Published : 07 Sep 2020, 08:16 PM
সম্প্রতি ঢাকা শহরের কুকুর নিয়ে কিছু মানুষকে মাথা ঘামাতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি নগরবাসী'র ব্যানারে কুকুরবিরোধী এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কর্মসূচি থেকে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকা নগরীতে বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। বিভিন্ন অলিগলিতে ২০-৩০টি পর্যন্ত কুকুর দল পাকিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যা অত্যন্ত ভীতিকর বিষয়ও বটে। ….এসব কুকুরের কামড়ে যে শুধু জলাতঙ্কের মতো প্রাণঘাতী রোগের ভয় থাকে তা-ই নয়, বরং হিংস্র কুকুরের কামড়ে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক তৈরি করা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু যত্রতত্র বেওয়ারিশ কুকুরের ঘোরাঘুরি নিরাপদ সড়কের বড় অন্তরায়। বিশেষ করে বেওয়ারিশ কুকুরের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৩০ হাজার কুকুর স্থানান্তর করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, "অনেকে বলছে যে, কুকুরে কামড়াচ্ছে, অনেকে বলছে বাসা থেকে বের হতে পারছি না, বাচ্চা-কাচ্চারা ভয় পাচ্ছে, আসলে নাগরিকদের দাবির প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।"
দেশে অজস্র অসংখ্য সমস্যা থাকতে কিছু 'নাগরিক' আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা কেন কুকুরের বিরুদ্ধে এমন সক্রিয় হয়ে উঠলেন তার বোধগম্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা যদি মশা, তেলাপোকা, ছাড়পোকা কিংবা ইঁদুরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন তবুও না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু কুকুরের বিরুদ্ধে এমন আদাজল খেয়ে লাগতে হবে কেন?
খুনি, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারী, ব্যাংক লুটেরা, বিদেশে টাকা পাচারকারী, মানব পাচারকারীদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচানোর দাবি তুলতেন কিংবা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বাঁচানোর কথা বলতেন, তাহলে বলার কিছু ছিল না। বরং সেই দাবির সঙ্গে অনেকেই একাত্মতা প্রকাশ করতেন। তা না করে বেওয়ারিশ কুকুরের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে হবে কেন? বেওয়ারিশ কুকুরই কি দেশের বা রাজধানীর প্রধান সমস্যা?
যে কুকুরগুলোকে নিয়ে হইচই হচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা কিন্তু খুবই সামান্য। তারা মানুষের কাছে একটু খাবার এবং একটু ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। এই দুটো জিনিস পেলে তারা কামড়ানো তো দূরের কথা ভক্তিতে গদগদ হয়ে লেজ নাড়বে। তাহলে কেন এই নিরীহ প্রাণীগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া?
অথচ এই মহৎ জন্তুটি একসময় আমাদের গ্রাম-গঞ্জ-শহরে অবাধে বিচরণ করত। রাস্তাঘাট, ফুটপাত দখল করে থাকত। এখন অবশ্য সমাজে ভিন্ন বিন্যাস। কুকুরের জন্য বরাদ্দকৃত আসন দখল করে নিয়েছে টোকাই, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, হকার প্রমুখ মানবসন্তান। কুকুর অবশ্য এখন অনেক ধনীর আভিজাত্য। তারা শখ করে কুকুর পোষেণ! ওগুলো অবশ্য ঠিক 'কুকুর' নয়, এদের পাপ্পি বা ডগ বলাটাই শ্রেয়। এদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী দেশি কুকুরের কোনো মিল নেই। গলায় শিকল সারাক্ষণ 'গার্ড অব অনারের' ব্যবস্থা, সর্বোপরি সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা—বিওয়্যার অব ডগ। কালের প্রবাহে খাঁটি বাঙালি কুকুরগুলোর (যাকে নেড়ি কুত্তা বলা হয়, অস্থি-চর্ম-হাড্ডিসার) আজ বড়ই আকাল! অথচ এই লুপ্তপ্রায় দেশি কুকুরগুলোর বিরুদ্ধেই আজ এত ক্ষোভ আর হিংসা!
