Published : 25 Feb 2021, 03:37 PM
২০১০ দশকের শুরুর দিকে, তখনও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইংরেজি বিভাগে আমার সহপাঠী শেখ মোহাম্মদ মোহসীন আমাকে একদিন জানাল, ইত্তেফাকে কড়চা বিভাগে শাহীন রেজা নূরের লেখা ছাপা হয় মাঝে মাঝে। এই লেখা তার খুব পছন্দের। আমাকে বলল, তুই তো মাঝে মাঝে ইত্তেফাকে লিখিস, তুই কি জানিস কে এই শাহীন রেজা নূর। আমি বললাম, ইত্তেফাকে কর্মরত কবি আল মুজাহিদী এবং কবি মহাদেব সাহা ছাড়া তেমন কারো সঙ্গে আমার তো জানাশোনা নাই। তাছাড়া লেখাজোকা আমি তো ডাকযোগে পাঠাই। এরপর মোহসীন জানালো, চল একদিন ইত্তেফাকে গিয়ে শাহীন রেজা নূরের সঙ্গে দেখা করে আসি। আমি বললাম, চল একদিন।
এরপরে দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকায় কর্মরত আমার বয়োকনিষ্ঠ বন্ধু জহুরুল হক হলের ফাইজুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম, শাহীন রেজা নূর সম্পর্কে। ফাইজুল জানাল, এই শাহীন রেজা নূর শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে। ফাইজুলের ইত্তেফাক যাওয়া আসা আছে। সে শাহীন রেজা নূর সম্পর্কে আরো অনেক ইতিবাচক খবরাখবর আমাকে দিয়েছিল। ততদিনে ইত্তেফাকের সাহিত্যপাতায় এবং বিশেষ সংখ্যায় আমার কিছু গদ্য-পদ্য ছাপা হয়েছে। ফাইজুলই জানালো, ইত্তেফাকের নিয়মিত সাহিত্যপাতা দেখেন কবি আল মুজাহিদী আর বিশেষ সংখ্যাগুলো দেখেন শাহীন রেজা নূর। এখানে উল্লেখ্য যে, ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যায় আমার দুয়েকটি লেখা এর মধ্যে ছাপা হয়েছে। এবার এই বিশেষ সংখ্যাগুলোর সম্পাদক আমাদের কাঙ্ক্ষিত শাহীন রেজা নূরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে একটা সংগত হেতু পাওয়া গেল।
একদিন গেলাম সরাসরি ইত্তেফাক ভবনে। আমার স্পষ্ট মনে নাই আমার সঙ্গে ফাইজুল নাকি মোহসীন ছিল। আমরা ওনার চেয়ে বয়সে দুই যুগের ছোট আর উনি তখন চল্লিশের কোটায়। আমরা ওনার সামনে যাওয়ার পর পরিচয় দেবার আগেই উনি বললেন, বলো ভাই, তোমরা কী জন্যে এসেছো। আমি বললাম, কোন কাজে নয়, আপনাকে সালাম দিতে এসেছি। উনি বললেন, তাই, তাহলে বস চা-টা খাও। তারপর উনি বললেন, তোমরা কে, কী করো। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। তারপর উনি বললেন, তোমরা লেখাটেখা পাঠাতে পারো। আমি বললাম, আমি তো লেখা পাঠাই, ছাপাও হয়েছে। উনি বললেন, তাই নাকি। তারপর উনি আমার নামটা আবার জিজ্ঞেস করলেন। আমার নামটা শুনে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার লেখা তো ছেপেছি। আরো লেখা পাঠাইয়ো।
এই ছিল ওনার সঙ্গে প্রথম আলাপ-পরিচয়। এরপরে আরো দুই-একবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। এর মধ্যে ওনার ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার প্রয়োজনে তাকে অনেকটা বিদেশে দৌড়াতে হয়েছে। ফাইজুলের কাছ থেকে খবরাখবর পেতাম। এর মধ্যে আমিও জীবনের ঘানি টানছি এদেশ-ওদেশ করে। এই পর্যায়ে এসে আজও শাহীন রেজা নূরের কাছে প্রথম আলাপে শোনা একটি কথা মনে পড়ে, 'সাংবাদিকের জীবন হচ্ছে কুত্তার দৌড়ের মতো। কুকুর কেবল দৌড়াতে জানে, হাঁটতে জানে না। আদতে তো তাই'।
