Published : 27 Oct 2020, 01:36 AM
জীবন মৃত্যুর চিরায়ত নিয়মে মানুষ অমর হয় কর্মগুণে। মানুষের ত্যাগ মানুষকে আদর্শে পরিণত করে, সম্মানের আসনে আসীন করে। মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় তারা বেঁচে থাকেন। যুগ থেকে যুগান্তরে-প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত থাকে তাদের অমরগাঁথা। আবার অযত্ন, অবহেলায় পাদপ্রদীপের বাইরে চলে যায় অনেক কীর্তিমান। সমাজ ভুলে যায়, হারিয়ে যায় বিজয়গাঁথা। তেমনি ভুলে যাওয়া এক বীরের নাম মোজাহার উল্লাহ।
নৌ কমান্ডো মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত। অকুতোভয় এ বীর ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে গেরিলা যোদ্ধা এবং পরবর্তীতে নৌ কমান্ডো হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মোজাহার। ছিলেন অপারেশন জ্যাকপটের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মহান যুদ্ধে বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হলেও প্রচারবিমূখ এই বীর রয়ে গেছেন পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে। মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম ১৯৪৪ সালের ১৩ জুন চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার করেরহাটের ভালুকিয়া গ্রামে জন্মান। করের হাটের চত্তুরুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন করের হাটের কামিনি মোহন হাইস্কুল সংক্ষেপে যা কে এম হাইস্কুল নামে পরিচিত। ফেনীর পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন ফেনী কলেজে। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে এসে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ভর্তি হন করাচি ইসলামিয়া কলেজে। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন পাকিস্তান ইনসুরেন্স কর্পোরেশনে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত নিরীহ জনতার উপর বর্বর আক্রমণ চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ফলে ২৬ শে মার্চ থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয় রামগড় মুক্তি প্রশিক্ষণ শিবিরে। রামগড় হাইস্কুলের সে ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন মোজাহার উল্লাহ। ভারতে প্রবেশের পর কিছুদিন হরিণা ইউথ কাম্পে ছিলেন মোজাহার। এরই মধ্যে সাঁতার জানা, ডুব দিয়ে পানির নিচে থাকা ও শারীরিক সামর্থে যোগ্যদের বাছাই করা শুরু করে ভারতীয় নেভাল টিম। মোজাহার নাম লেখান সে দলে।
নির্বাচিতদের কলকাতার পলাশী নিয়ে যাওয়া হয়। ভাগিরথির উত্তাল পরিবেশে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। দুইমাসের বেশি কঠোর প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি শেষে চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ, মংলা প্রভৃতি স্থানে অপারেশন পরিচালনার জন্য কমান্ডো নির্বাচন করা হয়। চট্টগ্রামে অপারেশনের জন্য বাছাইকৃত হন ষাটজন নৌকমান্ডো। তিন ভাগে বিভক্ত চট্টগ্রাম অপারেশন গ্রুপের তিনজন অপারেশন কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে- মোজাহার উল্লাহ, শাহ আলম এবং আবদুর রশিদ। অপারেশন জ্যাকপট সফল করার জন্য আবদুর রশিদ গ্রুপ রামগড়, শাহ আলম গ্রুপ আমলিঘাট এবং মোজাহার উল্লাহ গ্রুপ বিভুইয়া ঘাট দিয়ে নৌকা যোগে মিরসরাই সমিতির হাট উঠার প্রস্তুতি নেন। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে কমান্ডোরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। পরবর্তীতে ছদ্মবেশে চট্টগ্রাম শহরে এসে নিরাপদ সেন্টারে অবস্থান নেয় কমান্ডোরা। মেডিকেল কলেজ অ্যাম্বুলেন্স ও ওয়াপদা লাইনম্যান ঠিকাদারের পিকআপে অস্ত্র পৌছে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। পরবর্তীতে তরকারির টুকরি, বাজারের ব্যাগ, মাছের ডালা প্রভৃতিতে করে অস্ত্র গুলো আনোয়ারা থানার লক্ষ্যার চরে পৌছানো হয়। ১৩ অগাস্ট ১৯৭১ কমান্ডোদের অস্ত্র চর লক্ষ্যা পৌঁছে। ১৪ অগাস্ট দিবাগত রাতে মোজাহার উল্লাহ গ্রুপ এবং শাহ আলম গ্রুপ পৌঁছান চর লক্ষ্যা খামার বাড়ি।
