Published : 28 Aug 2020, 01:16 PM
জমিদারি খালি আপনাদেরই আছে! আমরা কি মানুষ না? আপনারে এমন ময়লা নিতে বললে নিবেন? দোতলা থেকে বাড়িওয়ালা বিশাল এক ধমক লাগায়। ঐ জমিদারের বাচ্চা। তুই ময়লা নিবি না তো কি নিবি? তোরে কি মাসে মাসে টাকা দেই না? আর তোর ময়লা নিতে কষ্ট হয়, গন্ধ লাগে! ময়লা না নিতে চাস তো ভদ্রলোকের কাজ কর? কথাগুলো একজন ময়লাওয়ালাকে বলছেন ঢাকা শহরের একজন বাড়িওয়ালা। যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ময়লা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল শুধু। তার বক্তব্য ছিল ময়লাগুলো ভাল করে বস্তায় ভরে রাখা শুধু আর কিছু নয়। ওরা পরিচ্ছন্নতাকর্মী। প্রতিদিন ওদেরকে এই শহরটাকে পরিচ্ছন্ন করতে হয়। বিনিময়ে তারা কিছু টাকা পায় আর পায় এমন বঞ্চনা আর অবহেলা।
ঢাকা শহরটায় প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে, কারো কারো মতে আরও অনেক বেশি। আর এই শহরের পরিচ্ছন্নতা, একে বাসযোগ্য করার দায়িত্ব পালন করে এমন হাজার হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের একটা ছোট অংশ বেতনভুক্ত। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বড় অংশই বেতনভুক্ত না। এমন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাইরে শহর জুড়ে একটা বস্তা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিশোর-কিশোরীদের দল। আমরা এদেরকে টোকাই বলি। তারা কাঁধে একটা বস্তা নিয়ে এ শহরের অলিগলিতে ঘুরে কাগজ, প্লাস্টিক টোকায়, এই টোকাইদের বড় অংশটি শিশু। ধানমন্ডি পার্কে এক শিশুকে পেয়েছিলাম তাকে বলেছিলাম সারাদিন কাগজ ও ময়লা টোকায় কেন? সে যা বলেছিল তা ভাবলে এখনো আমার চোখে পানি আসে। তার বাবা নাই, মানে মাকে ছেড়ে চলে গেছে আর বাড়িতে বোন আছে কিন্তু মা অসুস্থ। সে সারাদিনে ঘুরে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা আয় করতে পারে আর তাই দিয়ে তার সংসার চলে। একটা প্যাটিস কিনে দিলে সে অর্ধেক খেয়ে বাকি অর্ধেক বোনের জন্য পকেটে ভরে এক দৌড়ে চলে যায়। ১২ বছরের সেই কিশোর কখনোই দুপুরে কিছু খায় না কারণ তার মা রাতের বেলাতেই শুধু রান্না করে আর রাতেই তারা একসাথে বসে খায়।
এই টোকাইরা এই শহরের জন্য, ভদ্র সমাজের জন্য খুবই সমস্যার সৃষ্টি করে বলেই শোনা যায়। এরা চুরি করে, নেশা করে, ক্রাইম করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই টোকাইরা আরেকটা কাজ করে যা আমরা করাতে বাধ্য করি। আমরা যা খাই বা ব্যবহার করি, তার প্রায় সবকিছুই এই শহরের রাস্তায় ছুড়ে ফেলি, নর্দমায় ছুড়ে ফেলি, বাড়ির পাশের স্তুপ করে রাখি ময়লার অট্টালিকা বানাই আর এই অসভ্য আর নোংরা শিশু-কিশোররা তা কুড়িয়ে এই শহরকে জঞ্জালমুক্ত করে। এই কাজটা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে কিছুই না কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় তারা শুধু প্লাস্টিক কুড়িয়ে যে ভূমিকা রাখে তা হাজার কোটি টাকা দিয়েও পাওয়া সম্ভব না। আচ্ছা তারা যে এই সামান্য কটা টাকার জন্য এই শহরের জঞ্জালগুলো পরিষ্কার রাখে তার অর্থমূল্য কত হবে, তার পরিবেশগত মূল্য কত