট নিচ্ছে, সেসব মালিক বা গণমাধ্যম যদি সাংবাদিকদের ঠিকমতো বেতন পরিশোধ না করে- তাহলে এক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ অবশ্যই দরকার।
পোশাক শিল্পে 'কমপ্লায়েন্স' বলে একটি শব্দ চালু হয়েছে। গণমাধ্যমের জন্যও তেমন কিছু ভাবা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের কাছে সততা, সাহসিকতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা আশা করলে তাদের সম্মানজনকভাবে জীবন ধারণের নিশ্চয়তাও দিতে হবে। সাংবাদিকের জীবন হাঁসের জীবন নয়। হাঁস কাদা-প্যাকের মধ্যে থেকেও গা-ঝাড়া দিয়ে সাফসুতরো হয়ে চলতে পারে। সাংবাদিকদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তারা মানুষ। অন্য সব পেশাজীবী মানুষের যেমন মানবিক ত্রুটি-দু্র্বলতা আছে, কোনো কোনো সাংবাদিকেরও তেমন থাকতে পারে।
আমার একটি লেখার সূত্র ধরে আমার একজন অকৃত্রিম সুহৃদ আবেদীন কাদের মন্তব্য করেছেন, 'পশ্চিমা দেশগুলোতে পত্রিকা ও সাংবাদিকরা রাজশক্তির কাছে বিক্রি হয় না বা প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় পত্রিকা চালায়, রাজকোষ নয়। এছাড়া পশ্চিমা দেশে সাংবাদিকরা জমি বা বাড়ি বা অসুখের ছলায় রাজকোষ থেকে টাকা নেয় না'।
খুব সুন্দর কথা। এটা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ আছে। আজ শুধু এটুকুই বলছি যে, পশ্চিমা দেশের সাংবাদিকরা কেউ হাওয়া খেয়ে বাঁচেন না। কেউ ফুটপাথ বা গাছতলায় বসবাস করেন না। ওসব দেশে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতা কি আমাদের দেশের মতো? ওখানে সাংবাদিকদের পেশা কি অনিরাপদ?
বাংলাদেশে অন্য পেশাজীবীরা যদি জমি বা বাড়ি কিংবা চিকিৎসা সহায়তা সরকারের কাছে নিতে পারে, তাহলে সাংবাদিক, যাদের বেতন নামমাত্র কিংবা অন্য সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে, তারা কোনও রাষ্ট্রীয় অনুকম্পা পেলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে কেন?
দুই
আমাদের দেশে গণমাধ্যমের অবস্থা যে খুব ভালো নয়, সেটা বোঝার জন্য কোনও গবেষণার দরকার নেই। সামরিক ডিক্টেটর এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের পালে হাওয়া লাগে। সেই সুবাদে গণমাধ্যমেরও ব্যাপক প্রসার ঘটে। অনেক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয়। এর পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেরও সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শত ফুল ফোটার আনন্দে আমরা বগল বাজাতে থাকি। অনেকের কর্মসংস্থান হয়। সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়ে।
তবে এখন আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে, দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও গুণগত মান বাড়েনি। গণমাধ্যমের মালিকদের সুবিধা হলেও সাংবাদিকদের সমস্যা বেড়েছে।
গণতন্ত্রের সুবাদে আমাদের দেশের রাজনীতি যেমন চলে গেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে, তাতে রাজনীতির বারোটা বেজেছে, তেমনি গণমাধ্যমের মালিকরাও মূলত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হওয়ায় গণমাধ্যমেরও 'সর্বনাশ' হয়েছে। 'মুক্ত' গণমাধ্যমের জন্য যারা হাহাকার করেন, তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না, ব্যবসায়ীরা নিজেদের 'মুক্ত' লাভের বিষয় ছাড়া অন্য কোনো মুক্তি বোঝেন না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন কার্যত মালিকদের স্বাধীনতা। মালিকরা যেভাবে চান, সেভাবেই সব কিছু চলে। সাংবাদিকদের কোনও স্বাধীন বা স্বতন্ত্র অবস্থান নেই বললেই চলে। পেশাজীবী সম্পাদক নেই তা বলা যাবে না, তবে তারা মূলত মালিকের স্বার্থ দেখভালের জন্যই নিয়োজিত হন। মালিকের হয়ে লবিং করা অনেক সম্পাদকের অন্যতম কাজ।
একসময় বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের বাহক হিসেবে সংবাদপত্র প্রকাশ হতো। তখন বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা পত্রিকা প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন না। মোটামুটি স্বচ্ছল এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই পত্রিকা বের করা হতো। দৈনিক আজাদ ছিল মুসলিম লীগের কাগজ। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁ সক্রিয় মুসলিম লীগ করতেন। তবে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশনে পক্ষপাত কম থাকতো। বঙ্গবন্ধু 'কারাগারের রোজনামচা'য় ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬-দফা আন্দোলনের সময় আজাদের সংবাদ পরিবেশনের প্রশংসা করেছেন। আজাদ মুসলিম লীগের কাগজ হলেও এখানে কাজ করেছেন বামপন্থি চিন্তার সন্তোষ গুপ্ত। কোনও সমস্যা হয়নি। এখন এটা ভাবা যায়?
