Published : 10 Jan 2021, 05:45 PM
যে শব্দে একসময় মানুষের ঘুম আসতো, যে শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙতো, যে শব্দে মানুষের মন জুড়িয়ে যেত, যে শব্দে মানুষের মন-প্রাণ আনন্দে আপ্লুত ও বিমোহিত হয়ে যেত, যে শব্দে দুঃখ-কষ্টে মানুষের মন কান্নায় জড়িয়ে যেত- সেসব স্বাভাবিক ও সাধারণ শব্দ এখন কোথায়? শব্দ কি এখন শুধুই শব্দ? অবশ্য সব শব্দ বদলে যায়নি, সব শব্দ বদলে যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের ভালোলাগা ও ভালোবাসার সেই শব্দগুলো এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে অচেনা, অজানা, অপ্রত্যাশিত কিছু বিকট, উৎকট ও অদ্ভুত শব্দের ভিড়ে। তাই শব্দ এখন দূষণ, শব্দ এখন যন্ত্রণার, শব্দ এখন বেদনার, শব্দ এখন জীবনবিনাশীও! দূষণযুক্ত শব্দ থেকে তাই নিস্তার পাওয়াটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এখন খুব জরুরি।
বিশ্বের সকল উন্নত প্রাণী তথা মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে শব্দ। আধুনিক মানুষ শ্রবণ এবং দৃষ্টিসংশ্লেষিত ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। শব্দ একদিকে মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, অন্যদিকে তেমনি উচ্চ বা প্রকট বা বিকট শব্দ মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে মানুষ অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তারতম্য এবং ভিন্নতার কারণে শব্দকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। সুরযুক্ত শব্দ (Musical Sound) এবং সুরবর্জিত শব্দ (Noise)। সুরযুক্ত শব্দ যেমন: রাখালের বাঁশির সুর, রাখালের গান, পাখির কলতান, নদীর পানির মৃদু কলকল ধ্বনি, সেতারের সুর, সরোদের সুর, বেহালাসহ দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বা কণ্ঠ সংগীতের সুমধুর সুর ইত্যাদি।
অন্যদিকে সুরবর্জিত শব্দ যেমন: গাড়ির হর্ন, ইটভাঙ্গার মেশিনের শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, কলকারখানায় সৃষ্ট শব্দ, মিউজিকের শব্দ বা মাইকের শব্দ, ট্রেনের হুইসেলের শব্দ, বিমান ওড়ার শব্দ, পটকা ও আতশবাজির শব্দ ইত্যাদি। এই সুরবর্জিত শব্দই শব্দ-দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। যা আসলে মানুষের তৈরি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরিবেশ দূষণ এখন এক অসহনীয় মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। বিভিন্নভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ যেগুলি রয়েছে তার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম একটি।
আমরা জানি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) সাম্প্রতিক (সেপ্টেম্বর, ২০১৯) সময়ে পৃথিবীতে বসবাসের অযোগ্য শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সে তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে তিন নম্বর। অর্থাৎ বাস করার অযোগ্য শহরের তালিকায় সর্বনিম্নে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার পরে রয়েছে মাত্র দুইটি শহর। শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি ও পরিবেশ অন্যতম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, শব্দদূষণও এর আওতাভূক্ত। যদিও এ প্রতিবেদনটি নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা আছে কিন্তু এ বিষয়ে আমার সাথে আশা করি অনেকেই একমত হবেন যে, আমরা চাইলেই ঢাকা শহরের শব্দদূষণকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি। সার্বিক বিচারে ঢাকাকে তার সম্ভাবনার দিক থেকে বিবেচনা করলে বাসযোগ্যতার দিক থেকে শব্দদূষণসহ আরো অনেকক্ষেত্রেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় আসলে নেই।
যাহোক, এ তো গেল রাজধানী শহরের কথা কিন্তু এই দূষণ এখন শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক জুন, ২০১৭ সালে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আটটি বিভাগীয় শহরের শব্দের মাত্রা পরিমাপ বিষয়ক সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিটি শহরেই শব্দের উৎস হিসেবে যানবাহন এবং হর্ন শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী। এছাড়া নির্মাণ কাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মাইকিং, জেনারেটর এবং কলকারখানা ইত্যাদি শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বর্তমানে শব্দদূষণ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা খুবই আশঙ্কাজনক। কিন্তু এই সমস্যা মানুষেরই তৈরি। ফলে আমরা একটু সচেতন হলেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করাটা অসম্ভব কিছুই নয়। বাংলাদেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) অনুযায়ী, নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এরকম জায়গার ক্যাটাগরি অনুযায়ী দিন ও রাতের জন্য আলাদা আলাদাভাবে শব্দের 'মানমাত্রা' বা স্ট্যান্ডার্ড লেভেল নির্ধারণ করা আছে।
আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশ-পাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নিরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