মোজাহার এবং অন্যান্যরা ছদ্মবেশে রেকি সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানিরা যেসব নৌবাণিজ্য পোতকে সরঞ্জাম ও অস্ত্র গোলাবারুদ পারাপারে ব্যবহার করছে সেগুলির সার্বিক অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে নেন। দেশি-বিদেশি যুদ্ধ জাহাজ, বাণিজ্য জাহাজ, কার্গো শিপ, তেলবাহী জাহাজ ইত্যাদি বাইশটি টার্গেট বেছে নেয় কমান্ডোরা। ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট রাত এগারোটায় নৌ কমান্ডো প্রস্তুতি চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়। সংকেত পেয়ে নদীতে নেমে পড়েন কমান্ডোরা। অপারেশনের অস্ত্র বলতে প্রতিজন ১টি করে ৬ কেজি ওজনের লিম্পেট মাইন, সাঁতারের সুবিধার জন্য পায়ের পাতা ফিন্স এবং জাহাজের গায়ে শেওলা উঠাতে ১টি ছুরি মাত্র।
মোজাহার গ্রুপের টার্গেট ছিল আল হরমুজ জাহাজ। পাক-আর্মি এটাকে সামরিক সরঞ্জাম পারাপারে ব্যবহার করতো। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র গোলা বারুদ খালাসের অপেক্ষায় ছিল। মোজাহার এবং তার সাথিরা যথাস্থানে মাইন লাগিয়ে স্রোতের অনুকূলে ফিরে আসেন। অন্যান্য কমান্ডোরাও যার যার টার্গেটে মাইন লাগিয়ে ফেরত আসে। ১৫ অগাস্ট দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিট থেকে থেকে ২ টার মধ্যে কমান্ডোদের লাগানো মাইন ফাটতে শুরু করে। আল-আব্বাস, আল-হরমুজ এবং ওরিয়েন্টাল বার্জ নং- ৬ ধরনের জলযান ডুবতে শুরু করে। এ অপারেশনই ইতিহাসে অপারেশন জ্যাকপট নামে পরিচিত। আল-আব্বাস, আল-হরমুজ ও ওরিয়েন্টাল বার্জ নং-৬ ডুবিয়ে দেয়ার সর্বাধিক সাফল্য বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অগাস্ট নাগাদ সুরক্ষিত সুবৃহৎ কৌশলগত অবস্থানে হামলা করা যায়নি। অপারেশন জ্যাকপট পাকিস্তানি সুরক্ষিত অঞ্চলে ভয়াবহ ক্ষতি করে এবং এই অপারেশনের সাফল্য দেশে বিদেশে আসন্ন স্বাধীনতার পক্ষে বিপুল শিহরণ জাগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংঘটিত নৌকমান্ডো কার্যক্রম পাক প্রতিরক্ষার নাভিমূলে আঘাত হানে। তার সুদুর প্রসারী প্রভাব বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ কমান্ডো অপারেশনের তিন মহানায়ক মোজাহার উল্লাহ, আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী এবং শাহ আলম। অনন্য সাধারণ সাহস, সহিষ্ণুতা, মৃত্যুঞ্জয়ী উন্মাদনা সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাক জাহাজ ডুবানোর স্বীকৃতিতে তারা বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে পাক আর্মির অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ধ্বংস কার্যক্রমে যার অক্ষয় অবদান, বাংলার গৌরব মুক্তিযোদ্ধা মোজাহার উল্লাহর চলে যাবার এক যুগ স্মরণে এই লেখা।
মোজাহার উল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়ে তার পরিবার। এদেশীয় রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় মোজাহার উল্লার বাড়ি ঘেরাও করে আগুন লাগিয়ে দেয় পাক বাহিনী। আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে তার পিতা শহীদ আলী আজমকে। যুদ্ধশেষে মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম তার প্রাক্তন কর্মজীবনে ফিরে যান এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার হিসেবে অবসর নেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শৌয, বীর্য ও সাহসিকতার প্রতীক মোজাহার উল্লাহ। বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের গর্ব মোজাহার উল্লাহ বীর উত্তম। চট্টগ্রামের এ মহান বীরের স্মৃতি ঢাকা পড়েছে অবহেলার চাদরে। তার স্কুল, কলেজ, যুদ্ধক্ষেত্র, কর্মস্থল কোথাও তার স্মৃতি চিহ্ন, বীরত্বের বিজয়গাঁথা চিত্রিত নেই। সময় এসেছে সময় পাল্টানোর, না হয় চলে যাওয়াটা বন্ধন ছিন্ন করে প্রস্থান করবে ইতিহাসের অনুচ্চারিত অংশে। এ মহান বীরের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।