Published : 19 Mar 2021, 08:10 AM
ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের প্রথম গ্লোবাল হিরো কে? প্রশ্নটাই অবান্তর।
মায়ের কোলে মুখ গুজে দৈত্য-দানব, রাক্ষস-খোক্কস কিংবা সুয়ো-দুয়ো রানির গল্পে আচ্ছন্ন থাকার বয়সী একটি শিশু তার প্রতিভার দিপ্তীতে আচ্ছন্ন করে রেখেছে পুরো দেশকে। শিশুটি বড় হচ্ছে, বাড়ছে স্বপ্নের পরিধিও। বারো বছর পেরুনোর আগেই জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে ভীষণ অবাক শিশুটির মা। সামনে দাঁড়িয়ে দার্শনিক শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন। দাবা অন্তপ্রাণ এ মহান মানুষটি বললেন," আমি আপনার ছেলের সঙ্গে দাবা খেলতে এসেছি।" গর্বে ভরে ওঠে মায়ের বুকটা।
বৈশ্বিক ক্যানভাসে শিশুটি একদিন বাংলাদেশের ছবি আঁকবে, এক চালে মাত করে মিলিয়ে দেবে অনেক হিসেব-নিকেশ, এই গভীর বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে এদেশের মানুষ। ছেলেটি নিয়াজ মোরশেদ। দেশের প্রথম 'গ্লোবাল হিরো'।
১৯৭৮ সালে টাইব্রেকে হেরে জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। পরের চার বছর টানা চ্যাম্পিয়ন। এরই মধ্যে আলো ছড়ানো শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও। ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার নর্ম অর্জন করেন। আমাদের আকাঙ্ক্ষার পালে হাওয়া লাগে। আমরা গ্র্যান্ডমাস্টার পাব-এ আশায় বুক বাঁধি। নিয়াজ একটা করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেন, দেশের দাবাপ্রেমীদের শিহরণ ও টেনশন বাড়তে থাকে সমান্তরালে। ১৯৮৩ সালে তৎকালিন যুগোশ্লোভিয়ায় অনুষ্ঠিত 'বেলা ক্রোভা ওপেন' ও পরের বছর হংকংয়ে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে নজরকাড়া সাফল্য পান। ১৯৮৪ সালে অর্জন করেন গ্র্যান্ডমাস্টারের প্রথম নর্ম। এরপর আরও দু বছরের অপেক্ষা। ১৯৮৬ সালে কলকাতা গ্র্যান্ডমাস্টার দাবায় অর্জন করেন দ্বিতীয় নর্মটি। বিশ্ব দাবা সংস্থা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিল পরের বছর। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়লেন নিয়াজ।
নিয়াজের অর্জনের বিশালতা অনুধাবন করতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৮০-র দশকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার দাবাড়ু হিসেবে দাবার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন নিয়াজ। তাকে নিয়ে পুরো এশিয়াতেই তখন গ্রান্ডমাস্টারের সংখ্যা মোটে পাঁচ জন। উপমহাদেশে এখন যে গ্র্যান্ডমাস্টারের ছড়াছড়ি, সেই পথটা দেখিয়েছিলেন নিয়াজ। প্রতিবেশী ভারত হয়ে উঠেছে গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরির কারখানা। বাংলাদেশে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যাটা আটকে আছে পাঁচে। বৈশ্বিক দৌড়ে দিনকে দিনই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। অথচ নিয়াজ এখনও খেলে চলেছেন। সর্বশেষ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও পরেছেন সেরার মুকুট।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে আন্তর্জাতিক দাবায় সম্ভাবনার দৌড় থেকে বাংলাদেশ যে একরকম ছিটকেই গেছে, তা বলাই যায়। ভারতে গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা একশ-র কাছাকাছি। ভারতে শুধু নারী গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যাই ২০। দেশটির হয়ে পাঁচ-পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বিশ্বনাথন আনন্দ। বিপরীতে বাংলাদেশে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেখা মেলেনি নতুন কোন গ্র্যান্ড মাস্টারের।
