Published : 17 Aug 2020, 12:38 PM
যখন থেকে প্রদীপের আবিষ্কার হয়েছে, তখন থেকেই পোকা মরছে প্রদীপ-শিখায়। পুড়ে মরার জন্যে প্রদীপ নয়, পোকাকেই দোষ দেওয়া দস্তুর বাঙালি সমাজে। প্রমাণ, যুগান্তরের বাংলা প্রবাদ: 'পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে' কিংবা রবীন্দ্রনাথের পদ্য: 'পাখিরা আকাশে ওড়ে দেখিয়া হিংসায়, পিপীলিকা বিধাতার কাছে পাখা চায়। বিধাতা দিলেন পাখা, দেখ তার ফল। আগুনে পুড়িয়া মরে পিপীলিকা দল।'
মানুষ প্রদীপ জ্বালায়, কারণ আলো তার জীবনে অপরিহার্য। সেই প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে কিছু পোকা যদি বেঘোরে মারাও যায়, তাতে কী যায় আসে! প্রথমত, পোকারা নিজের বদস্বভাবে কিংবা কর্মদোষে প্রদীপের শিখার উপর এসে পড়ে। পোকার সংখ্যা এত বেশি এবং পোকার জীবন এতই অকিঞ্চিৎকর যে প্রদীপ নির্মাণের সময় পোকাদেরকে রক্ষার কথা মানুষ সাধারণত ভাবে না।
ভুলে গেলে চলবে না যে কোনো প্রদীপ নিজেই জ্বলে না। মানুষই নিজের বুদ্ধিবলে প্রদীপ বানায়, নিজের সুবিধার জন্য প্রদীপ জ্বালায়, প্রদীপশিখাকে অনির্বাণ রাখার চেষ্টা করে। কপালগুনে বেপরোয়া পুলিশ হয়ে জন্ম নিলে প্রদীপ বলতে পারত: 'যেমনে জ্বালাও তেমনে জ্বলি, (আমি) প্রদীপের কী দোষ?'
জীবন একটি শিকল, মানুষ এবং পোকা উভয়েই যে সেই জীবন-শৃঙ্খল বা শৃঙ্খলার অংশ – এই দিব্যজ্ঞান মহাপুরুষেরা যুগে যুগে মানুষকে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হয়নি। দৃশ্যত, পোকা জিনিসটা মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বটে। তেলাপোকা কাপড়চোপড় কেটে নষ্ট করে; ভীমরুল মানুষের গায়ে হুল ফুটিয়ে দেয়; মশা, ছারপোকা গায়ে কামড় দিয়ে রক্ত শুষে নেয়, সংক্রামক রোগ ছড়ায়। অপরাধ যত সামান্যই হোক, মানুষ শত্রুর শেষ রাখতে চায় না। মানুষ মাত্রেই পোকামাকড় মারতে চায়, না হলে এত শত কীটনাশক বাজারে বিকোচ্ছে কেন?
যেহেতু আলোও দেয়, আবার পোকাও মারে, সেহেতু প্রদীপ জ্বালালে মানুষ সাধারণত আপত্তি করে না। জনমত যাচাই করুন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ সুশীল প্রদীপের পতঙ্গহত্যার পক্ষে রায় দেবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন, নেহায়েতই কপালদোষে, প্রদীপশিখা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে যখন রক্তমাংসের মানুষ নয়, সমাজের সুবিধাভোগী কোনো সিংহমানব কিংবা কোনো আপনজনের মৃত্যু হয়, তখনই সুশীল কিংবা ফেসবুকারদের টনক নড়ে। কিছুদিন তারা হৈচৈ করে, তার পর আবার সব সুনসান। জ্ঞান ও যুক্তি অভ্যাসের কাছে হেরে যেতে বাধ্য। সুবিধার বিপক্ষে গিয়ে মানবতা কবে জিতেছে?
