Published : 01 Sep 2020, 05:17 PM
জীবনের বর্ণিল আলপথ থেকে বিদায় নিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। করোনাকালীন এই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই বিদায় নিলেন তিনি, পাশাপাশি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো ছিলই। প্রণব মুখোপাধ্যায় শুধু ভারতের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানিত রাজনীতিবিদ। ভারতের রাজনীতির আধুনিক পথচলা শুরু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। ভারতকে কূটনৈতিক বিশ্বে উচ্চাসনে নিয়ে যাওয়ারও প্রধান কাণ্ডারি তিনি। তার প্রয়াণে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধুকে। আজ প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি তখন সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে সামনে এসেছে তার মস্তিষ্ক নির্ভর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলা। একটা দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের আত্মপরিচয় মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ছোট হ্যান্ড স্যুটকেস নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের দেশে দেশে। পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির মানুষটি তখন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন জার্মানি ও ইংল্যান্ডের। একাত্তরে ইন্দিরা সরকারের সেই তরুণ নেতাই আধুনিক ভারতের প্রখর মেধাবী রাজনীতিকে পরিণত হন। নিজের স্বতন্ত্র বলয় তৈরি করতেও সক্ষম হন তিনি।
এ বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত আমার সম্পাদিত 'শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু' সংকলন গ্রন্থের জন্য তার অনুমতিক্রমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার লেখা 'বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এশিয়া অন্যরকম হতো' শিরোনামে প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলাম। সেই প্রবন্ধের উল্লেখযোগ্য অংশ হুবহু তুলে দিলাম:
"ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করলেও বাঙালিত্ব কখনো ভুলতে পারি না। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে এই প্রথম একটি বাংলা বইয়ের গ্রন্থাগার তাই গড়ে উঠেছে আমার আমলে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বহু পুস্তক রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'। আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসাবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া আমার প্রথম শিক্ষা।
অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে আমি যতটুকু জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন রাজনীতিতে আমার আদর্শ ইন্দিরা গান্ধী। মনে আছে, ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একবার সতর্ক করেছিলেন জীবন-সংশয় নিয়ে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল-'ওরা আমারই সন্তান। আমাকে কেন হত্যা করবে?' অথচ সেই সেনাবাহিনীর একাংশের হাতেই তার মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তার হত্যাকাণ্ডের বিচারও হয়েছে কিন্তু আমার মনে এখনও সন্দেহ রয়েছে, হত্যার ষড়যন্ত্র কতটা উদঘাটন করা গেছে। সাধারণভাবে হত্যাকারী কারা এখন আমরা সবাই জানি।
আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেননা, তিনি অত্যন্ত উদার নীতির প্রবর্তক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লাহোর যান। পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ও স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তার অবশ্য মূল কারণ ছিল-যেসব বাঙালি তখনও পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ছিল প্রধান। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল জোটনিরপেক্ষ। পাকিস্তানবিরোধী বলেই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মিশরের পক্ষ নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে তার ভাষণের কথা। আমি বলতে পারি, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ জননেতা। তার বাগ্মিতার তুলনা মেলা ভার। পরে তিনি এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এশিয়ার দুর্ভাগ্য যে, এ ধরনের মহান রাষ্ট্রনেতাদের অকালেই প্রাণ হারাতে হয়। বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বন্দরানায়েক-এরা জীবিত থাকলে আজ এশিয়ার চেহারা অন্যরকম হতো। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ ধরনের রাষ্ট্রনেতাদের আজ বড়ই অভাব।
যেদিন তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয় সেদিন আমি দিল্লিতে ছিলাম না; কলকাতায় ছিলাম। আকাশবাণীর সংবাদে খবরটা জানার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। স্বজন হারানোর মতো শোকাহত হয়েছিলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ফোন পেয়ে দিল্লি ছুটে যাই। মনে হয়েছিল যে, অশুভ শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তারা হয়তো সেখানেই থেমে থাকবে না। নবসৃষ্ট বাংলাদেশকে ফের অন্ধকারের রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভরত সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যাদ্বয় হাসিনা-রেহানা সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। তাই আজ বাংলাদেশ ফের মুজিব আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। আমি বলি, 'মুজিবইজম'। সেটিই তার দর্শন; বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
বলে রাখি, প্রথম থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডন থেকে দিল্লি আসেন, তখন প্রথম সম্মুখ সাক্ষাৎ। দীর্ঘদেহী ও বজ্রকণ্ঠের মানুষটিকে দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে গিয়েছিল। অনেক কথা হয়েছিল। তখন আমাকে দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন-'এ মানুষটির নাম প্রণব, আপনাদের জন্য বিশ্বের সর্থন আদায় করার লক্ষ্যে ছুটে গিয়েছিলেন। ওর জন্যই আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে।' সে সময় বঙ্গবন্ধুর মুখে আমার সম্পর্কে ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শুনে আমি কিছুটা লজ্জিত হয়েছিলাম।
সত্তরের দশকে আমরা দেখেছি, বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গোটা বিশ্বে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কাছে আদর্শ। আমার মননকে সবসময়ই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আলোড়িত করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রথম বিদেশ সফর হবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। তবে আবার একবার বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছা রয়ে গেছে। এবার যাবো ভারতের সাধারণ নাগরিক হিসাবে; একজন বাঙালি হিসাবে।"
