Published : 02 Apr 2021, 08:20 PM
২০১৫ সালের ১১ মার্চ। শরীয়তপুরের জাজিরায় এক স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ন্যায়বিচারের দাবিতে গড়ে তোলেন একটি মঞ্চ। হতভাগ্য ছাত্রীটির নামের মঞ্চের লোকজন সেই থেকে সোচ্চার। গত ১১ মার্চ, পৈশাচিক ঘটনার ছয় বছরপূর্তিতেও মানববন্ধন, সমাবেশ করেন তারা। অথচ তারা জানতেনই না, যে অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে পথে নেমেছেন, তারা দিব্যি আরামসে বাড়িতে শুয়ে–বসে দিন কাটাচ্ছেন! ভুক্তভোগী পরিবারটিও ছিল একই 'অন্ধকারে'।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল, অর্থাৎ দুই বছর আগে শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুস সালাম আলোচিত মামলাটির পাঁচ আসামি—মাসুদ ব্যাপারী, ওয়াসিম তালুকদার, জুয়েল ঢালী, রুবেল তালুকদার ও রাজন পাঠানকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। আদালত রায়ে বলেছেন, কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
যদিও বলা হচ্ছে, ছাত্রীটির বাবা ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই মারা যাওয়ার পর মামলার কার্যক্রম থেকে, নানাবিধ কারণে, পিছিয়ে যায় পরিবার; ফলে…।
কথা হলো, এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কি বিচারের পথ রুদ্ধ হতে পারে? এর মানে তবে কি এই: ভুক্তভোগী পরিবার (টাকাসমেত) দৌড়ঝাঁপ না করতে পারলে রাষ্ট্রও নিদায় থাকবে! অথচ মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আসামিদের চাপ সৃষ্টির সুস্পষ্ট অভিযোগ ছিল। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ভয়ে ছাত্রীটির দুই ভাই এলাকা ছাড়েন। পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয় ছোট বোনটির।
এসবের কিছুই যদি না–ও ঘটত, তবু কি অসহায় পরিবারটির ন্যায়বিচার পাওয়ার হক এতটুকু নড়চড় হয়? নাকি পরিবর্তিত বাস্তবতায় দুর্বৃত্তদের দম্ভ চূর্ণ করতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতই অবিকল্প হয়ে ওঠে?
বাদীপক্ষের এক আইনজীবীর ভাষ্যে রাষ্ট্রপক্ষের 'ব্যর্থতা'র নেপথ্য কারণের কিঞ্চিত ইঙ্গিত মেলে: অভিযোগপত্র দাখিল করা সিআইডি কর্মকর্তারও সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। ১৬৪ ধারায় নেওয়া হয়নি আসামিদের জবানবন্দিও।
শরীয়তপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হযরত আলীর দাবি, ছাত্রীটির বাবা মৃত্যুর আগে আসামিদের সঙ্গে 'মীমাংসা' করেছিলেন। সাক্ষীরাও আদালতে আসামিদের শনাক্ত করেননি।
একটি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার কি 'মীমাংসা' হতে পারে? যদি ছাত্রীটির বাবা তা করে থাকেনও, আইনে কি তা সমর্থনযোগ্য? সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, তারা হাত ধুয়ে ফেলেছেন!
কিন্তু 'মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়া' ছাত্রীটির মায়ের আত্মা এখনো আটকে আছে বুকের খাঁচায়। তাই এমন প্রতিকূলতায়ও ন্যায়বিচারের ক্ষীণ আশা এই মা বুকে জিঁইয়ে রেখেছেন। কিন্তু অসহায়ত্ব তাকে এ আর্জি জানাতে বাধ্য করেছে, রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা পেলে তিনি আপিল করতে চান।
যশোরে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলারও সব আসামি খালাস পেলেন, গত ১১ জানুয়ারি। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ বিকেলে বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল শিশুটি। পরে মাটিচাপা লাশ পাওয়া যায় তার।
যশোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–১–এর বিচারক টি এম মুসা অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় আসামি মেহেদী হাসান ও সাইফুল ইসলামকে খালাস দিয়েছেন। যদিও সাইফুল শিশুটিকে হত্যা ও ধর্ষণে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলেন। প্রধান সন্দেহভাজন শামীম বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রেও সন্তানহারা মা–বাবার বুক ভাঙি ভাঙি করছে! শোক ভুলে, দুঃখ ঠেলে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে তারা তখনই তো পারবেন, যখন দোষীদের সাজা কার্যকর দেখতে পারবেন।
গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২২৯ নারী–শিশু। অর্থাৎ দিনে গড়ে প্রায় চারটি। এটা মোট নির্যাতনের ৪০ শতাংশ। এর বাইরে রহস্যজনক মৃত্যু, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ যৌতুকের জন্য হত্যা–নির্যাতন, আত্মহত্যা, বাল্যবিয়ে ও অ্যাসিড সহিংসতার ঘটনা ৬০ শতাংশ।
গত বছরের অগাস্ট পর্যন্ত এক হিসাবে ধর্ষণের ঘটনায় ১৬ বছরে সরকারের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার মামলা করেছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে মাত্র ৬০টি ঘটনায় দোষীরা শাস্তি পেয়েছে। শতকরায় ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণ, ২৫ সেপ্টেম্বর এমসি কলেজে তরুণীকে ছাত্রলীগ কর্মীদের দলবদ্ধ ধর্ষণ, অক্টোবরের শুরুতে বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ—ইত্যাদি ঘটনায় গোটা দেশ ফুঁসে ওঠে। এর জেরে ধর্ষণের সাজা সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করা হয় ১৩ অক্টোবর। এরপর যথাক্রমে তিন ও পাঁচ মাস পর যশোর ও শরীয়তপুরের ধর্ষণ–হত্যা মামলা দুইটির রায় এলো।
'কোন ছায়াশক্তি তাকে (স্কুলছাত্রী) হত্যা করেছে? কার কাছে জবাব চাইব?'—শরীয়তপুরে ছাত্রী ধর্ষণ–হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা মঞ্চের সমন্বয়ক পলাশ খানের এই উপলব্ধি কি সর্বজনীন হয়ে ওঠে? হয়তো ওঠে, হয়তো ওঠে না; তাতে অবশ্য নিয়ম করে সূর্য উদয়–অস্তে কোনো হেরফের হয় না!