দাবাকে ঘিরে দেশের মানুষকে খুব বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নিয়াজ। এখনও খেলছেন। শিরোপা জয়ের ক্ষুধা আছে আগের মতোই অটুট। তারপরও দাবাকে ঘিরে সেই বড় স্বপ্নটা ছোট হয়ে আসছে দিনকে দিন। পুরো বিষয়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সবচেয়ে বড় কথা দাবায় বাংলাদেশের ক্রমপতনকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে, নিয়াজের ক্যারিয়ারের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমান যুক্তরাস্ট্রে। সেখানে ফিলাডেলফিয়ার খ্যাতনামা পেনসালভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন অর্থনীতি নিয়ে। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলেও দাবায় সেভাবে ফেরেননি। জড়িয়ে পড়েন বিবিধ কাজে। বের করেন গানের ক্যাসেট। শুরু করেন হাউজিং ব্যবসা। মোট কথা দাবার প্রতি একনিষ্ঠতা হারান। কেন দাবার প্রতি শতভাগ মনযোগ দিতে পারেননি, তা নিয়ে বলা যায় অনেক কথা-ই। যত বড় অর্জনই হোক না কেন, শুধু দাবা খেলে বাংলাদেশে ক্যারিয়ার হবে না, এটাও এক চরম বাস্তবতা। জীবন বাঁচাতে কিংবা জীবন সাজাতে শুধু দাবা নিয়ে পড়ে থাকা আর যাই হোক বাংলাদেশে সম্ভব নয় এবং এ সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। কিন্তু ব্যক্তি নিয়াজের কোনই দায় নেই?
সব বাস্তবতা মেনে নেওয়ার পরও দাবা থেকে মনোযোগ হারানোর দায় অনুভব করেন স্বয়ং নিয়াজও। শুধু দাবায় নিবিষ্ট থাকতে না পারার জন্য নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন উপমহাদেশের এই প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার, "শুধু দাবা নিয়েই আমার থাকা উচিৎ ছিল। ভেবেছিলাম দুটোই (দাবা ও বিদেশে পড়াশোনা) একসঙ্গে ম্যানেজ করতে পারব। আসলে একই সময়ে একসঙ্গে দুটো বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়াটা খুবই কঠিন। আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।"
ভারতের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দ বিদেশে পড়াশোনার পথে না হেঁটে দাবা নিয়েই ছিলেন, কথায় কথায় এটাও জানান নিয়াজ। নিজে কেন দাবায় একনিষ্ঠ থাকতে পারেননি , তার ব্যাখ্যায় বলেন, "বেশ নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। অনেকেই বলল, এটা খুব বড় একটা সুযোগ। এমন একটা পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। এখন বুঝি, ওটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত।"
১৯৮০-র দশকে নিয়াজ- দিব্যেন্দু বড়ুয়া দ্বৈরথ ছড়াত ভিন্ন এক উত্তাপ। নিয়াজের চার বছর পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন দিব্যেন্দু। তাপ ছড়ানো এই দ্বৈরথ নিয়ে নিয়াজের ভাষ্য, "আমাদের দুজনের মধ্যে রাইভালরি ছিল। খুব ভাল প্রতিদ্বন্দিতা হত আমাদের মধ্যে। যতদুর মনে পড়ে, আমরা দুজনে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছি ত্রিশবারের মত। কে কতবার জিতেছি, এটা মনে নাই। তবে আমাদের মধ্যে কেউ একজন হেরে গেলে পরের ম্যাচে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতাম।"
যেটা ছিল নিয়াজ-দিব্যেন্দু লড়াই, সেটা কি নিয়াজ-আনন্দ হতে পারত না? এ প্রশ্নের জবাবে তার, "এ ধারণার সঙ্গে আমি মোটেও একমত নই। এটা হতে পারত না। আনন্দ অন্য ব্যাপার। বিশ্ব দাবায় সর্বকালের সেরা ২০ জন দাবাড়ুর নাম করলে আনন্দের নাম নিতে হবে। আর তাছাড়া একজন আনন্দ হয়ে ওঠার জন্য অনেক কিছুর কম্বিনেশন লাগে।"
বিষয়টার বিস্তৃত ব্যাখ্যায় বললেন, "প্রতিভা ,পারসোনাল ডেডিকেশন ছাড়াও আরও অনেক কিছু লাগে। সবদিক থেকে সমর্থন, সর্বোপরি ভাল গাইডেন্স প্রয়োজন হয়।" আনন্দের বেলায় গাইডেন্স খুবই গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখেছিল, সেটা উল্লেখ করে বলেন, "জুনিয়র দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও আনন্দ নিজের দেশ থেকে সেই অর্থে সাহায্যই পায়নি। একবার যুক্তরাস্ট্রে ওর সঙ্গে দেখা হল। আনন্দের খুবই মন খারাপ। একটা কম্পিটিশনে এসেছে, অথচ বিমান ভাড়ার টাকাটা পর্যন্ত তাকে দেওয়া হয়নি। নিজের খরচে এসেছে। ওদের পরিবার অবশ্য বেশ স্বচ্ছল। তার এক কাকা, ওকে তিন হাজার ডলার দিয়েছিল। মজার ব্যাপার হল, ওই কাকাকে আনন্দ এর আগে কখনোই দেখেনি!"