দৈনিক ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের কাগজ হিসেবে পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু ইত্তেফাকে কাজ করেছেন সুপরিচিত কমিউনিস্ট আহমেদুর রহমান (ভীমরুল), আলী আকসাদ। কোনও সমস্যা হয়নি। দৈনিক সংবাদ ছিল বামপন্থিদের কাগজ (যদিও প্রথমে মুসলিম লীগেরই ছিল)। এই যে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাগজগুলো চলতো, তাতে কি পাঠকের কোনও আপত্তি ছিল?
আমাদের যারা প্রবাদপ্রতীম সাংবাদিক তারা সবাই কোনও না কোনও রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মওলানা আকরম খাঁ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আব্দুস সালাম, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, শহিদুল্লাহ কায়সার, আবু জাফর শামসুদ্দিন- কেউ রাজনীতি-নিরপেক্ষ ছিলেন না। বরং রাজনীতির প্রতি তাদের সবারই বিশেষ পক্ষপাত ছিল। কিন্তু সবাই ছিলেন পেশাগত ক্ষেত্রে সৎ এবং নিষ্ঠাবান।
ভালো সাংবাদিক হওয়ার জন্য 'রাজনীতি' যে কোনও সমস্যা নয়, সেটা বলা যায়।
তাহলে এখন আমরা সব কিছুর জন্য রাজনীতিকে কেন দায়ী করি? কারণ সম্ভবত এটাই যে রাজনীতি এখন আগের মতো নেই। ভালো রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। খারাপ রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। ভালো রাজনীতি ভালো সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করেছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এখন খারাপ রাজনীতি 'প্রমোট' করছে মন্দ সাংবাদিকতাকে। যারা সৎ, যারা নিষ্ঠাবান- তারা এখন অযোগ্য বলে বিবেচিত। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটা আলোচনায় আসার মতো নয়।
বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকারহীনতা নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। এর জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়। অবশ্যই নাগরিকের কণ্ঠরোধের দায় সরকারেরই। সরকার আনুগত্য চায়। প্রশংসা চায়। তবে বিরোধিতা করলেই তাকে জেলফাঁসি দেওয়ার ঢালাও অভিযোগ করাও যুক্তিহীন।
প্রশ্ন হলো, স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশের পথে মালিক-সম্পাদকদের কী কোনও ভূমিকা নেই? গণমাধ্যমকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য আগ বাড়িয়ে কর্তাভজা কীর্তন কী মালিকরা গাইতে বাধ্য করেন না চাকরিজীবী সাংবাদিকদের ?