মানুষ যখন উপর থেকে প্রদীপের দিকে বিহগদৃষ্টিতে তাকায়, তখন প্রদীপের নিচে অন্ধকার দেখে বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অন্ধকার নয়, প্রদীপের নিচে আছে বিশেষ আকারের মাটির একটি পাত্র। সেই পাত্রে সঞ্চিত রয়েছে তৈল এবং আছে তৈলবাহী সলিতা। পাত্রের তৈল সলিতা বেয়ে শিখায় গিয়ে পৌঁছায়, যাতে 'শিখা অনির্বাণ' থাকে। মাটির পাত্রটি হচ্ছে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ। সলিতা বেয়ে তৈলের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ হচ্ছে সিস্টেম। অগ্নিশিখা হচ্ছে সমাজের অগ্রসর শ্রেণির প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।
বায়ুপ্রবাহের ভিন্নতার কারণে প্রদীপ বিভিন্ন ভাবে জ্বলতে পারে। কখনও কখনও শিখা বিপর্যস্ত হয়ে নিভেও যেতে পারে। আবার মুহূর্তের অসাবধানে, অবহেলায় সামান্য প্রদীপশিখা থেকে সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে যতগুলো নিয়ামক আছে: তৈলের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ, সলিতার মান, বায়ুপ্রবাহ – মরণশীল মানুষ তার সবগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, প্রাকৃতিক কারণে। তবে তৈল ও সলিতার মান যেহেতু মানুষের নিয়ন্ত্রণে, সেহেতু মানুষের পক্ষে সঠিকভাবে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অসম্ভব নয়, যদি সে ইচ্ছা করে।
এমন ইচ্ছা যে বেশির ভাগ মানুষ করে না, সেও প্রাকৃতিক কারণেই। পৃথিবীতে সব সময় কেক ছোট এবং খানেওয়ালা বেশি থাকে। অন্ততপক্ষে মানুষ তাই ভাবে, প্রকৃতিই হয়তো তাকে ভাবায়। কেকের বেশির ভাগ অংশ আমি, আমার বংশধর, আমার দলের লোকেরাই খাবে, খেতে হবে আমাদের, নতুবা জীবনসঙ্কট! এই ইচ্ছার নামই 'লোভ' এবং লোভের মূলে আছে মানবমস্তিস্কের জন্মগত একটি ফিচার বা স্বলক্ষণ: হিংসা। হিংসা মানব মস্তিষ্কে সর্বাধিক শক্তিশালী এক ইনবিল্ট তাড়না। প্রেম, বাৎসল্য – এগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্বলতর তাড়না। রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, কীভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যায়, যাতে যত দীর্ঘ সময় সম্ভব কেকের বৃহত্তম অংশের ওপর নিজের, নিজেদের দখল নিশ্চিত করা যায়। এই ইচ্ছা পূরণ হলে হিংসা নামক তাড়না সন্তষ্ট হয়ে মস্তিষ্কে ডোপামাইন নিসৃত হয়। মানুষ চরম সুখ অনুভব করে। 'সবাইতো সুখী হতে চায়!' – মান্না দের গাওয়া গান।
ক্ষমতাবানের সুখপ্রাপ্তির এক চমৎকার হাতিয়ার এই প্রদীপ, কারণ আগেই বলেছি, সে আলোও দেয়, কেকের দখল নিতে আসা পোকাও মারে। টু ইন ওয়ান, দুধার তলোয়ার, হজরত আলীর জুলফিকর। শাসক মনে মনে ভাবে: 'এ্যায়সে হাতিয়ারকো ইস্তেমাল নেহি করনা বেশক গুনাহ হ্যায়!' এমন অস্ত্র যে ব্যবহার করে না সে তো এক বোকা। কেকের ভাগ থেকে এই বোকা বঞ্চিত হবেই আগে পরে, বেঘোরে মৃত্যুও তার হতে পারে বিরোধী পক্ষের হাতে, অনেকানেক নেতার মতো।
ব্যতিক্রমী, অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের মনে হিংসা কম, প্রেম-বাৎসল্য বেশি। অসহায় কীটপতঙ্গের মৃত্যুর কারণ বলে কোনো কোনো প্রাণীপ্রেমিক প্রদীপকে অপছন্দ করতে পারেন। জৈনরা প্রাণীহত্যার ভয়ে রাতের বেলা প্রদীপ জ্বালায় না। ইহুদিরা শনিবার রাতে আগুন জ্বালায় না। কিন্তু পৃথিবীতে ইহুদি আর ক'জন? ভারতবর্ষে জৈনরা সংখ্যালঘু। প্রাণীপ্রেমিকেরা সারা পৃথিবীতেই বিরল। প্রাণীহন্তারকেরা পৃথিবীতে সংখ্যাগুরু বলে তাদের ইচ্ছা কিংবা কথাতেই সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