বয়সে আনন্দের থেকে নিয়াজ সাড়ে তিন বছরের বড়। আনন্দ-র সঙ্গে সাকুল্যে দুটো ম্যাচ খেলেছেন। একটিতে হার আর অন্যটি ড্র।
নানান ঘাত – প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা থেকে নিয়াজ শিখেছেন অনেক কিছু। দাবাতেও ফিরেছেন। পারফরম্যান্সও সন্তোষজনক। এখন যদি দাবাকে সিরিয়াসলি নেন, তাহলে কি আরও বড় কিছু করা সম্ভব? এ প্রশ্নকে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বললেন, "এখন আমার বয়স ৫৫। যতই সিরিয়াস হই না কেন, এ বয়সে আর নতুন করে বড় অর্জন সম্ভব নয়। এখন আনন্দও আর পারছে না। যা অর্জন তা ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যেই করে ফেলতে হয়। মনে রাখতে হবে ব্রেইনও কিন্তু শরীরেরই অংশ।"
গ্লোবাল রেসে নতুন করে নিজেকে আরও বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন না এটা খোলাখুলি জানিয়ে দিলেন। আবার আগামী দিনে কোন এক নতুন নিয়াজ দাবায় বাংলাদেশের নামটাকে বড় করে তুলবেন, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে সে বাস্তবতাও দেখছেন না বলেই মনে করেন এ গ্র্যান্ডমাস্টার। বললেন, "সর্বশেষ জাতীয় দাবায় ছেলেদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন আমি। আর মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন রানী আপা। আমাদের দেশের দাবার বর্তমান চিত্র বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। এটা আমাদের জন্য ভাল হলেও বাংলাদেশ দাবার জন্য খুবই দুঃখের একটা সংবাদ। যদি প্রথম ১৬ জনের মধ্যে থাকতে না পারতাম, তখন বুঝতাম আমাদের দেশের দাবার উন্নতি হয়েছে।"
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটা সময় অর্জনের দিক থেকে দাবা ছিল সবার ওপরে। এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন বলেই মনে করেন নিয়াজ, "বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে নতুন শতাব্দীতে দাবার কোন বড় অর্জন নাই। আমি উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। তাতে কী হয়েছে? সেটা আজ অতীত। এই সময়ে গলফের সিদ্দিকুর রহমান, আরচারিতে রোমান সানাদের অর্জন অনেক বড়।"
সম্ভাবনাতেও দাবা পিছিয়ে বলেও জানালেন আক্ষেপ, "দেশে সম্ভবানাময় খেলার তালিকায় দাবা এখন অনেকটায় পিছিয়ে। প্রতিটা জিনিসেরই একটা সেরা সময় আসে। সেই সময়টাকে কাজে লাগানোটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দাবার যে ভাল সময়টা এসেছিল তা কাজে লাগানো যায়নি।"
সেরা সময় নষ্ট করার ফল ভোগ করছে দেশের দাবা, স্মরণ করিয়ে দিলেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম গ্লোবাল হিরো।