Published : 18 Mar 2021, 05:53 PM
যারা নিজস্ব লোকজ আঁধার ও প্রকৃতি থেকে নির্বাচিত জ্ঞান ও নির্যাসিত বোধ অর্জন করে তা কর্ষণ ও বিকশিত করার মধ্য দিয়ে প্রগতির চেতনা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবোধের চেতনাই প্রকৃত জাতীয়তাবাদ। যার বহির্প্রকাশ অভিব্যক্তির সবটুকুর মধ্যে স্বদেশ অঙ্গের ভাব ধারায় প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বকীয়তা বিদ্যমান। এ চর্চার প্রগতিশীলতা কল্যাণমুখী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে।
প্রাকৃত চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বদেশ ভাবনার চিন্তা চেতনায় ক্ষতিকর কোনও উপাদান যুক্ত হতে পারেনা। যে কোনও আন্দোলন-সংগ্রামে কৌশল হিসেবে মধ্যলয়ে চলতে এ গতি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বোধের সবটুকুই মা-মাটি-মানুষ ভাবনার হওয়ায় নিজের আবেগের সবটুকুর যৌক্তিক ব্যবহার করা সম্ভব হয় বলেই মূল চরিত্র থেকে খুব একটা নড়চড় হওয়ার সুযোগ থাকেনা বললেই চলে। পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতা অর্জন, বিচার-বিশ্লেষণ এবং পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে এ ধারা খুব বেশি সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখে। ফলে অযাচিত অস্থিরতার কারণে যে সকল ভুলের জন্ম হতে পারে, প্রগতিশীল এ চরিত্রে তার উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। স্থায়ী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার কারণে মূল লক্ষ্য সুদূরে থাকলেও পর্যায়ক্রমিক অগ্রসরমানতার শেষ দিকে সব দ্বিধা দ্বন্দ্বের দ্রুত অবসান ঘটিয়ে আন্দোলনের পক্ষে সবাইকে সমবেত করতে, বিশেষ করে দলীয় বৃত্তের বাইরে অবস্থিত সাধারণ মানুষকে সহজে আকর্ষিত করবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে দেশজ প্রগতিশীলতার। আরেকটি বিশেষ চরিত্র প্রস্ফুটিত রয়েছে তা হলো শিক্ষিত শ্রেণির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সহজে অভিযোজন করানো যায়। যার নিজ অঙ্গে শ্রেণিবিভাজন দৃষ্টিভঙ্গি জনিত শ্রেণিশত্রুর ভাবনা নাই। সেদিক থেকে এটিই আসলে ক্লাসিক প্রগতিশীলতা।
আর যারা স্বদেশের মাটিতে বসে বিলেতের ধার করা জ্ঞান গরীমা ও তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গড়ে ওঠা পাণ্ডিত্যের অহংবোধ দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করে শহুরে ভাবধারার আভিজাত্যের চাদরে মুড়িয়ে শোষিত বঞ্চিতদের মুক্তির ত্রাতা হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত, তাদের মধ্যে এক ধরনের বিদেশি প্রগতিশীলতার জন্ম হয়।
এ ধরনের চরিত্রে মা-মাটি-মানুষের প্রকৃত অবস্থার গভীর অনুভূতির ভাসমান রূপটিই কেবল অভিযোজিত করতে পারে। জ্ঞানের পিঠে চড়ে চতুরপায়ী দৌড়ে ঘোড়া চালানোর মনস্তত্ত্ব লাভ করে। নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি উপজীব্য করে সেমিনার সিম্পোজিয়াম বক্তব্য কিংবা ভাষণে এরা বাকপটুতার স্বাক্ষর রাখতে পারে যতোটুকু-তা, দিব্যচক্ষে সবাইকে মাত করে দেওয়ার মত। কিন্তু নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের আবেগ অনুভূতির সাথে একই প্রেক্ষাপট ও পরিবেশে দীর্ঘ সহাবস্থান না থাকার কারণে কেবল পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দিয়ে ওই সকল মানুষকে বিচার বিশ্লেষণ করায় নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের সাথে আত্মিক বন্ধন হয়ে থাকে খুব দুর্বল প্রকৃতির। জাতীয়তাবাদী চরিত্র গঠনে এটি একটি অন্যতম পূর্বশর্ত, যাদেরকে ঘিরে জাতীয়তাবাদ, তাদের মধ্যে থেকেই গড়ে উঠতে হয় চেতনার মূল ভিত্তি। যে সকল প্রগতিশীল নেতারা চেতনার এই মূল ভিত্তি থেকে উঠে আসেনি, তাদের পক্ষে স্বাধীনতাকামী প্রকৃত প্রগতিশীল নেতা হওয়া খুব কঠিন কাজ। স্বদেশের আদি হতে গড়ে না উঠে কেবল বিদেশি প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতাদেরকে অনুসরণ করে এবং পাঠ্যপুস্তক এর তত্ত্ব দ্বারা প্রেষিত হয়ে যারা প্রগতিশীল রাজনীতি করেন, তাদের হাত ধরে জাতীয়তাবাদের সফলতা আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতি দুর্বল চরিত্র দেখা যায়। আর ঘুনে ধরলে কিংবা পঁচে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়েও