মানবসমাজে কুকুর নিয়ে আলোচনা, এ নিয়ে গল্প-গবেষণার কোনো শেষ নেই। লুই পাস্তুর নামে এক বিজ্ঞানী তো কুকুরের কামড় ও এর ফলে সৃষ্ট জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে গিয়ে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় ব্যয় করেছেন। অপর এক রুশ বিজ্ঞানী পাভলভ কুকুর ও মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে সারা জীবন পার করে দিয়েছেন। এই জন্তুটি আমাদের সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আপাত নিরীহ, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাণীটি মানুষের অনেক উপকার করলেও কেন জানি বাঙালিরা গালি হিসেবেই একে বেশি প্রধান্য দিয়ে থাকে। পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব অথবা অন্য কোনো মহল থেকে জীবনে একবারও 'কুত্তার বাচ্চা' সম্বোধন শোনেনি—এমন অধম বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
তবে মানুষের মধ্যে কুকুরের প্রবণতাগুলোর অনেকগুলোই বর্তমান। হয়তো এ কারণেই মানুষের বাচ্চাকে আমরা… বাচ্চা বলি। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তার এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন, 'আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে' (যদিও কবির এই অভিলাষের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা কারো পায়ের কাছে না বসেও খুব সহজেই অনেকের ভেতরের কুকুরটাকে দেখতে পাই। কেউ কেউ অবশ্য তার ভেতরের কুকুরটাকে লুকাতে চায়; অনেকে আবার বেপরোয়া, তারা রাখঢাকের পরোয়া করে না)!
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও কুকুরকে উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে আনা হয়। যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে একটি গোষ্ঠী 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে অভিহিত করেছিলেন। যারা এ কথা বলেছিলেন, তারা অবশ্য নিজেরাই কামড়া-কামড়ি করে কবরে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন! থাক সেসব কথা। কুকুরের বিষয়ে বরং একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটি ভয়ংকর ভীতু কুকুর ছিল। আমরা আদর করে তাকে 'বাঘা' নামে ডাকতাম। ওর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যখনই সে লেজ গুটিয়ে উসাইন বোল্টের গতিতে রান্নাঘরে অথবা শোবার ঘরের চৌকির তলে আশ্রয় নিত, তখনই আমরা বুঝতাম বাড়িতে কেউ এসেছে। চোর, জামাই, মেহমান, ভিক্ষুক সবার ক্ষেত্রেই বাঘা একই রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত। সেটা ছিল তার এক আজব বৈশিষ্ট্য!
অনেকে দৃষ্টান্ত হিসেবেও ইদানিং কুকুরকে ব্যবহার করে। একবার একটি 'স্পোকেন ইংলিশ' ক্লাসে বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুফল সম্পর্কে একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক: এক বাঙালি যুবক বিলেতে লেখাপড়া শিখতে গেছে। বৈদেশিক একাকিত্ব ঘোচাতে সে তার পোষা বিড়ালছানাটিকেও সঙ্গে করে নিয়েছে। সেখানে হোস্টেলে বেশিরভাগ ছাত্রেরই রয়েছে পোষা কুকুর। গোটা হোস্টেলে বেড়াল ঐ একটিই। সেখানে ক্রমেই কুকুরগুলোর সঙ্গে বেড়ালটির সখ্য তৈরি হলো। আস্তে আস্তে বিড়ালছানাটি কুকুরের মতো কথা বলতে, চলতে-ফিরতে শিখল। দীর্ঘদিন পর ঐ যুবক দেশে ফিরে এলো। সঙ্গে বিড়ালটিও এলো। একদিন সেই বিলেতফেরত বিড়ালটি অপর একটি দেশি বিড়ালের সঙ্গে মর্নিংওয়াকে বের হলো। পথে একটি নেড়ি কুকুর বেড়াল দুটিকে আক্রমণ করে বসল। একপর্যায়ে বিলেতফেরত বেড়ালটি আত্মরক্ষার্থে রুখে দাঁড়ায় এবং ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বিড়ালের কণ্ঠে এমন নিখুঁত 'ঘেউ' 'ঘেউ' শুনে দেশি অশিক্ষিত কুকুরটি হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং জান বাঁচানো ফরজ মনে করে দৌড় লাগায়। কুকুরের খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার পর সেই বিড়ালটি অত্যন্ত গর্বভরে তার সঙ্গীকে বলে—দেখেছ তো বিদেশি ভাষা শিক্ষার সুফলই আলাদা!