হবে, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য কত হবে আমরা কি কখনোই ভেবে দেখেছি? না আমরা কখনোই তা করিনি। কারণ আমরা তাদের প্রতি কোনো ঋণ অনুভব করি না। এই শহর কোনো ঋণ অনুভব করে না। তাই তো এই শহরের প্রায় ৪০ লক্ষ ভাসমান, হকার, বস্তিবাসী, টোকাই, ঝুপড়িবাসী মানুষের খোঁজ কেউ নেয়নি। এই মানুষরাই কিন্তু এই লকডাউনে সকল রাস্তাঘাট পরিস্কার রেখেছে, সংসদ ভবনের সামনের রাস্তা, ভিআইপি সড়ক, বিমানবন্দর, কমলাপুর কিছু কি নোংরা ছিল? না সকল কিছুকেই স্বাভাবিক রাখতে হয়েছে। স্বাভাবিক ছিল না কেবল তাদের জীবন যারা প্রতিদিন এই শহরের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যারা ভোর হতেই একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আপনার দিকে ছুটে যেত, আপনার বাজারের ব্যাগটা মাথায় করে গাড়িতে তুলে দিত, বাসার কাজের মেয়েটা সারাদিন কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে যেত, দারোয়ানটা সারাদিন কতই না কাজ করত কিন্তু এগুলো আর হচ্ছে না গত প্রায় ৬ মাস হলো।
এই মানুষগুলো বেঁচে থাকল না মরে গেল তার খোঁজ এই শহর নেয়নি। সত্যিই নেয়নি। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৫০ জন গৃহপরিচারিকা ও সাধারণ মানুষের উপর অনুসন্ধান করে দেখেছি লকডাউনের পরে এখন পর্যন্ত কেউ তাদের একমাসের বেতনও দেয়নি। কেউ বলেনি যে কাজে আসতে হবে না কিন্তু তোমার বেতন পেয়ে যাবে। আর যারা দিন এনে দিনে খাওয়া মানুষ তাদের তো আর কোনো উপায়ই ছিল না। সরকারি খাদ্য সহযোগিতা কেউ কেউ পেলেও অধিকাংশ মানুষ কোনো সহযোগিতা পায়নি। কারণ হলো আমরা তাদের প্রতি কোনো ঋণ অনুভব করিনি। না রাষ্ট্র, না ব্যক্তি।
২৫ মার্চ থেকে আরও একটা ভয়াবহ সময় আমাদের সামনে চলে আসল লকডাউনের মধ্য দিয়ে। আমাদের বাসার গৃহকর্মীটি যিনি ৪টা বাসায় কাজ করে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করতেন তিনি পর্যন্ত রাতারাতি গ্রামে ফিরে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। তবে আমরা প্রতিমাসে তার বেতনটা বিকাশে পাঠিয়ে দিতাম। আমাদের গৃহকর্মী খালা গ্রাম থেকে ৪ মাস পর ঢাকা শহরে ফিরে এলো। খালার সেই ভঙ্গুর চেহারা বেশ ভাল হয়েছে কিন্তু তা মলিন হতেও খুব বেশি সময় লাগল না। ১৫ দিন যেতে না যেতেই খালা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কীভাবে চলবেন কী করবেন, বিধবা মেয়েকে কীভাবে টাকা পাঠাবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ ঢাকা শহরে তিনি যে ৪টি কাজ করতেন, ফেরার পর দেখা গেলো তার কাজ আছে মাত্র দুটি। তিনি যে ঘরটায় ভাড়া থাকতেন তার ভাড়াও এখন বেশি দিতে হয় কারণ ২ জন এখনও ফেরেননি। গ্রামে কেমন ছিলেন তিনি জানতে চাইলে বললেন, 'খালু গেরামে ভালাই আছিলাম। গেরামে তো রুগ নাই আর খাওনের কষ্টও অতো আছিল না। তাই বেশ আনন্দেই কাটছে। আর কত্তবছর পর এমন কইরা থাকলাম। কিন্তুক টেকা পয়সার একটু টান পড়ছিল। ঢাকা থেইকা তো মেলাডি টেকা নিয়া গেছিলাম, টেকা দিয়া চললাম ৩ মাস। কিন্তু শেষ মাসে আইসা ঋণ হইছে মেলা টাকা।" শহরে এসে খালার ঋণের বোঝা আরও বেড়েছে বিগত দুই মাসে।