অথচ চারপাশে স্বাভাবিক ও সাধারণভাবে তাকালেও লক্ষ্য করা যাবে যে, এই বিধিমালা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণাতেও দেখা গেছে, বাংলাদেশের কোথাও এই মাত্রা মেনে চলা হয় না, শব্দ সব জায়গায় এই মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। ফলে বিধিমালা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনগুলোয় সাইনপোস্ট স্থাপনের পাশাপাশি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেখাটা জরুরি হবে। প্রসঙ্গত, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা (Permament Deafness) হতে পারে। এছাড়া বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, দেশে ৩০টি কঠিন রোগের প্রধান কারণ ১২ রকম পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ যার মধ্যে অন্যতম।
শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। কোমলমতি শিশুদের স্নায়ু এমনিতেই থাকে দুর্বল। তারা স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চশব্দে আতঙ্কিত হয়। ফলে তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। যে শিশু নিয়মিত শব্দদূষণে আক্রান্ত তার শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে শ্রবণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ একটা শিশুকে বেড়ে ওঠার আগেই তাকে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। করে তুলছে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত।
শব্দদূষণের কারণে মনোসংযোগ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এছাড়া শব্দদূষণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাথা ধরা, কানে কম শোনা, খিটখিটে মেজাজ, পেটের আলসার, বিরক্তিবোধ, অনিদ্রা, মানসিক উত্তেজনা ও উদ্বিগ্নতা, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। যা সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পরিবেশসহ চারপাশের সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশকে ব্যাহত করে।
যানবাহনে ব্যবহৃত উচ্চশব্দের হর্ন শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। যানবাহনের চালকরাই উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ তৈরি করেন। যা মানুষের শ্রবণ ক্ষমতায় আঘাত করে। এতে শুধু গাড়ির আশে-পাশের মানুষজনই নন, গাড়িচালক নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ট্রাফিক পুলিশদের অবস্থাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দিনদিন শ্রবণ শক্তির সমস্যায় ভুগছেন এমন ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এ সকল বিষয়ে আমাদের দেশে খুব ছোট-খাটো দু একটি গবেষণা হলেও নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার এখনো ঘাটতি রয়েছে। যা নিয়মিতভাবে কিংবা নির্দিষ্ট সময় অন্তর হওয়া প্রয়োজন।
শব্দদূষণের ফলে সর্বস্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু'ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবাসিক এলাকার জনগণ নতুন ভবন নির্মাণে কাজে সৃষ্ট শব্দদূষণের শিকার হচ্ছেন। শহর এলাকাগুলিতে মধ্যরাত এমনকি সারা রাতজুড়ে নির্মাণকাজ চলে। কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কি-না, শিশুদের পড়াশুনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোন কিছুই অসময়ে নির্মাণ কাজের শব্দকে থামাতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্টতই বলা আছে, সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত নির্মাণ কাজের বিভিন্ন যন্ত্র যেমন: পাইলিং-এর কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের কাজ চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। যদিও ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলে প্রকৃত অর্থে কিছু নেই। এটি একটি উদাহরণ মাত্র, আইনের এ ধরনের আরও অনেক অসঙ্গতি ও দুর্বলতা রয়েছে, যা দূর করাটাও শব্দদূষণ থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য খুবই জরুরি হবে।
বিদ্যুৎ চলে যাবার পর জেনারেটরের শব্দ, উচ্চমাত্রার শব্দে হেডফোন দিয়ে গান শোনা, উচ্চমাত্রার হর্ন বাজানো, লাউডস্পিকারের শব্দ, নির্বাচন, বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন কারণে যেখানে সেখানে মাইক ব্যবহার ইত্যাদি কারণে জনগণ শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছেন। অনেকে তাই একে দূষণ না বলে 'সন্ত্রাস' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আমরা জানি, সম্প্রতি কক্সবাজার শহর থেকে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের পথে পর্যটকবাহী বিলাসবহুল প্রমোদতরি 'বে ওয়ান ক্রুজ শিপ' চালু হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা হয়তো পর্যটনশিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কিন্তু সমুদ্রের মাঝপথ দিয়ে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের পর্যটকদের নিয়ে উচ্চস্বরে সাউন্ডসিস্টেম বাজিয়ে ভ্রমণ করাটা শব্দদূষণ ও পরিবেশের ক্ষতি করছে কি-না তাও গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা ও খেয়াল রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২১ সাল শুরুর ক্ষণটিতে সারা রাতভর দেশব্যাপী একদল মানুষ পটকা ও আতশবাজির উল্লাসে মেতেছিলো। ২০২১ সাল শুরুর ক্ষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লাস করার মতোই একটা ক্ষণ। কিন্তু পটকা ফুটিয়ে, আতশবাজি বাজিয়ে বিকট আওয়াজে চারপাশ ভরে না তুলে কীভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে কোন ধরনের বিজয়োল্লাস কিংবা আনন্দোল্লাস উদযাপন করা যায়, তা বোধ হয় আমরা জাতি হিসেবে এখনো শিখিনি। সেই শিক্ষার আমাদের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শব্দদূষণসহ যে কোন পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের জন্য শিশুকাল থেকেই যদি এ ব্যপারে ভালোভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে এই শিশুরাই বড় হয়ে শুধু নাগরিক নয় সুনাগরিক তথা পরিবেশ সচেতন নাগরিক হয়ে সেমতো দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়ে উঠতে পারে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিৎ হবে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য বইয়ে সার্বিক পরিবেশ আঙ্গিক গুরুত্ব সহকারে চিন্তায় রেখে পরিবেশ সংক্রান্ত আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা।