তিন
২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা সাতটি দেশ ও জোটের রাষ্ট্রদূতেরা এক টুইট বার্তায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও কার্টুনিস্টের বিরুদ্ধে মামলা করায় গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতদের টুইট বার্তার বক্তব্য প্রায় অভিন্ন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত আার্ল মিলার তার টুইটে লিখেছেন, 'জনস্বার্থ সুরক্ষায় অবাধ ও স্বাধীন গণমাধ্যমের নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রচারের সুযোগ থাকা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা যেমন জরুরি তেমনি গণমাধ্যমকর্মীর কণ্ঠও যাতে রোধ করা না হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে'। অন্যদের বক্তব্যও প্রায় একই বলে আর উদ্ধৃত করছি না। পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের এই বার্তা কারও কারও কাছে প্রশংসিত হবে। আবার তাদের এই নাক গলানো অপছন্দও করবেন অনেকে। সরকারও এটা পছন্দ করেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের বক্তব্যকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন।
আমাদের দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক আছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব অবস্থায়, সব ক্ষেত্রে অবাধ কি-না আমি জানি না। ওসব দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমার কাছে সেটা অনেকটা 'না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ'-এর মতো। তবে স্পন্সরড সাংবাদিকতা যে ওসব দেশেও আছে তা কি মাঝে মাঝে শোনা যায় না? ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় 'এমবেডেত সাংবাদিকতা'র কথা কি আমরা শুনিনি? তখন সামরিক বাহিনীর ছাড় করা সংবাদই মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যারা দুনিয়া জুড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য জারি রাখতে চায় তারা সব সময় 'বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রচার' করতে সবাইকে সমানভাবে উৎসাহিত করে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। যে খবর তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধ যায়, সে খবর 'কিল' করার ভূরি ভূরি নজির আছে। আবার ভুয়া খবর পরিবেশন করে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার নিন্দনীয় উদাহরণও আমাদের সামনে আছে।
আমরা যে অনেক সময় নানা বিষয়ে পশ্চিমের দৃষ্টান্ত দেই, এটাও আমার কাছে খুব ভালো লাগে না। পশ্চিমের সমাজ, রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চর্চা – কোনোটাই আমাদের মতো নয়। তবে হ্যাঁ, ভালো জিনিস গ্রহণের মতো উদারতা অবশ্যই থাকা উচিত।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রই এখনো ভঙ্গুরতা কাটিয়ে শক্ত ভিত গাঁথতে পারেনি। আমাদের দেশে যারা উদার গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারাও সর্বোতোভাবে সামন্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিকভাবে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বরদাশত করেন না, তারাই আবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হাহুতাশ করেন।
অনেকে হয়তো অখুশি হবেন, তারপরও আমি এটা মনে করি যে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার পরিবেশ এখন নেই। খুব সহসাই সেটা হবে বলেও আমি মনে করি না। গণমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনা যাদের হাতে, তারা কেউ নিজেদের স্বার্থের পরিমণ্ডলের বাইরে হাঁটতে চাইবেন না।
অনেকে মনে করেন, সরকারই বুঝি একমাত্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। একটা সময় পর্যন্ত হয়তো এটা ঠিক ছিল। সরকার যখন একা নিয়ন্ত্রক হয়, তখন সাংবাদিকরা সাহস ও সততার পরিচয় দিতে পারে। তার প্রমাণ পাকিস্তানি আমল, এমন কি স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন আমলেও গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা যে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে, এখনকার বাস্তবতায় সেটা সম্ভব নয়। এখন নিয়ন্ত্রণ দুই তরফে। একদিকে সরকার, অন্যদিকে মালিক পক্ষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা গেলেও মালিক বা মালিক নিয়োজিত সম্পাদকের নিষেধ অমান্য করা যায় না। সরকার মামলা দেয়, মালিক চাকরি খায়।
সাংবাদিকদের কাছে সবাই সততা, সাহসিকতা, দৃঢতা আশা করেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকের সরাসরি সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাজার অর্থনীতি ও ভোগবাদী জীবনের যুগে কেবল সাংবাদিকদের কাছে উচ্চতর মূল্যবোধ আশা করা এক ধরনের হিপোক্রেসি ছাড়া আমার কাছে আর কিছু মনে হয় না। জীবন-জীবিকার ন্যূনতম নিশ্চয়তা না থাকলে সাহস বা সততা দেখানো খুব সহজ কাজ নয়। মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকবে, যে সামান্য বেতন অনেক গণমাধ্যম থেকে দেওয়া হয় তাতে মাসের ঘর ভাড়াও হয় না। খেয়ে না-খেয়ে যে সাংবাদিকদের জীবন চলে তার পক্ষে কী করে সম্ভব সততার সঙ্গে পেশার মহত্ব বজায় রাখা? বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করবে না, 'বস্তুনিষ্ঠ' সংবাদের পেছনে ছুটবে?