আর এরকম জীবনের সঙ্গে শাহীন ভাইয়ের পরিচয় তার জন্মের পর থেকেই। কেননা তার বাবা শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। সাংবাদিকতার জীবন যে নিশিদিন দৌড়ের ওপর তা শাহীন রেজা নূর দেখে দেখে বড় হয়ে উঠেছেন। বড় হয়ে এরকম জীবনে নিজেকে গেঁথে নিয়েছেন। সাংবাদিকতা তিনি করেছেন ভালবেসে, দায়বদ্ধতা থেকে। এই দায়বদ্ধতা দেশ ও দশের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, মুক্তবুদ্ধির ধারণ ও উৎকর্ষতা সাধনের নিমিত্তে। তার স্বাক্ষর রেখেছেন কথায়, কাজে, লেখায় এবং জীবনাচরণে। আর এরকম ব্যক্তিত্বের ভিত্তিটা নির্মাণ করেছিলেন তার বাবাকে দেখে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কলকাতা ফেরত তিনজন বিরল বাঙালি মনীষী যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন। এদের একজন হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আরেকজন হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেষোক্ত জন হলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। শিল্পাচার্যের জন্ম ১৯১৪ সালে, বঙ্গবন্ধুর ১৯২০ সালে এবং সিরাজুদ্দীন হোসেনের ১৯২৯ সালে। এরা একই প্রজন্মের, বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুর মতো সহমর্মী যোগাযোগ ছিল। কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিল্পাচার্য কলকাতা থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশে চারু ও কারু শিল্প শিক্ষার গোড়াপত্তন করলেন। তার প্রচার প্রসার এবং স্থায়ী ঐতিহ্য নির্মাণে অবকাঠামো স্থাপন করলেন। সহযোগিতা নিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু গোটা দেশটারই নবজন্ম দিলেন, স্বাধীন করলেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের ঘটনাক্রমের পর্যবেক্ষণ করে প্রখর দূরদৃষ্টি নিয়ে তার নির্যাস খবরের কাগজে তুলে ধরেছেন। সময় ও রাজনীতির গভীর মনস্তত্বটা তিনি ধারণ করেছিলেন। আমাদের টাঙ্গাইলে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, "হা করলে হামিদপুর বুঝে নেয়া"। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ততটা গভীরে বুঝতে পেরেছিলেন, তার ছাপ খবরের কাগজে রেখেছিলেন।
শাহীন রেজা নূর এই একই গুণ উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ থাকার পরও সেই যোগাযোগ নিজের নানা অজুহাত খুঁজে বৈষয়িক সুবিধা নেয়া বা পুরস্কার, পদ ও পদবীর পথ অবারিত করার মতো রুচি ও ব্যক্তিত্ব শাহীন রেজা নূরের মধ্যে ছিল না। তিনি ছিলেন নির্মোহ, নিভৃতচারী, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ একজন ব্যক্তিমানুষ।
তার পঠনপাঠন, বোঝার ক্ষমতা, বিশ্লেষণ করার মতো লেখক প্রতিভা থাকার পরও সেসব নিয়ে বাগাড়ম্বর পণ্ডিতি, ঝাড়িঝুড়ি মেরে জাতিকে ছবক দেবার জন্যে মুখিয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। 'খালি কলস বাজে বেশি' সময়ের পুরাটাই এক ভরা কলস ব্যক্তিত্ব তিনি। কত খালি কলস টকশোজীবী আর ছবকজীবীদের শব্দদূষণ বাড়াবাড়ির সময়ে কালেভদ্রে শাহীন রেজা নূর যখন শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় কোন দিবসে আমন্ত্রিত বিশেষ বক্তা হিসেবে কথা বলতেন, তা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ী; গভীর ভাবনার উদ্রেককারী। দূরদর্শনের কোন আলোচনায় তাকে ডাকা হলে, তিনি কথা বলতেন আন্তরিকতার সঙ্গে মার্জিত শব্দ ও জোরালো যুক্তি আর পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত সহকারে। গড়পড়তা টকশোজীবীদের নির্লজ্জ চাপাবাজির ঠিক উল্টোটা ছিলেন শাহীন রেজা নূর।