সার্বিকভাবে এ সকল দিকগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে তাই হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা; হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি ও চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স দেওয়া; শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া; গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এছাড়া, একইসঙ্গে জেনারেটর ও সবধরনের শব্দ সৃষ্টির যন্ত্রপাতির মান নির্ধারণ করে দেওয়া; শব্দের মাত্রা কমানোর লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র না দেওয়াটাও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও এক্ষেত্রে দরকারি একটি পদক্ষেপ হবে। আবাসিক এলাকার মধ্যে কোন শিল্প কারখানা না রাখাটাও এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত হবে।
শব্দদূষণ সম্পর্কে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া ও সচেতনতা সৃষ্টি হলেও প্রচার মাধ্যম ও সংগঠনগুলোর মধ্যে গুরুত্ব দিয়ে তেমন কোন কর্মতৎপরতা বা কর্মপ্রয়াস খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটছে না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ প্রতিরোধে সচিবালয় এলাকাকে শব্দ দূষণমুক্ত করাসহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে এ সকল পদক্ষেপ যথেষ্ট পরিমাণে ও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন।
শব্দদূষণ স্বাস্থ্য, পরিবেশের ক্ষতি, ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্ষতিসহ বিভিন্ন বিবেচনায় পরিবেশকেন্দ্রিক বড় সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দীনতা, সর্বোপরি অসচেতন মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা সৃষ্ট শব্দদূষণের ফলে জাতি হিসেবে আমরা প্রতিনিয়তই নানাভাবে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছি।
মানুষের সৃষ্ট এই দূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশব্যাপী সর্বস্তরের জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয়ভাবে একটি কার্যক্রম গ্রহণ করাটা তাই এ মুহূর্তে খুব জরুরি। যার আওতায় মিডিয়া, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রকে যুক্ত করে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। আর সবচাইতে যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হলো, আমাদের ব্যক্তি আচরণের পরিবর্তন এবং সরকারি ভূমিকাকে জোরদার করা। প্রচলিত আইনে শব্দদূষণের শাস্তির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ রয়েছে। ফলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন হবে।
শব্দদূষণ ঘটছে নানাবিধ কারণে, তাই একক কোন প্রচেষ্টা বা সহজতর উপায়ে এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনাটা খুব কঠিন ব্যাপার। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছা, গণসচেতনতা তৈরি ও আইনে যতটুকু আছে, ততটুকুর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সকলকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। এজন্য শব্দদূষণ নিয়ে যে বিধিমালা রয়েছে সেটাও সকলের বোধগম্য করে ব্যাপক প্রচার করাটা প্রয়োজন হবে। প্রয়োজনে কমিউনিটিভিত্তিক কমিটি করে শব্দদূষণ সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের বিষয়ে তদারকির দায়িত্বও প্রদান করা যেতে পারে।
এছাড়া আরো যে সকল আইন, বিধি, ধারাসমূহ শব্দদূষণকে রোধ করতে পারে যেমন: স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, মোটরযান আইন ১৯৮৮, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ প্রভৃতি সে সকল আইন পর্যালোচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ হবে। আর এ আঙ্গিক বিবেচনা করে আবাসিক এলাকাগুলোকে বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তরিত না করার পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের সমন্বয় সাধন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হবে।
সভ্য সমাজ বিনির্মাণ, বুদ্ধিদীপ্ত, মার্জিত ও বিকশিত ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরির স্বার্থে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আজ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সকলের বিবেচনায় নেয়া সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পরিণত হয়েছে বলেই আমি মনে করি।
ফলে এখনই সময় আইনকে জনগণের অভ্যস্ততায় পরিণত করা। তাই আসুন শুধু আইন প্রণয়ন নয় তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রিত একটি পর্যায়ে নিয়ে আসি। সুরযুক্ত শব্দের সাথে জনমানুষের পরিপূর্ণ সংযোগ নিশ্চিত করে, সুরবর্জিত শব্দসমূহকে বর্জন করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে এসে দেশটাকে সত্যিকারার্থে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে তুলি।