যদিও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই এককালে প্রদীপ ব্যবহার করত, এখন শুধু হিন্দুরাই প্রদীপ ব্যবহার করে তাদের পূজাআর্চায়। এমন লোকের অভাব নেই, যারা অতি সামান্য মাটির প্রদীপের মধ্যেও হিন্দুত্ব খোঁজে। এই প্রদীপ কোনো মতেই 'দেশি মাল' হতে পারে না – ভাবে তারা। ওরা নিশ্চিত, 'জানি দুশমন' ভারতই এই প্রদীপ বানিয়ে বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে অসহায় বাঙালি পোকামাকড়কে পুড়িয়ে মারার জন্যে। এই যে হিন্দুকে দুশমন মনে করে অ-হিন্দুরা, তার মূলেও আছে সেই হিংসা, কেকের বৃহত্তম অংশ দখলের তাড়না। হিন্দুর মনেও যে এই তাড়না নেই, তা কিন্তু নয়, কারণ একই হোমোসাপিয়েন্স তারা দুপক্ষই।
বাঙালি রূপকথা পছন্দ করে। ঠাকুরমার ঝুলির যে কোনো রূপকথায় কমপক্ষে একটি খলনায়ক বা খলনায়িকা থাকে। বহু বিচিত্র ঐতিহাসিক কারণে ভারত, ভারতীয় এবং হিন্দুদেরকে খলনায়ক বিবেচনা করার একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গিয়েছে পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, ঐ কেকের দখল নেবার জন্যেই। গল্পের অতি স্বাভাবিক নিয়মে হিন্দুরা নিষ্টুর হবেই এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বছর দুয়েকের মধ্যে ক্রসশিখায় শত শত পোকা অবলীলায় খুন করে ফেলা একটি হিন্দু প্রদীপের জন্যে অস্বাভাবিক কিছু নয়? নায়ক অ-হিন্দু ভাবে, ভাবতে ভালোবাসে, আমার ভাই, আমার রক্ত যদি হতো, তবে প্রদীপ এত খারাপ হতেই পারত না? হিন্দু বলেই না প্রদীপ এত শত পোকা মারতে পেরেছে! কার নির্দেশে প্রদীপ এত শত পোকা মেরেছে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মতো আগ্রহ কিংবা অবসর কোনোটাই বুজর্গ রূপকথার পাঠকদের নেই। গল্প শুনতে যে ভালোবাসে, গল্পের গরু গাছে উঠলেও সে অবাক হয় না।
প্রদীপ একাই কি প্রাণীহত্যা করে? হারিকেন, মোমবাতি, বিজলিবাতি, সূর্য… আলোর এসব উৎসও সদাসর্বদা প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয় না কি? আলোর উৎস যত বড়, যত শক্তিশালী হবে, অসহায় প্রাণীর মৃত্যুও তত অধিক সংখ্যায় হবার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের কারণে 'যত দোষ প্রদীপ ঘোষ'। প্রদীপের হিন্দুত্ব যদি কোনোক্রমে প্রমাণ করা যায়, তবে বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। প্রমাণ করা কঠিন কি, যখন জাতির একটি অংশ আগে থেকেই ভারতীয় হিন্দু প্রদীপের রূপকথা বিশ্বাস করে বসে আছে, আর কেই বা অস্বীকার করবে যে বাংলাদেশের জনগণ স্বভাবতই বিশ্বাসপ্রবণ।
প্রদীপের মধ্যে বিশেষ নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে যেসব 'গোবেশক' নিজেদের মনের গোপন সাম্প্রদায়িক দাদ-পাছড়া মজাসে চুলকে নিচ্ছেন, তারা প্রমাণ করছেন যে ঘাড়ের উপর তাদের পৈতৃক মাথাটা আছে শ্রেফ চুলকানোর জন্যে বা খুব বেশি হলে আঁচড়ানোর জন্যে। তারা হয়তো জানেন না যে হাজার বছর ধরে এই দেশের কুমোর পাড়াতেই হাজার হাজার প্রদীপ তৈরি হয়ে আসছে। বাংলাদেশের কুমারেরা এখনও অতটা অথর্ব হয়ে যায়নি যে সামান্য মাটির প্রদীপও হিন্দু ভারত থেকে আমদানি করতে হবে!
'কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাকো যদি দেবো গলা টিপে।' বেচার মাটির প্রদীপ ক্ষমতার স্বার্থ উদ্ধার করে ভাবে, সেও ক্ষমতার অংশ। বন যেমন বোকার মতো ভাবে, কুঠারের হাতলটা যেহেতু কাঠের, সেহেতু কুঠার আমার ভাই। হায়রে বোকা প্রদীপ, যে বন্দুকের বড়াই করো তুমি, সে বন্দুক তোমার নয়। স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলেই ক্ষমতা তোমার গলাটা টিপে ধরবে। তখন ভরসা করার মতো কাউকেই পাবে না তুমি পাশে। প্রদীপের কী দুর্ভাগ্য দেখুন। যুগে যুগে সকলেই তাকে ব্যবহার করেছে – জাতীয়তাবাদী, আওয়ামী উভয় দলই পদক দিয়ে মহাযত্নে স্বর্ণকুলুঙ্গিতে স্থাপন করে সামান্য প্রদীপকে অসামান্য করে তুলেছে। স্বার্থ যে উদ্ধার করে দেয়, তাকে সম্মানিত করাটা যেমন দস্তুর, তেমনি রতনে রতন চেনে, সে কথাটাওতো মিথ্যা নয়। চট্টগ্রামে প্রবাদ আছে: 'তুই দিয়ারে মুই দিয়া, ন দিয়ারে কে দিয়া!' এবং 'ঘাট ফারইলে ঘাইট্টা আলা' ('নদী পার হবার হবার পর ঘাইট্টা বা মাঝি শালা'!)।
প্রদীপ জাতির স্বভাব অগ্নিশিখা তৈরি করা, তাতে কে মরল আর কে বাঁচল, তা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য অন্ততপক্ষে প্রদীপের নেই। বেকুবের দল যখন 'হিন্দু' প্রদীপের ওপর সব দোষ চাপিয়ে মনে বিকৃত সুখ পায়, সারাজীবন ওর কাঁধে বন্দুক রেখে ক্রসফায়ার করে আসা ধান্দাবাজ অন্ধকার তখন হাহা হাসে। ভাবে, এই মূর্খ, স্বতঃবিভক্ত জাতিকে আরও বহুদিন 'দাবায়ে রাখা' যাবে।
এই গোলকধাঁধা থেকে উত্তরণের উপায় কী? আলো ছাড়াতো মানুষের চলবে না। বাঙালির মতো জাতি, যার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ তিনটিই মোটামুটি ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার জীবনেতো প্রদীপ অপরিহার্য। কিন্তু জাতির আলোক-প্রাপ্তির স্বার্থে নিরীহ পোকার জীবননাশ হবে, যুক্তিশীল মানুষ এ ব্যাপারটাও মেনে নিতে পারে না। দৃশ্যমান প্রাণীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে প্রদীপ থেকে আলোকপ্রাপ্তির কোনো উপায় আছে কি?