তার সংস্পর্শে এসে আমার মনে হয়েছে তিনি ছিলেন চোখে-মুখে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, চলনে-বলনে এমনকি লেখাজোকায় একজন মাটির মানুষ।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন বাংলায় এবং ইংরেজিতে। অনুবাদের হাত ছিল দক্ষ, লেখার হিম্মত ছিল, মোকাবিলা করার মতো দৃঢ়তা ছিল। এরকম দৃঢ়তার উদাহরণ ১৯৭১-এর 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'র সমান্তরাল কাফেলা 'প্রজন্ম একাত্তর'-এর যাত্রা। তিনি ছিলেন প্রজন্ম একাত্তরের আজীবন সভাপতি। অথচ এই পদ বা পদবীকে কখনো ব্যবহার বা দেখানোপনার কোনো বাড়তি বালাই তার মধ্যে ছিল না। এটা তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার কাজ বা দায়িত্বের অংশ হিসেবে। আর সেই দায়িত্ব ছিল ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী মানবতার শত্রু রাজাকার আল বদরদের বিচারের মুখোমুখি করার মধ্যে। এরকম দায়বদ্ধতা বোঝাতে শাহীন রেজা নূরকে তুলে ধরা যায় নিন্মোক্ত কথার মাঝে "তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে"।
১৯৭১-এ বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন শহীদ হবার পরে আর ১৯৭৫-এ জাতির জনককে হত্যা করার পরবর্তী বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম শাহীন রেজা নূরের পণটা এমনই ছিল। তিনি বাবার অবর্তমানে গোকুলে বেড়ে উঠেছেন। তার স্বাক্ষর রেখেছেন তার গোটা জীবন ধরে কথায় ও কাজে। শেষতক যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর এই কারণে শত্রুদের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু দমে যাননি, থেমে যাননি। শেখ হাসিনা এবং শাহীন রেজা নূরদের মতো গোকুলে বেড়ে ওঠা দেশপ্রেমিক মানুষগুলো ছিল বলেই ১৯৭১-এর দানব রাজাকারগুলোকে বিচারের মুখে ধরে আনা সম্ভব হয়েছিল।
অথচ এর বিনিময়ে শাহীন রেজা নূর ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসেব কষেননি। আমার সঙ্গে তার যখন পরিচয় তার বয়স চল্লিশের কোটায়। আর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৬৬ বছর বয়সে। প্রায় দুই যুগের পরিচয়ে দেখেছি তিনি ছিলেন কাজ পাগল। দুই দুইবার ক্যান্সারের মুখোমুখি হয়েও জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারাননি।
মৃত্যুর দুই দিন আগেও জামাত-শিবিরের রাজনীতির বিপদজনক থাবা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে জীবনের শেষ লেখাটি প্রকাশ করে গেলেন bdnews24.com-এ।
এরকম একজন মানুষকে আমরা চিনেও চিনিনি, জেনেও জানিনি। তার মূল্যায়নটুকু আমরা করিনি।
কতজনের পুরস্কারের তালিকা পৃষ্ঠা ছড়িয়ে যায়। পদক ও পদবী প্রদর্শনী ঘরের বৈঠকখানা এবং সিঁড়ি হয়ে বাইরের দরজা পর্যন্ত এলাহি এক পসরা। অন্যদিকে শাহীন রেজা নূর নিভৃত আড়ালের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এক বিপরীত ধারার মানুষ।
সাংবাদিকতার যে মানদণ্ড দিয়ে গেছেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তা অর্জনের জন্যে অবাধ স্বাধীনতা অপার দায়িত্ব ও অনুপ্রেরণার পরিবেশ তিনি পেয়েছিলেন ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যায়ে। তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিকতার একটি দর্শন। আর সেই দর্শনের প্রায়োগিক উদাহরণ ছিলেন তার ছেলে শাহীন রেজা নূর, আমাদের শাহীন ভাই।