Published : 29 Jul 2020, 06:06 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে দুটো খবরের সূত্র ধরে লেখাটা শরু করতে চাই। প্রথম খবরটি ছিল পহেলা জুলাইয়ে। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদযাপন করে। সংবাদটি ছিল এরকম, "শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন"।
দ্বিতীয় সংবাদটি এর সপ্তাহ তিনেক পরে। খবরটি এরকম, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট বাড়লেও কমেছে গবেষণা বরাদ্দ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত রাসেল সরকারের প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের ভঙ্গুর চিত্র কিছুটা উঠে এসেছে। জানা যায়, দুই বছর আগের বাজেটে গবেষণায় যত বরাদ্দ ছিল, গতবার তার চেয়ে কম ছিল। এবার আরো কমেছে। অথচ বাজেটের অংক প্রতিবারই বাড়ছে। বিগত পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বেড়েছে শতকরা ১০৪ ভাগ। অন্যদিকে মানদণ্ডের দিকে পিছিয়েছে শতভাগ সূচকে।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্তারা হরহামেশাই গবেষণার জন্যে অর্থ সঙ্কটের কথা বলে আসছেন। অবাক করা ঘটনা হচ্ছে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় করতে পারেনি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল গঠনের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে আলোচনার বিষয় করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশের পকেট ভারী করার জন্য সান্ধ্যকোর্সের নামে সনদ ব্যবসার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় আগেভাগেই সতর্ক করে দিতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন নিজস্ব তহবিল গঠনের নামে শিক্ষার্থীদের উপর ব্যয়ের বোঝা বাড়াবার পাঁয়তারা না করেন। ভুলে গেলে চলবে না শিক্ষা হচ্ছে অধিকার, কারো দয়া বা দাক্ষিণ্যের বিষয় না, কেনাবেচার মত পণ্য তো নয়ই।
জুলাই ২৩ তারিখের সিনেট অধিবেশনে সান্ধ্যকোর্স বন্ধের ব্যাপারে আলোচনা না হলেও অনলাইন ক্লাস চালু প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন সরবরাহের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে অতিরিক্ত অর্থ পেতে আবেদনের প্রসঙ্গও এসেছে।
এখানে আমার প্রশ্ন ক্লাসরুমের বাইরে কি কর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে ভাবতে পারেন না? কল্পনা করা যাক, ছাত্রছাত্রীদের হাতে স্মার্টফোন দেয়ার পর আর শিক্ষকদের দরকার মতো বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করে দিলেন। শিক্ষাবর্ষও সমাপ্ত হল। ধরে নিলাম পরীক্ষাও হল। তাতেই সারা?
করোনাভাইরাস মহামারী না আসলেও ডিজিটাল উন্নয়নের বিকল্প নাই। এবার সেই কাঙ্খিত উন্নয়নের জন্যে স্মার্টফোনে হবে না। দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্যে নিজস্ব ল্যাপটপ। স্বল্প ওজনের সহজে বহনযোগ্য ল্যাপটপ। এক্ষত্রে ২০ হাজার শিক্ষার্থীকে স্মার্টফোন সরবরাহের পরিবর্তে ল্যাপটপের কথা ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্তে যাবার আগে দেশের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির যোগসাজশে একটা সমন্বিত সিম্পোজিয়াম করে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কেননা প্রয়োজন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোরও।
প্রস্তাবিত ল্যাপটপগুলো শিক্ষার্থীদের একবারে বরাদ্দ না দিয়ে প্রতিটি সেমিস্টারের জন্যে বা শিক্ষাবর্ষের জন্যে ধার হিসেবে দেয়া যেতে পারে; গ্রন্থাগার থেকে বই যেভাবে ধার দেয়া হয়। আমার জানামতে এরকম ব্যবস্থা অনেক দেশেই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্যে চালু রয়েছে। আর এরপরের স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্যে সুদবিহীন ঋণ এবং বৃত্তির ব্যবস্থা থাকে। ঋণ শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনের শুরুতে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে বিশদ বিত্তান্ত থাকতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সরবরাহের পাশাপাশি নানা ডিজিটাল কার্যক্রম বা সম্ভাব্য প্রকল্প বা উপার্জন উপযোগী নানা প্রকল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে খণ্ডকালীন আয়ের ব্যবস্থাও করতে পারে। একজন শিক্ষার্থী টিউশন বা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেবার পরিবর্তে ঘরে বসে দুই ঘণ্টার জন্যে কম্পিউটারে নানা ডিজিটাল কার্যক্রমে অংশ নিয়ে অর্থও উপার্জন করতে পারে।
আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে তার নিজস্ব ধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। মূল্যায়ন, পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রমে আমূল সংস্কার প্রয়োজন। যেখানে ডিজিটাল সেবা কার্যক্রম যুক্ত হতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি কথা বলে নিতে চাই, দুনিয়ার মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায় থেকে গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত করে এবং শুরুতেই গবেষণায় দক্ষ আর আগ্রহী করে তোলে। গবেষণা কেবল গবেষক আর শিক্ষকদের বিষয় নয়। আমাদের অনেক শিক্ষক যারা দুনিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পড়াশোনা আর গবেষণা করে এসেছেন, তা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করতে অনীহা কেন? নিজেরা বিদেশে পড়ে আসবেন আর বিদেশে পড়াবেন এক রকম। সেই তারাই নিজের দেশে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালাবেন, বেসরকারি দোকানদারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটাছুটি করবেন। এটা কেমন কথা?
সময় এসেছে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ক্লাসরুমের বাইরেও ভাবার। বিশ্বের কিছু কিছু মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্যে নির্দিষ্ট বরাদ্দকৃত তহবিলের পাশাপাশি দেশি বিদেশি নানা উৎস থেকে তহবিল জোগানোর উদ্দেশে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে দেবার জন্যে আলাদা দফতর রয়েছে। যাদের কাজই হল বিভিন্ন বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক নানা প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে সংশ্লিষ্ট জায়গায় জমা দেয়া। শিক্ষকরা এসব প্রশাসনিক ঝামেলা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন। আমাদের শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতে দারুণ ঝোক। প্রশাসনিক কাজে মধুটা কী?
মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় একই সঙ্গে আন্তদেশীয় নানা গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়ে থাকে। আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের কর্তারা পড়ে আছেন গবেষণা থেকে যোজন মাইল দূরে। তা তাদের বাজেট উপস্থাপন থেকে আরেকবার খোলাসা হল।
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে গদগদ হই। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড যখন করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের প্রায় শেষ ধাপে, আমাদের 'অক্সফোর্ড' তখন করোনাভাইরাস পরীক্ষার ল্যাবরেটরিটিও বন্ধ করে দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা তিন সপ্তাহ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ সাধনের জন্যে 'হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা' বলে নানা বুলি আওড়ালেন। তার ঠিক তিন সপ্তাহ পরে এসে গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে তার উল্টোটা দেখিয়ে দিলেন। কর্তাদের কথা ও কাজের এমনই মিল!
ওনারা পারেন। স্বায়ত্ত্বশাসন বলে কথা! কী আর বলব? লালনের একটি গানের কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি:
এসব দেখি কানার হাট বাজার
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার॥
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে।
সাধু কানা অন বিচারে
আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে,
চেনে না সীমানা কার॥
এক কানা কয় আর এক কানারে
চল এবার ভবপারে।
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বারং বার॥
কানায় কানায় উলামিলা
বোবাতে খায় রসগোল্লা।
লালন তেমনি মদনা কানা
ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার॥