গণতন্ত্র, দ্রুত ও উচিৎ বিচার এবং মুক্ত গণমাধ্যম – এই তিনটি বটিকা নিয়মিত সেবনে দূরারোগ্য 'প্রদীপ রোগ' উপশম হতে পারে। ধরা যাক, প্রদীপের শিখায় কোনো নিরপরাধ পোকা খুন হয়েছে। এই ঘটনা অতি দ্রুত জনগণের গোচরে আনতে হবে। প্রদীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু খুন যারা করিয়েছে, তাদের নামও প্রকাশ করতে হবে গণমাধ্মে এবং দ্রুত বিচার করে তাদের শাস্তি বিধান করতে হবে। প্রদীপের নিচের স্বাভাবিক অন্ধকার নয়, উপরের অস্বাভাবিক অন্ধকার কমাতে হবে। সর্বস্তরে ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন করা যেতে পারে নির্বাচনের মাধ্যমে, ধরা যাক এক বছর অন্তর, প্রতি পহেলা বৈশাখে।
অবাক হবেন না। আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছিল মধ্যযুগের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রতি এক মাস অন্তর উপাচার্য পরিবর্তনের নিয়ম ছিল। ক্ষমতায় যত কম সময় থাকবে, তত কম দুর্নীতি করবে সরকার। ক্ষমতাকে আর বাপদাদার মৌরুসি পাট্টা মনে করবে না। লাঠি যত কম সময় সরকারের হাতে থাকবে, জনগণের পৃষ্ঠদেশে তত কম ব্যথা হবে। ইংরেজিতে যাকে বলে 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স', তার আলোকে ক্ষমতাকাঠামো পুনর্বিন্যাস করার বিকল্প নেই। নির্বাচনের খরচের কথা ভাবছেন? দুর্নীতি কম হওয়ার ফলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। নির্বাচন উপলক্ষে টাকার বিচিত্রমুখী স্রোত সৃষ্টি হয়ে চৈত্র মাসের নিত্য মঙ্গাটাও কেটে যাবে।
এই নিদান যদি কঠিন মনে হয়, তবে যেভাবে চলছে চলুক না। এক প্রদীপ নিভবে, দশ প্রদীপ জ্বলবে। প্রদীপের চাহিদা যে সমাজে রয়েছে, অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে প্রদীপের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ সেখানে থাকবেই। উপর মহলের কাছ থেকে 'লাইসেন্স টু কিল' পেলে পোকা থেকে সিংহ প্রদীপেরা কাউকেই রেহাই দেবে না। বন্দুক কি সামনে কে আছে বিচার করতে পারে? উপরে অন্ধকার যতই ঘনীভূত হবে, প্রদীপেরা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ওলটপালট করে দে মা, লুটেপুটে খাই! – এই নীতির কারণে নয়, নিজের স্বভাবের বশেই।
সামাজিক গণমাধ্যমে এলোপাথারি পোস্টিয়ে প্রদীপের উপরের অন্ধকার দূর করা যাবে না। অন্ধকার দূর করার জন্যেও প্রদীপই জ্বালতে হবে, তবে অন্য রকম প্রদীপ। সেই মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলনের ক্ষমতা কি বাঙালি জাতির আছে? হায়! হিন্দুয়ানী গন্ধ থাকায় এই প্রথাটিও বাংলাদেশে চালু হতে পারছে না। সব কিছুর মূলে কিন্তু মানবমস্তিষ্কের সেই জন্মগত হিংসা, মস্তিষ্কে নিসৃত সেই ডোপামাইন। হিংসা ঢালার একটা না একটা পাত্র দরকার হয়। সে পাত্র স্থান, কাল ও ক্ষেত্রবিশেষে কখনও হিন্দু, কখনও মুসলমান, কখনও ইহুদি, কখনও নাস্তিক ইত্যাদি।