Published : 21 Nov 2020, 08:43 PM
বাঁচানো গেল না সাব্বিরকে। মাত্র কয়েক ব্যাগ এ-পজিটিভ গ্রুপের রক্ত তাকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখতে পারত আরো বেশ কিছুদিন। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দেওয়া হলে চিকিৎসার জন্য আরো সময় পাওয়া যেত। সেটা হলে পরে নিয়মিত চিকিৎসায় হয়তো সেরে উঠতে পারত সে। উত্তর বাড্ডার ন্যাশনাল ইনিশিয়াল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সাব্বিরের ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছিল মাসখানেক আগে। মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি ছিল সে।
সাব্বিরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে। সপ্তাহ দু'য়েক আগে সন্ধ্যায় মহাখালীর টিবিগেট বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটি মেয়ে এসে রিনরিনে গলায় জানতে চাইলেন শান্তিনগরের বাস এখান থেকে পাওয়া যায় কিনা। যে গাড়ি আসছে তার কাছেই দৌড়ে গিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করছিলেন শান্তিনগর যাবে কিনা। শেষে ওই গন্তব্যের বাসে তুলে দেওয়ার কথা বলে আমার সঙ্গে আসতে বলি। বাসে বসে কথা হয় কিছু। ব্লাড ক্যনসারে আক্রান্ত ছেলের জন্য 'সাদারক্ত' আনতে শান্তিনগরে কোয়ান্টাম ব্লাড ট্রান্সফিউশনের অফিসে চলেছেন।
মেয়েটির নাম শাহনাজ। চারটি ছেলের মা। দ্বিতীয়জন সাব্বির। স্কুলে যাওয়া হয়নি শাহনাজের। কিশোর বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছিল। বাড্ডায় স্বামীর পারিবারিক ফলের দোকান। কিন্তু স্বামী হঠাৎ করে মারা যান এগারো মাস আগে। শাহনাজের বাবা-মাও মারা গেছেন। শ্বশুর-শাশুড়িও নেই। সবচেয়ে বড় ছেলেটিও নাবালক। ক্লাস নাইনে পড়ে। এখন মূলত স্বামীর ভাইরাই পরিবারটির দেখভাল করছেন।
দুর্ভাগ্য কাউকে এভাবে একের পর এক আঘাত হানতে পারে সহসা বিশ্বাস হতে চায় না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সাব্বিরের রক্তের গ্রুপ জেনে নিয়েছিলাম। ফোন নম্বরও বিনিময় হলো। পরে ফোন করেছিলেন শাহনাজ। নানা জটিলতায় সেদিন রাতে সাদারক্ত পাওয়া যায়নি। রক্তদাতা জোগাড়ের আকুতি জানালেন।
এ বিষয়ে একটা অভিজ্ঞতা আগেই ছিল। কিডনির জটিলতায় আক্রান্ত আমার আব্বার জন্য প্রায়ই রক্ত লাগত। ও-পজিটিভ গ্রুপের সেই রক্ত পেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। এক বছর ভুগে আব্বার মৃত্যু পর্যন্ত সেই রক্ত আমার বন্ধুরাই দিয়েছিলেন। সে অবশ্য অনেক আগের কথা। রক্তদান সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এখন। ফলে এক ধরনের বিশ্বাস ছিল আমার, এমন 'কমন' গ্রুপের রক্ত, সেভাবে চেষ্টা করলে বেশ কিছু দাতা হয়ত জোগাড় হয়ে যাবে। তখনই ফেসবুকে আবেদন করে দিলাম। বন্ধু, আত্মীয়, অফিস সম্ভব সবখানে জানিয়েও রাখলাম।
ইতোমধ্যে সাব্বিরের স্কুলের একজন শিক্ষিকা যোগাযোগ করে ছেলেটির চিকিৎসার জন্য তহবিল গঠনের কথা জানালেন। ক্যানসার হাসপাতালের একজন চিকিৎসকও যোগাযোগ করলেন। একটা কথা না বলে পারছি না। দুঃস্থ একটি শিশুকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের অপরিচিত কাউকে এভাবে ফোন করা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। বিষয়টি তাকে বলাতে তিনি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে এই লেখার মাধ্যমে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। যাই হোক, তিনি জানিয়েছিলেন, সাব্বিরের চিকিৎসায় যে প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে যথেষ্ট সাড়া মিলবে বলে তাদের আশা। তবে এজন্য ছেলেটিকে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। আমার একজন সহকর্মী ক্যান্সার রোগীদের সহায়তা করার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ পরিচালনা করেন। তিনি কোয়ান্টাম ব্লাড ট্রান্সফিউশনের কর্মকর্তাকে যোগাযোগ করে 'সাদারক্ত' করার প্রক্রিয়া বিনামূল্যে করার ব্যবস্থা করে দিলেন। চিকিৎসকদের পরিভাষাভারাক্রান্ত ব্যাখ্যা থেকে বুঝলাম, দাতার রক্ত যন্ত্রের মাধ্যমে সংশ্লেষণের পর তা রোগীকে দেওয়া হয়। সংক্ষেপে এটাই সাদারক্ত।