কুকুর নিয়ে এ রকম বহু 'মর্মান্তিক কাহিনি' প্রচলিত আছে। সেসব লিখে কারো মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না। এ বিষয়ে বরং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরে যাই। ছোটবেলায় একবার আমাদের বাড়িতে এক স্বল্পপরিচিত মানুষ বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের 'বাঘা' ঘেউ ঘেউ করে শোবার ঘরের চৌকির নিচে আশ্রয় খুঁজছিল। এদিকে ঐ ঘেউ ঘেউ শুনে আগত ব্যক্তি ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। আমার ছোটো কাকা দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে অভয় দিলেন, 'ভয় পাবেন না। জানেন তো, যে কুকুর বেশি ঘেউ ঘেউ করে সে কামড়ায় না।' এ কথা শুনে ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, 'সে তো আপনিও জানেন, আমিও জানি। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে, আপনাদের এ কুকুরটা কি তা জানে?'
এ কথা শুনে যথেষ্ট চিন্তিত হয়েছিলাম। সত্যিই তো। এ মূর্খ কুকুরটি এসব নীতিকথা নাও জানতে পারে!
কুকুর নিয়ে মনীষীরাও অনেক কথা বলেছেন। অ্যালডাস হ্যাক্সলি বলেছিলেন, প্রত্যেক কুকুরের কাছে তার প্রভু হলো নেপোলিয়ন, তাই কুকুর এত জনপ্রিয়। মার্ক টোয়েন তো আমাদের মতো 'দ্বিপদী'-দের সঙ্গে এই 'চতুষ্পদী'-র তুলনা পর্যন্ত করেছেন। তার মতে, যদি আপনি ক্ষুধার্ত কুকুরকে খাবার দেন, ভালো করে তোলেন—সে আপনাকে কামড়াবে না। বরং সেটাই হচ্ছে একটি কুকুরের সঙ্গে মানুষের প্রধান পার্থক্য।
'সারমেয় সমাচার' নামে এক কবিতায় কবি শামসুর রাহমান মারাত্মক কিছু কথা লিখেছিলেন, 'ইদানীং কুকুর এবং মানুষের মধ্যে জোর/ প্রতিযোগিতার স্পৃহা বেড়ে গ্যাছে অতিশয়,/ কেউ কেউ নেড়ী কুকুরের চেয়েও অনেক বেশি ঘেউ ঘেউ করে,/ কামড়াতে আসে, নোংরা করে ঘরদোর।/ লেজ নাড়া আর পা চাটার কাজে এখন কুকুর/ মানুষ অপেক্ষা ঢের পেছনে রয়েছে,/ লজ্জা পেয়ে কুকুরেরা মধ্যপথে থেমে গিয়ে/ 'মনুষ্য হুজুর অনেক কামেল আপনারা', ব'লে ঠুংরি ওঠে গেয়ে।/ জগতে প্রসিদ্ধ বটে কুকুরকুলের প্রভুভক্তি;/ প্রভুর জীবন রক্ষা করার তাগিদে অকাতরে প্রাণ দ্যায় ওরা,/ কিন্তু মানুষেরা হুজুরের শক্তি থাকে যতদিন ততদিন তাঁবেদার,/ তোলে ঘরে সোনা দানা, আরো কত কিছু; প্রভুর গর্দান গেলে,/ পেছন দরজা দিয়ে পালায় কৌশলে লাশ ফেলে।'
তবে যে যা-ই বলুক, কুকুর যতই খ্যাতিমান, মহানুভব, পরোপকারী হোক না কেন, আমরা কেউই কুকুর হতে চাই না। আমরা চাই মানুষ হতে, মানুষের মতো বাঁচতে!
কিন্তু পারি কি?