১৯৬৯ সাল থেকে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পথচলা শুরু। ১৯৭২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস ছেড়ে সর্বভারতীয় কংগ্রেসে উন্নীত হন। ১৯৭৩ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথমবার ভারতের মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন। তখন তিনি উপমন্ত্রী ছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যে প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ভারতের রাজনীতিতে নিজের ব্যক্তিত্ব গড়তে সক্ষম হন তিনি। ১৯৭৩ সালে উপমন্ত্রী, ১৯৭৪ সালে প্রতিমন্ত্রী, আর ১৯৭৫ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
এরপরে জারি হলো জরুরি অবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন তিনি। এমনিতেই তখন জরুরি অবস্থা গোটা দেশে নিন্দিত হচ্ছিলো ইন্দিরার কংগ্রেস সরকার। যত দিন যাচ্ছিল, সরকারবিরোধী আন্দোলন ততই চাঙ্গা হচ্ছিল। জরুরি অবস্থার পরে যে নির্বাচন হয়েছিল ভারতে, ১৯৭৭-এর সেই নির্বাচন ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল কংগ্রেসকে। সেই বিরাট পরাজয়ের পরে অধিকাংশ বড় বড় কংগ্রেস নেতা ইন্দিরা গান্ধীকে ছেড়ে কংগ্রেস ত্যাগ করলেন। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় ইন্দিরা গান্ধীকে ছেড়ে গেলেন না, কংগ্রেসের সঙ্গেই নিজেকে পাকাপোক্ত করেছেন। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস ভাগ হয়ে গেল। সিনিয়র নেতাদের কেউ নেই ইন্দিরা গান্ধীর পাশে। ইন্দিরা শিবিরে হতাশার করুণ সুর। ব্যতিক্রম শুধু একজন, প্রখর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় তখনও সিদ্ধান্তে অটল, তিনি তখনও ইন্দিরা গান্ধীর পাশে থেকেই কংগ্রেসের হাল শক্ত করে ধরে আছেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বুদ্ধিদীপ্ত সহযোগিতা ইন্দিরা গান্ধীর জন্য সহায়ক হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে বিপন্ন সময় কাটিয়ে ওঠার। সেই বিপন্ন সময়ে কংগ্রেসের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর পরের অবস্থানটাই অর্জন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ায় ইন্দিরার কংগ্রেস; ১৯৮০ সালে প্রবল প্রতাপ নিয়ে ক্ষমতার মসনদ ফিরে পান ইন্দিরা গান্ধী। আর সেই ১৯৮০ সালেই ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর বিপন্ন সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর পাশে থেকে দলের হাল ধরার পুরস্কার ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেই প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করেছিলেন। একাধারে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং রাজ্যসভার প্রধান নেতা হিসেবে।
১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইন্দিরা মন্ত্রীসভায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর তিনিই ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দুঃসময় শুরু হয় কংগ্রেসে। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম দিকে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। বহিস্কৃত হয়ে আলাদা দল গড়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। চার বছর তাকে কংগ্রেসের বাইরে থাকতে হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে কংগ্রেস প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। দলে ফিরলেও আগের সেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে তিনি তখন অনেক দূরে। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে দলে ও সরকারে নরসিংহ রাওয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এবং সেই নরসিংহ-যুগ শুরু হতেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায়। প্রথমে তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদ পান। তারপরে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে কংগ্রেস। বিরোধী দলে থাকলেও কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই ছিলেন। ২০০৪ সালে পুনরায় সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেসের ইউপিএ জোট। প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিংহ। আর মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভাতেও প্রণব মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে হন অর্থমন্ত্রী। ২০১২ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণ করে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে।
রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করা আরেকটা নতুন অধ্যায় ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জীবনে। ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে অনেককেই দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে বসতে খুব একটা দেখা যায়নি। ফলে ভারতের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি হয়েই থেকে যাননি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বসে প্রকৃত অর্থেই ভারত ও ভারতের রাজনীতির একক অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন।
২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার আগে পর্যন্ত যে পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি ভারতের রাজনীতির পথ অতিক্রম করেছিলেন এবং ক্ষমতার অলিন্দে তার যে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল, তাতে রাষ্ট্রপতি পদে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে প্রস্থানই ছিল তার জন্য সম্মানের পথ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদে বসা কোনও রূপকথার গল্পের চেয়েও কম নয়। ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে তার মেয়াদ সসম্মানেই পূর্ণ করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
কংগ্রেসের রাজনীতিতে যে পারিবারিক বলয় প্রাধান্য পেয়েছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সেই পারিবারিক বলয় ছিল না। তার পিতা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তার সাফল্যের পিছনে ছিল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও প্রখর মেধা। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সম্মান করতেন, নানা বিষয়ে তার উপদেশ নিতেন। মহাত্মা গান্ধীর পরে একমাত্র প্রণব মুখোপাধ্যায়ই আধুনিক ভারতের সার্বজনীন আরাধ্য নেতা হয়ে উঠেছেন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত এক আইকনিক নাম।
২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর দৃশ্যত সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না প্রণব মুখোপাধ্যায়। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়েও তিনি দলমত নির্বিশেষে ভারতের রাজনীতির সার্বজনীন অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ উপ-মহাদেশের রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করলো। আর বাংলাদেশ হারালো বিশ্বস্ত বন্ধুকে। সকল রাজনৈতিক সংকটে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ত্রাতা।