খুব ক্ষতিকর হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের ঈর্ষাকাতর চরিত্রের কুপ্রভাব দ্বারা পরিচালিত হয়। ঈর্ষান্বিত হয়ে নিকৃষ্টতম কাজটি করতেও ন্যূনতম বাধা কিংবা দ্বিধা কাজ করে না। জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক স্থায়ী চরিত্র লাভ করতে পারে না বিধায় দল ভেঙে নিজস্ব গ্রুপ করা, সশস্ত্র মুখিতা কিংবা এতদিনের বিশ্বাসকে পদদলিত করে দলবদল করে সহজে অন্য দলে চলে যেতে কার্পণ্য বোধ করে না। ঘুরেফিরে যেখানেই যাক না কেন, সে দলের জন্য এরা কোন স্বস্তির জায়গা তৈরি করতে পারে নি কখনও। বাগ্মিতা ও বিদেশি পাঠ্য-পুস্তকের জ্ঞানকে সহজে কাজে লাগিয়ে নতুন দলেও নিজেকে দ্রুত পদোন্নতি করাতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে নিজস্ব ঈর্ষাকাতর চরিত্রের কারণে যোগদানকৃত দলটিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। দলীয় প্রধানের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে নিজেকে অধিক যোগ্য মনে করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে নেতিবাচক মনোভাব দ্বারা তাড়িত হয়ে নানারকম কুটকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
জাতীয়তাবোধে গড়ে ওঠা প্রগতিশীলতার সাথে বিদেশি ভাবনার প্রগতিশীলতার স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ঈর্ষাকাতরতা, অসহিষ্ণুতা ও পাণ্ডিত্যের ক্ষতিকর প্রভাব তুলনামূলক বিশ্লেষণে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রতিক্রিয়াশীলতা কখনও দল বদল করে অন্য দলে যোগ দিলেও শেষ দিন পর্যন্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যেখান থেকে এসেছে তাদের নির্দিষ্ট কোনও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতায়। কখনওই পরবর্তী দলের মূল সদস্যদের আদলে নিজেকে তৈরি করা সম্ভব হয় না কারণ সেই আদর্শিক জায়গাটা তার অপছন্দের এবং নিজ দলীয় আদর্শের সাথে সর্বক্ষণিক দ্বান্দ্বিকতা তৈরি করে ক্রমশই নিজেকে গড়ে তোলে নিষ্ঠুর হিসেবে। সময় এবং সুযোগ পেলে সে ঠিকই ছোবল মেরে নিজের মনকে স্বান্তনা দেয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের ব্যক্তি দর্শনে সফল মহানায়ক রাজনীতির কবি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতির পিতার হাত ধরেই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত ফোকলোর শামসুজ্জামান খান এর নির্বাচিত প্রবন্ধে শেখ মুজিব কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা এবং বাঙালির জাতির জনক,সেই বিশ্লেষণে বলেন- "শেখ সাহেবের অতুলনীয় কৃতিত্ব এখানে যে, বাংলাদেশের চারটি ধর্মে বিভক্ত অসম ও অসমন্বিত উপাদানে গঠিত বাঙালি জাতির এবং প্রায় ঊনপঞ্চাশটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কে একই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অটুট ঔক্যে গ্রথিত করে একটি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। এ রকম সাফল্য নজিরবিহীন।"
তিনি আরও বলেন, " বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে কয়েকশো বছরে যে বাঙালি জাতি গড়ে ওঠে, তা ছিল একটি নৃগোষ্ঠী মাত্র। একই ভাষা ও সাধারণ আর্থ-সামাজিক জীবনধারার বিকাশের ফলে এবং শারীরিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক গড়নের সাযুজ্যে এই নৃগোষ্ঠীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও বহু ক্ষেত্রের নানা মণীষীর স্ব-স্ব ক্ষেত্রে চিন্তার নব নব বিন্যাসে একটি উন্নত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। প্রায় তিন দশকের স্বাধিকার ও সুপরিকল্পিত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই জাতিরই মূল স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান।"