ফেসবুকে বারবার আবেদন করেও কোনো সাড়া মিলল না। বন্ধু-আত্মীয়দের মাধ্যমে চেষ্টাও কাজে এল না। পাঁচ নভেম্বর দুপুরে আমাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রক্ত জোগাড় করতে বলা হলো। বহু চেষ্টার পর বাসাবোর তরুণ ফাইয়াজকে পাওয়া গেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হলো তাকে। এই হাসপাতালের যন্ত্রে দ্রুত রক্ত প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব। কিন্তু ওজন কমের কারণে তার রক্ত নেওয়া গেল না। হঠাৎই মনে এল সাউন্ডরেকর্ডিস্ট-আলোকচিত্রী মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের কথা। তাকে ফোন করে রক্তদাতা জোগাড়ের কথা বলতেই একরকম ছুটে হাসপাতালে চলে গেলেন। তার নিজেরই এ-পজিটিভ।
রক্ত দেওয়া হলো, যন্ত্রের কাজও শেষ হলো। সাব্বিরের চাচা সেটি নিয়ে ছুটতে ছুটতে ক্যানসার হাসপাতালে গেলেন। ট্রান্সফিউশনও শুরু হলো। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেল। এত দিক থেকে এতগুলো মানুষ জড়ো হয়েও কিছু করতে পারলাম না আমরা।
করোনাভাইরাসের এই সময়টায় এসে রক্ত জোগাড় যে কঠিন হয়ে গেছে তার কিছুটা আঁচ পেয়েছিলাম জুলাই মাসে – আমার মা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর। তারও এ-পজিটিভ। অনেক চেষ্টা করেও রক্ত জোগাড় করা যায়নি। পরে ওষুধ-পথ্যে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সেই কঠিন যে এই কঠিন তা যেন হাড়ে মজ্জায় টের পেলাম এবার। তাই ফাইয়াজ আর কামরুজ্জামানের মতো সাহসী প্রাণের প্রতি কৃতজ্ঞতা কখনোই শেষ হওয়ার নয়। সব শঙ্কা ঠেলে সরিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারা।
গভীর বেদনার এই ঘটনা তুলে ধরার একটাই কারণ, সকলের সচেতনতা ও সাহস ছাড়া এই কঠিন পরিস্থিতি পার হওয়া সম্ভব নয়। ক্যানসার হাসপাতাল বিশেষ করে সরকারি ক্যানসার হাসপাতালগুলোতে রক্তদাতাদের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা যে এখনও গড়ে ওঠেনি সেই বাস্তবতা সম্পর্কেও জানা ছিল না আমার। এমনও হতে পারে, যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে তা থমকে গেছে। দুঃখের বিষয়, দেশবিখ্যাত রক্তদাতা সংগঠন বা কার্যক্রমের সঙ্গেও যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি আমরা। ইন্টারনেটে সবচেয়ে বিখ্যাত দু'টো সংগঠনের যে ফোন নম্বরগুলো দেওয়া আছে তার সবকটিতে যোগাযোগ করে হয় বন্ধ পাওয়া গেছে, নয়তো ফোন ধরেনি কেউ।
করোনাভাইরাসের মতো অতিছোঁয়াচে মহামারীর সময় জনগণের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহের ব্যাপারে পদ্ধতি-নির্দেশনা (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিওর–এসওপি) থাকা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে সেই নির্দেশনা হয়তো রচনাও করা হয়েছে। এই নির্দেশনা স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের পাশাপাশি সর্বসাধারণকেও জানানো প্রয়োজন যাতে তারা উপযুক্ত সতর্কতা মেনে রক্তদান করতে পারেন।
যত নির্দেশনাই থাক, এটা সত্যি যে মহামারীর এই সময়ে রক্তদান কার্যক্রম চালানো কঠিন। বিশেষ করে রক্তদাতা শুধু নিজে নন, তার পরিবার ও আশেপাশের মানুষের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি যেখানে মারাত্মক। কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়ার মানবিকতা থাকা জরুরি। প্রয়োজনটি সর্বজনীন। অন্যের পাশে না দাঁড়ালে নিজের পাশেও কাউকে পাব না যে!