একটি ঘটনার উল্লেখ করলাম মাত্র। আমি এ লেখার জন্য বেশকিছু সাক্ষাৎকারকে সম্বল করেছি আর কিছু গবেষণা লব্ধ তথ্য। তিনি পেশায় একজন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মকর্তা। গত কয়েক মাসে প্রতিষ্ঠানের বিশাল লস গুনতে হচ্ছে আর সেই অযুহাতে ৩ মাসের বেতন বন্ধ। বাড়ি ভাড়া, সংসারের খরচ আর করোনায় খরচ তো আরও বেড়ে গেছে। এদিকে বাবা মার প্রতিদিনের ঔষধের খরচ, এককথায় ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়েছেন আফসার সাহেব (ছদ্মনাম)। তিনি না পারছেন কাউকে কিছু জানাতে আর না পারছেন এই সংকট থেকে বের হতে। বাধ্য হয়ে তার ডিপিএসটা ভাঙ্গতে হয়েছে আর মেয়ের নামে জমা করা কিছু টাকাও ব্যাংক থেকে তুলে খরচ করতে হচ্ছে। আর ঋণও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
একটা বিজনেস গ্রুপে কাজ করতেন আসিফ। করোনাভাইরাস শুরুর মাসে তার চাকুরি চলে যায়। ভেবেছিলেন এর মধ্যে আরেকটা চাকুরি জুটিয়ে নিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু করোনার যাতাকলে পড়ে আসিফের এতই বাজে অবস্থা হয় যে মে-জুন মাসে এসে তার খাদ্য সমস্যা পর্যন্ত দেখা দেয়। এই সংকটের দিনে তার মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে খাদ্য সহযোগিতা নিতেও হলো। তিনি এই কষ্টে যন্ত্রনায় কাউকে কিছু বলতেও পারেন না। আর ঋণ তো হয়েছে প্রায় ৩০/৪০ হাজার টাকা।
আরেকজন ছোট্ট একটা দোকান শুরু করেছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে। বেশ চলছিল দোকান কিন্তু মার্চ মাসেই লকডাউন। ছোট ছোট দুটি বাচ্চা আর বউকে নিয়ে চাঁদ উদ্যোনের একটা বাসায় ভাড়া থাকেন ৬ মাস হলো। গত ৪ মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেছে কিন্তু মালিক দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র আয়ের উৎস দোকানটা চালু করার পর দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ। বাধ্য হয়ে তাকে বিশাল অংকের টাকা ধার করতে হয়েছে বাসা ভাড়া আর সংসারের খরচ চালানোর জন্য। খুব দুঃখ করে বললেন, ভাই নিজেরা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকালে তো আর সহ্য করা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই ধার করতে হয়েছে। জানি না এগুলো কবে নাগাদ শোধ করতে পারব।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটি গবেষণা কাজ করছি। সেখানে মূলত নিম্ন আয়ের ও মধ্যবিত্তের মানুষদের করোনাকালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিগুলো উঠে আসছে। প্রায় ৫০ জনের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি দেখেছি প্রায় ৯০ ভাগেরও অধিক নিম্ন আয়ের মানুষ ইতোমধ্যে ঋণগ্রস্থ আর মধ্যবিত্তের মধ্যেও এর হার ৭০ ভাগ। নিম্ন আয়ের মানুষদের আয় কমেছে প্রায় ৮০ ভাগ কিন্তু ব্যয় ঠিকই একই রয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের কম আয়ের প্রভাব গিয়ে পড়েছে মূলত তাদের খাবারের খরচের ওপর যা এই করোনাকালে তাদের আরও সংকটে ফেলছে। এই শহর এখন নিম্ন আর মধ্যবিত্তের কাছে ঋণের শহর ছাড়া আর কিছু নয়। আমি জানি না এই করোনাকাল তাদেরকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে! এই ঋণের শোধ হবে কিনা!