বড় কথা বলা সহজ। বড় কাজ করা কঠিন। বিজ্ঞাপনদাতার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো সংবাদ কি কোনও গণমাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশ করা যায় বা হয়? একজন সাংবাদিক খেটেখুটে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করলেই কি তা প্রকাশ বা প্রচার হবে? সেটা তো কেবল সরকারি মহলের আপত্তির কারণে প্রকাশ-অযোগ্য হবে না, মালিক-সম্পাদকেরও মনঃপূত হতে হবে। আর মালিক-সম্পাদকের মন কোন কোন ঘাটে বাঁধা, সেটা একজন সাংবাদিকের না-ও জানা থাকতে পারে!
আচ্ছা, মুক্ত সাংবাদিকতা মানেই কি সৎ সাংবাদিকতা? স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা কী বলে? বাকশাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তো সংবাদপত্রের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সেসময় হক কথা, হলিডে, গণকণ্ঠ ইত্যাদি পত্রিকাগুলো কি সৎ সাংবাদিকতা করেছে? যা খুশি তা বলা বা লেখার নাম কি মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা?
চার
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি-না সেটা কিছুটা বিতর্কিত বিষয়। কেউ মনে করেন দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, আবার কেউ মনে করেন আছে। তবে সরকার পক্ষ তাদের সমালোচনা পছন্দ করে না– এটা ঠিক। শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই গণমাধ্যমের ওপর বা স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর অসহিষ্ণুতা দেখানো হচ্ছে ব্যাপারটা তেমনও নয়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বঙ্গবন্ধুর আমল ছাড়া আর সব আমলেই হয়েছে। তবে আমরা যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকারকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী বলে মনে করে থাকি। কারণ বর্তমানটা আমাদের কাছে যতোটা জ্বলজ্বলে, অতীতটা ততেটাই ধূসর।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বছরখানেক আগে এক বিবৃতিতে সরকার সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন করছে বলে উল্লেখ করে বলেছেন, 'সত্য উদ্ঘাটন করাই তো সাংবাদিকদের কাজ'। কোনো সন্দেহ নেই, সত্য উদ্ঘাটন করাই সাংবাদিকদের কাজ। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কি এটা মির্জা সাহেবদের মনে ছিল? বিএনপি আমলে কি দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন কম হয়েছে? বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যাও করা হয়েছে। হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা, শামসুর রহমান, দীপঙ্কর চক্রবর্তী খুন হয়েছিলেন কোন আমলে? কোনো হত্যাকাণ্ডের কি সঠিক তদন্ত ও বিচার হয়েছে? আমাদের দেশে ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতিবিদরা যা বলেন ক্ষমতায় গিয়ে তার বিপরীতটা করেন। রাজনীতির এই বৈপরীত্য সমাজের অন্য ক্ষেত্রগুলোকেও প্রভাবিত করে থাকে। গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতাও রাজনীতির 'মন্দ' হাওয়া থেকে মুক্ত নেই। মুক্ত থাকার বাস্তব কারণও নেই।
আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যেমন দুর্নীতি-অসততা আছে, তেমনি সাংবাদিকদের মধ্যেও আছে। তবে এরমধ্যে মাত্রা ভেদ আছে। অন্য পেশার তুলনায় সাংবাদিকদের মধ্যে দুর্নীতি ও অসততা কম বলেই আমার ধারণা। কোনো সাংবাদিকর পুকুরচুরি, সাগরচুরির সুযোগ নেই। সাংবাদিকদের কেউ কেউ কিছু 'ধান্ধা' করেন না, তা আমি জোর দিয়ে দাবি করবো না। ধান্ধাবাজ সাংবাদিকের সংখ্যা কম। স্বল্প বেতন এবং অনিয়মিত বেতনের কারণে সাংবাদিকদের কেউ হয়তো কারও কাছে কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকতে পারেন। তাতে অন্যের কোনো ক্ষতির কারণ ঘটে বলে মনে হয় না।
ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৮৬ সালে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র 'একতা'য় কাজ করতাম। মাসিক বেতন আটশ টাকা। সেসময় আমি বিয়ে করলাম। বিয়ে করার কারণে (যেহেতু স্ত্রী চাকরি করতো না) বেতন বেড়ে হলো বারো শ টাকা। একটি কমিউনিস্ট পরিবারের সঙ্গে সাবলেট থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। থাকা-খাওয়া বাবদ তাদের দিতে হতো দুই হাজার টাকা। অন্য খরচ-খরচা যদি বাদও দেওয়া হয়, তাহলেও আমার বেতনের চেয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যয় আটশ টাকা বেশি। নতুন বিয়ে। কীভাবে ব্যয় নির্বাহ করেছি? সাপ্তাহিক যায়যায়দিন- এ আমি একটি লেখা দিতাম। প্রতি লেখার জন্য পেতাম পাঁচশ টাকা। মাসে চারটি লেখা দুই হাজার টাকা। লেখার সম্মানী পরিশোধে সম্পাদক শফিক রেহমান ছিলেন খুবই উদার। মাস শেষ হতে না হতেই চেক! যায়যায়দিন বন্ধ হওয়ার পর আমি রাত জেগে বইয়ের প্রুফ দেখে আয় বাড়ানোর চেষ্টাও করেছি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও পার্টি নেতাদের দুএকজন বলেছেন, আমি গাছেরটাও খাচ্ছি, তলারটাও কুড়াচ্ছি।
এখন তো অবস্থা আরো ভয়াবহ। লিখে নিয়মিত টাকা পান কয়জন তা আমি জানি না। আমি যে পাই না সেটা বলতে পারি। একটি পত্রিকা আমাকে মাসের সম্মানী মাসে পরিশোধ করে। সেটা কোনো বড় অংকের টাকা নয়। অন্য কেউই মাসের টাকা মাসে দেয় না। কখনো কখনো তিন মাস/ ছয় মাসও দেরি হয়। একটি পুরনো দৈনিকে নিয়মিত লিখতাম। কিন্তু মাসের পর মাস সম্মানী না দেওয়ায় এখন আর লেখা দেই না। আমারই যখন এই অবস্থা, অন্যদের অবস্থা এ থেকে আন্দাজ করতে পারি।
আমাদের দেশে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের এক ধরনের 'ধান্ধা'র জীবন বেছে নিতে বাধ্য করেন। ঢাকার সাংবাদিকদের থেকে মফস্বলের সাংবাদিকদের জীবন আরো দুর্বিষহ। বেশির ভাগ মফস্বল সাংবাদিক একটি নিয়োগপত্র এবং পরিচয়পত্র ছাড়া আর কিছু পান না। কোনও কোনও পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল কিছু মাসোহারা দিলেও তা অতি সামান্য এবং অনিয়মিত। তাহলে মফস্বল সাংবাদিকের জীবন চলে কীভাবে? নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো যায় কিন্তু নিজের খাওয়াটা তো থাকতে হবে!