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিভাজনে বিভাজিত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কোনও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব বিবেচনা করে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেল জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তখনকার বাস্তবতায় হোসেন শহীদ সরোয়ারদি, পরবর্তীতে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাদের সাথে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় থেকেও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী চেতনায় নিজেকে শাণিত করে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পৃথক জাতিরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন, তখন সে স্বপ্নযাত্রায় নিজস্ব দর্শন প্রতিফলনে নিজ হাতে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের জন্ম দেন। ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক করে গড়ে তুলতে ছাত্রলীগকে নিজস্ব চেতনাজাত প্রগতির ধারায় নানা কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করান। প্রস্তুত হতে থাকে ছাত্রলীগ। মহান নেতার নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ৭০-এর নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক কথায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। বলে রাখা জরুরি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে তারই নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও ফজলুল হক মনিকে নিয়ে ১৯৬১ সালে 'নিউক্লিয়াস' গঠিত হয়।
১৯৬২ থেকে পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ নিউক্লিয়াসকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি জাতির জন্য শুরুতেই কিছু স্লোগান তৈরি করার দায়িত্ব দেন, যা সকল বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে গড়ে ওঠা আবেগ থেকে নিঃসরিত। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা শুরুতেই স্লোগান দুইটি বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দ হয়। এভাবে আরও বেশ কতগুলো স্লোগান নির্মিত হয়, যার প্রায় সবগুলোই এদেশের মা-মাটি-মানুষের গভীর আবেগ থেকে উৎসারিত এবং জাতীয়তাবোধের চেতনা দ্বারা নির্মিত। অপরদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কবিতা বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবোধে অসামান্য অবদান রেখেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'- রবীন্দ্রনাথের এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত করবেন ভাবনাটির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, যখন পঞ্চাশের দশকে সনজিদা খাতুন এবং ষাটের দশকে অজিত রায়কে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন এ গান বারবার পরিবেশন করিয়েছিলেন।
আরও একটি গান ডি এল রায়ের রচনা 'ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা' বঙ্গবন্ধু খুব পছন্দ করতেন। সময় পেলে এ দুটি গান গুনগুন করে গাইতেন তিনি। আর সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত ভাবনা জুড়ে অনন্য মাত্রার দেশাত্মবোধ, দেশজ সংস্কৃতির নির্যাস এবং সাধারণ মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূরীকরণ তথা অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তা বাস্তবায়নে জাতীয়তাবাদী একটি স্বপ্ন রাষ্ট্র উপহার দিতে যে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করেছেন, তার সবকিছুতেই এমনকি রণ কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ধার করা চিন্তাকে তিনি পরিহার করে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধকে পরিহার করে পাক সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শুরুতেই যুদ্ধকৌশলে বিচ্ছিন্নবাদিতার পরিচয় না দিয়ে তিনি বেছে নিলেন গেরিলা যুদ্ধ। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে কৌশলের অংশ হিসেবে স্পষ্ট করেই বললেন- "তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।" রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে বললেন তিনি, এমনকি যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ মাতাকে রক্ষা করবার জন্য নির্দেশনা দেন।
গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের শক্তিশালী দর্শন উপস্থাপন করে জাতিরাষ্ট্রের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করলেন। একাডেমিক আলোচনায় যে যেভাবেই বলুক না কেন, এ চারটি মূলনীতির পুঁথিগত ভাষা যা কিছুই প্রকাশ করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুর অন্তরে এ চারটি মূলনীতির সবটুকু বোধে দেশজ ভাবনার স্বকীয়তা বিদ্যমান। তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বোধটুকু একেবারেই নিজস্ব ঘরানার নিজস্ব চেতনা দ্বারা নির্মিত একান্তই তার নিজের ভাবনাজাত স্বকীয় সমাজতন্ত্র। সমবায় ভিত্তিক চিন্তা চেতনা সমর্থিত ছিল এটি। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় তার নিজস্ব বক্তব্যে উঠে এসেছে- "সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধন সম্পদ বাড়াতে দেবো না। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এ দেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।" (বঙ্গবন্ধু; সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, ৭ জুন, ১৯৭২)
সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার বাম সংগঠনের কমরেডদের চিন্তা চেতনা ও আভিজাত্যের সবটুকুতে বিদেশি ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। নিজস্ব ভাবধারার বিপ্লবীচেতনার সাথে তাদের চিন্তা চেতনা ও কর্মকৌশলে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায়। যে কোনও প্রেক্ষাপটে স্হানীয় আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের চেয়ে শেখানো বুলি শ্রেণিশত্রু প্রভাবক সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব বেশি ঝোঁক কাজ করে থাকে। অপারেশনাল কাজের ক্ষেত্রেও সামরিক মানষিকতার ছাপ পড়ে, ফলে 'ওয়ান বুলেট কিলস ওয়ান' নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। শ্রেণিশত্রু বিনাশ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যে নতুন করে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে এবং পর্যায়ক্রমে সামাজিক অস্থিরতা আরো বাড়তে থাকে সে বিষয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । সামাজিক প্রেষণা খুব একটা কার্যকরী কৌশল হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বিবেচিত হতে দেখা যায় নি। বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে যাদের ভাগ্য পরিবর্তনের রাজনীতি করেন, এ সকল নেতারা কখনও ওই জাতীয় মানুষের সাথে এক পাটিতে ঘুমানোর কোন রেকর্ড তৈরি করেননি তাদের পুরো জীবদ্দশায়। অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে তাদের মধ্যে। যতটুকু জানা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তাদের অনেকের ভাষায় বুর্জোয়া শ্রেণির লেখক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। কেননা, রবীন্দ্রসাহিত্যে সমাজতন্ত্র বিষয়ক কোন ভাবনা নেই বলে সেটি তাদের অনেকের কাছেই পরিহার্য।
প্রসঙ্গক্রমে, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সমর্থন করেননি। তার মতে, 'ধনকে বলপূর্বক হরণ করেও নয়, ধনকে বদান্যতাযোগে দান করেও নয়। এর উপায় ধনকে উৎপন্ন করার শক্তি যথাসম্ভব সবার জাগরুক করা, অর্থাৎ সমবায়নীতি সাধারণের মধ্যে প্রচার করা।' তিনি উল্লেখ করেন, 'এ কথা আমি বিশ্বাস করিনে, বলের দ্বারা বা কৌশলের দ্বারা ধনের অসাম্য কোনোদিন সম্পূর্ণ দূর হতে পারে।' (সমবায়নীতি ও রবীন্দ্রজীবনী, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৬৮)। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ভাবধারার বিশ্বাসী পাকিস্তানি ঘরানায় যারা বিশ্বাস করতেন তাদের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও স্বকীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে পরিহার করে তিনি পুরোদস্তুর ভারতীয় সংস্কৃতির ভাবধারার মানুষ। কাজেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবং তার সংগীত ও সাহিত্যকে বর্জন করা অপরিহার্য।
এমনকি, রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসব পালনকে কেন্দ্র করে প্রগতিশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি দিতে দেখা গিয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্ত প্ল্যাটফর্ম রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে যখন খুব সক্রিয় এবং শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে, সে সময়ে গিয়ে বামদের মধ্যে যারা প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করেছে, প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ওইসব বামপন্থিরা অসাম্প্রদায়িক কাতারে ফিরে আসার বিকল্প না দেখে তাদের প্রথম দিকের দেয়া বিবৃতি সঠিক ছিল না মর্মে দুঃখ প্রকাশ করেন।
অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিক কিংবা ব্রিটিশদের পক্ষ সমর্থন করে বুর্জোয়া শ্রেণির লেখক ছিলেন না মর্মে আত্মোপলব্ধি করেন। যদিও বামপন্থীদের বড় একটা অংশ মার্কসীয় মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। তবুও বিষয়টি খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট যে, তৎকালীন পাকিস্তান ও তাদের অনুসারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের একটা বড় অংশ যারা সাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিশ্বাস করতেন দুই মিলে রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে খুব শক্ত অবস্থান গ্রহণ করলে তখন স্পষ্টতই একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেখা যায়।
বাম রাজনীতির ধারক বাহক হয়ে সরাসরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মতাদর্শের মানুষের মতের সাথে একমত পোষণ করা তাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ায় এসকল কিছু বামপন্থি রাজনীতিবিদ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টির কাতারে ফিরে আসতে বাধ্য হন। পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র বিতর্ক ১৯৪৮ সালে শুরু হয়। বিশিষ্ট ফোকলোর গবেষক শামসুজ্জামান খান রচিত নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলনে বাংলাদেশের রবীন্দ্র বিতর্ক ও তার কিছু টীকা ভাষ্য আলোচনায় বলেন- "সম্ভবত ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট বন্দীরা নিজেদের মধ্যে এর সূত্রপাত করেছিলেন… জেলের বাইরেও বিতর্কের ছোঁয়াচ লেগেছিল। বিশেষ করে ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের কয়েকজন সদস্য এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), আখলাকুর রহমান (পরে ডক্টর), আবদুল্লাহ আল-মুতী( পরে ডক্টর) ও অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। এরা সকলেই সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কিছুটা সম্পর্কিত ছিলেন। অজিত গুহ বাদে অন্য তিনজন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আয়োজিত এক সাহিত্যসভায় রবীন্দ্রনাথকে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া লেখক হিসেবে আখ্যাত করেন।"
তাছাড়াও জানা যায়, কলকাতা ভিত্তিক মার্কসবাদী পত্রিকাতে যে সকল তাত্ত্বিকরা লেখালেখি করতেন, তারা বেশিরভাগই রবীন্দ্র সাহিত্য কে বর্জনের পক্ষপাতি ছিলেন। তাত্ত্বিক রবীন্দ্র গুপ্তের ভাষায় "উপনিষদের মায়াবাদ হলো রবীন্দ্র দর্শনের সারমর্ম।" উপমহাদেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাদের বুদ্ধিদীপ্ততার পরশে এবং সরাসরি অনেকর অংশগ্রহণের মধ্যে যে কৃতিত্বের দাবিদার তারা, সে ক্ষেত্রে কর্ম অনুযায়ী কৃতিত্ব প্রদান প্রাসঙ্গিক। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদের চেতনা নির্মাণে তাদের কর্মকৌশল খুব দুর্বল। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী চেতনা নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বের দৃশ্যমান প্রতিফলন বাংলার সাধারন মানুষের আবেগকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি। দেশজ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বাম রাজনীতির দর্শনের সাথে উৎকৃষ্ট রসায়ন তৈরি করতে না পারায় বাংলাদেশ উত্তর ৫০ বছরে এসেও এ দেশের মানুষের কাছে তারা বাম রাজনীতিকে গ্রহণযোগ্য করাতে পারেননি।
জাতীয়তাবোধ তৈরি করতে মহান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটানা তিন দশকের শ্রম ঘাম, সংগ্রাম, জেল জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সমস্ত প্রতিবন্ধকতার ঊর্ধ্বে উঠে বাংলার মানুষকে ভালোবেসে এবং বাংলার মানুষের ভালোবাসা নিজে হৃদয়ে ধারণ করে লালন করার মধ্য দিয়ে নিজস্ব চিন্তা চেতনা ও রাজনীতির দর্শনকে পর্যায়ক্রমে বাঙালির অন্তরে গ্রথিত করে যে স্বকীয় চেতনাবোধের জন্ম দেন, সেটাই মূলত বাঙালির মূল জাতীয়তাবাদ। সে মন্ত্রে বাঙালি জাতিকে দীক্ষিত করে বাঙালি জাতির দিকপাল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজ হাতে বাংলাদেশের জন্মদেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।