এ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যারা সাংবাদিকদের কাছে সততা আশা করেন তারা আসলে কল্পজগতের বাসিন্দা। কিছু 'তারকা' সাংবাদিকের আয়-উপার্জন বা জীবন যাপন দেখে যারা মনে করেন সাংবাদিকদের আর সমস্যা কী – তারা বাস্তবটা জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না।
সাংবাদিকদের সত্য সন্ধানের তাগিদ অহরহ দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, কোন সত্য সন্ধান করবেন একজন সাংবাদিক। ব্যক্তি সাংবাদিকের কি আলাদা কোনও অস্তিত্ব আছে? আমি যদি অনুসন্ধানী একটি প্রতিবেদন তৈরি করি সেটা প্রচার বা প্রকাশের ক্ষমতা তো আমার নেই। সেটা তো মালিক বা সম্পাদকের হাতে। তার ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে আমার প্রতিবেদন সাংঘর্ষিক হলে সেটা তো কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না।
এক সময় ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী প্রকাশ করে পাঠকপ্রিয় হয়েছিল সাপ্তাহিক একতা। এখন কি কোনো গণমাধ্যম ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী ধরাবাহিকভাবে প্রকাশ করবে? আমাদের দেশে ধনিক গোষ্ঠী তো গড়েই উঠেছে লুটপাটের মাধ্যমে। লুটেরা পুঁজির মালিকরাই তো এখন দেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যমের নিয়ন্তা। গণমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনার হাত বদল না হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি অলীক কল্পনা হয়েই থাকবে। আর সাংবাদিকদের বেঁচে থাকার মতো বেতন-ভাতা নিশ্চিত না করে তাদের কাছে সৎ সাংবাদিকতা আশা করাও দুরাশা। কারণ এখন 'সেই সত্য রচিবে যা তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো'।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই– এই কথা বলা হচ্ছে এবং তা গণমাধ্যমে তা প্রচার ও প্রকাশ হচ্ছে। কী এমন কথা, কার মনে আছে যা তিনি বলতে পারছেন না? হ্যাঁ, কিছু মামলা-গ্রেপ্তারের মতো নিন্দনীয় ঘটনা ঘটছে, কারো কারো মধ্যে কিছু অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে। এটা সেই 'রাজা যতো বলে পারিষদ দলে, বলে তার শতগুণ'- এর মতো নয় তো? ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার ঘটনা অনেক সময়ই ঘটে। তবে নির্যাতন-নিবর্তনের একটি ঘটনাও সমর্থনযোগ্য নয়। তুচ্ছ কারণে জেলজুমুমের শিকার হতে হলে সেটা মানা যায় না। পেছন দিয়ে হাতি চলে যাবে, আর সামনে সুঁই দেখলে হৃদকম্প হওয়াটা ভালো লক্ষণ নয়। সরকারে থাকলে সমালোচনা সহ্য করার মানসিক শক্তিও থাকতে হবে। হঠাৎ হঠাৎ মাথা গরম করা ঠিক না।
পাঁচ
গণমাধ্যম ও সাংবদিকদের সমস্যা নিয়ে বলার মতো কথা অনেক আছে। তবে আলোচনাটা বেশি দীর্ঘ হলে অনেকের কাছেই বিরক্তিকর মনে হতে পারে।
সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে, দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের অধিকাংশ এখন নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। তাদের বেশির ভাগের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরি চলে গেলে তাদের শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না। সৎ সাংবাদিকতার পথে সরকার যতো না অন্তরায় সৃষ্টি করে, তারচেয়ে বেশি বাঁধা তৈরি করে মালিক পক্ষ। এটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করতে পারেন, কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। সাংবাদিকদের যতোক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকার মতো সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা না যাবে ততোক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম মানসম্পন্ন হবে না। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার দেখাও পাওয়া যাবে না।
শত ফুল ফুটতে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে দেশে অসংখ্য সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো এখন নানা ব্যাধিতে ধুকছে। খামখেয়ালিপনার কারণে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত মান অর্জনের সক্ষমতা রয়েছে অধরা। এখন দেশের অনেকগুলো গণমাধ্যম চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই সংকট কাটানোর উপায় নিয়ে কারো কোনো গভীর চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আর্থিক সংকট দূর না হলে কীভাবে এগুলো চলবে?
আর্থিক সংকট দূর করার উপায় আয় বাড়ানো। আয় বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে এতো এতো 'মিডিয়া' চলবে না। আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে যে সার্কুলেশন থাকা দরকার তা-ও অনেক পত্রিকার নেই। বেশিরভাগ পত্রিকাই আসলে 'আন্ডারগ্রাউন্ড'– কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। গ্রামবাংলায় একটি কথা চালু আছে– 'তোলা দুধে পোলা বাঁচে না'।
গণমাধ্যমের সংকট কাটাতে হলে আবেগী এবং তাত্ত্বিক কথাবার্তা না বলে বাস্তবতার আলোকেই সমাধান খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে রোগীর জন্য শল্য চিকিৎসা দরকার তাকে হোমিওপ্যাথি ডোজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি?
মতলবি বা অসৎ সাংবাদিকতা নতুন কিছু নয়। সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টাও নতুন কিছু নয়। ১৮৮৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে একটি রহস্যজনক মৃত্যুর খবর ধাপাচাপা দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে 'ঘুষ' দেওয়ার অভিযোগ আছে। তবে অতীতে এসব ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে থাকলেও এখন তা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। লুটেরা পুঁজির মালিক কিংবা পু্ঁজি গঠনের জন্য লুণ্ঠন প্রবৃত্তি যাদের মধ্যে প্রবল, তাদের হাতে গণমাধ্যমের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকলে 'সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস' দেখানো গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
গণমাধ্যমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে এখন অনেক কথা হয়। সবাই গণমাধ্যমের কাছে নিরপক্ষতা প্রত্যাশা করেন। এই 'নিরপক্ষতা' বিষয়টিও আমাদের দেশে একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। এখন অনেকের কাছে নিরপেক্ষতা মানে সরকারের বিরুদ্ধে থাকা। আবার এমন অনেক মানুষও আছেন যাদের কাছে আওয়ামী লীগ বিরোধিতাই হলো নিরপেক্ষতা। সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষে হলে 'দালাল' কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী অন্য কোনো দলের সমর্থক হলে তাকে সচরাচর দালাল বলা হয় না, তার অবস্থান নিরপেক্ষ। দেশের মানুষের মনোজগৎ মূলত স্ববিরোধী চিন্তা-চেতনায় ঠাসা। মানুষের মধ্যে ধারণাগত স্বচ্ছতা তৈরিতে বা বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে গণমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। অতীতে সেটা করেওছে। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতার সময়কাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক এবং সংবাদ প্রধানত এই দায়িত্ব পালন করেছে। দেশে বিশেষ রাজনৈতিক ধারা তৈরিতে এই পত্রিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার 'কারাগারের রোজনামচা'য় লিখেছেন: 'পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না। এদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকতো। একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে'। বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন : 'ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কিনা তাহা সন্দেহ'।
আমাদের দেশে গণমাধ্যম এখন আর জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে না। প্রতিটি গণমাধ্যমের মালিক-সম্পাদকদের হয়তো একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে তবে সেটা গণমাধ্যম পরিচালনায় বড়ো ভূমিকা পালন করে না। ব্যবসায়িক স্বার্থই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। জনমত গঠন নয়, জনমতকে বিভ্রান্ত করাই বেশিরভাগ গণমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এই বক্তব্য নিয়েও হয়তো কেউ কেউ বিতর্ক করবেন কিন্তু নির্দিষ্ট করে একটি গণমাধ্যমের নামও বলতে পারবেন না, যে গণমাধ্যম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য লাগাতার কাজ করছে। সংবাদ পরিবেশন এমনকি উপসম্পাদকীয় কলামে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও অনুদারতার চরম প্রকাশই দেখা যায়। কোনও না কোনও কোটারি স্বার্থের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা বা প্রবণতা কোনোটাই লক্ষ করা যায় না।
এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। গণমাধ্যমকে জনস্বার্থের অনুকূল করতে হলে বর্তমান মালিকানা কাঠামোয় সেটা সম্ভব হবে না। তাহলে পথ কী? উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রকৃত গণউদ্যোগে যদি পেশাদারি মনোভাব নিয়ে গণমাধ্যমের জন্ম দেওয়া যায় তাহলে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারা তৈরি হতে পারে। এখানেও প্রশ্ন আসবে, এমন উদ্যোগ কার্যকর করা কি আদৌ সম্ভব? আমার জবাব: কেন নয়? মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। পথের বাধা যেমন মানুষ তৈরি করে, তেমনি বাধা অপসারণের কাজও মানুষই করে। মন্দের সংখ্যা বেড়েছে, তাই বলে ভালো বিলীন হয়ে যায়নি। এক বা একাধিক মানুষের সৎ ও আন্তরিক উদ্যোগ গণমাধ্যমে নতুন প্রাণপ্রবাহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।