Published : 24 Jun 2020, 12:25 AM
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে কৃষাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাংলাদেশের কয়েকজন নাগরিক 'বিশিষ্ট নাগরিকের' তকমায় একটি বিবৃতি ছেপেছেন। প্রায় একই সময়ে আরেক দল সামাজিক আন্দোলনের পক্ষে ওই একই তকমায় পুলিশের হাতে গোপালগঞ্জের সংখ্যালঘু কৃষক হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন।
প্রথমোক্ত বিবৃতিজীবীদের সকলেই সরকারি ঘরানার এমনটাই প্রতীয়মান হয়। আর দ্বিতীয় বিবৃতিজীবীরা অধিকাংশ সরকারের বাইরের ঘরানার। প্রথম বিবৃতিবাদী দলে প্রায় গোটা তিরিশেক নাম ছাপা হয়েছে। দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনেকের সরকার থেকে নানা ব্যবসা পদ-পদবী ঠিকাদারি ও পুরস্কার নিয়ে এক্কেবারে শানসৈকত অবস্থা। তারা 'বিশিষ্ট নাগরিক' বটে। এই দলে আছেন সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলামনিস্ট, লেখক, নাট্যকার, বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ী, কর্পোরেট ঠিকাদার, অভিনেতা-অভিনেত্রী। যদিও তাদের কেউ কেউ আবার নানা 'ব্যক্তিত্ব' বা 'জন' অভিধায় উপস্থাপিত হতে ধন্য বোধ করেন। যেমন ধরুন সংস্কৃতজন, নাট্যজন এরকম।
আদতে সংস্কৃতি অঙ্গনের গাছের আগারটাও যেমন উনারা খান, তেমনি তলারটাও কুড়ান। বাস্তবে করোনাকালে সারাদেশে হাজার হাজার সংস্কৃতিকর্মী আয় রোজগারহীন দিন পার করছেন। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সেদিকে এদের কোন খেয়াল নাই। সে সময়ও তাদের নাই। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মোড়ল সেজে উনারা বসে আছেন মহাবিশিষ্ট সেজে। উনাদের পায় কে? ঘরে বসে বিবৃতি দিতে তো আর সমস্যা নাই।
দ্বিতীয় ঠিকাদারিভুক্ত দলে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিক, সামাজিক আন্দোলন নামধারী ক্লাবের হর্তাকর্তা এবং বিদেশি টাকা নির্ভর এনজিওর কুশীলবেরা। এই দলেও ব্যতিক্রম কয়েকজন ছাড়া সকলের অবস্থাই ফুরফুরে। করোনাভাইরাস, ঘূর্ণিঝড়, মহাদুর্বিপাকে এরা বক্তৃতা আর বিবৃতিতে ঘরে বসে আসমান জমিন উদ্ধার করার হিম্মত দেখান। কিন্তু সমস্যা হলো উনারা যতটা গর্জেন আদতে ততটা বর্ষেণ না। ফরমায়েশখাটা বিবৃতিজীবী।
এবার সামান্য একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন কি আমাদের সংবিধানের আলোকে 'নাগরিক' আর 'বিশিষ্ট নাগরিক' বলে কাউকে আলাদা করার সুযোগ নাই। সকলেই সমান, সকলেই 'নাগরিক'। এবার নাগরিক বোধ নিয়েও কিছু বলা দরকার। আমি এই দেশের একজন নাগরিক। তার অর্থ দাঁড়ায় আমিও এই দেশের মালিকদের একজন। এই দেশের ভাল মন্দ, মান মর্যাদা, সম্মান-অসম্মান আমার নিজের। অনেকে বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বিদেশের অর্থে বিদেশের স্বার্থে কলম ধরেন। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করেন। তারাও এদেশের 'বিশিষ্ট নাগরিক' দেশ বিদেশ থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত; বেশিদিন আগের কথা না। পদ্মাসেতু ঠেকাতে এরকম ষড়যন্ত্রের কথা আমরা প্রায়ই শুনি।
ব্রিটিশ আমলে এদেশের এবং ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ করে লেখকেরা সংঘবদ্ধভাবে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে কলম ধরেছেন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। মামলা মোকদ্দমা হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই ধারা অব্যাহত ছিল পাকিস্তান আমল জুড়েই।
আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় লেখকদের সংঘবদ্ধ অবস্থান বা বিবৃতি দেওয়ার রেওয়াজ খুব সম্ভব ১৯২১ সালে লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। তবে প্রকৃত লেখকের নির্দিষ্ট কোনও সংঘ হয় না। কেননা তারা ব্যাঙ এর মত। তাদের চিন্তা ও সার্বভৌম প্রকাশভঙ্গি কোন সংঘের কাঠামোয় ফেলা কঠিন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে নানা দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী আর দার্শনিকদের সবচেয়ে আলোচিত সম্মিলিত উদ্যোগটি 'রাসেল ট্রাইবুনাল' নামে পরিচিত। এটি আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে স্টকহোমে। নোবেলজয়ী ব্রিটিশ লেখক দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এবং ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের উদ্যোগে আর নেতৃত্বে। ট্রাইবুনালের উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।
এ প্রসঙ্গে আমরা ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত গণ আদালতের কথা উল্লেখ করতে পারি। এই আদালতের পেছনে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের উজ্জ্বল এক অবস্থান আমরা দেখি। তার তিন দশকে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের কি দেউলিয়া অবস্থা!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে আরও একটি কথা এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রায় এক হাজারের মত বুদ্ধিজীবী বিশেষ করে শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ মেধাবী প্রতিভাবানদের হত্যার ফলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎটা হয়ে গেল মূলত ধান আর চিটা বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ। তাও আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ফলে বাংলাদেশের এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতার উত্থান হল- দিনে দিনে ধান বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কমতে থাকল। আর চিটা বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো।
এখন তো প্রায় পুরোটাই চিটা বুদ্ধিজীবীর কাল। বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যও সিঙ্গারা-সমুচা নিয়ে ছবক দিয়ে থাকেন। আরেক জনপ্রিয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার কথায় কথায় পরীক্ষায় নকলের বিরুদ্ধে নসিহত করেন। অথচ নিজে বিদেশি বই আর চলচ্চিত্রের কাহিনী নকল করে বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আবার জনপ্রিয় কল্পকাহিনী মাসুদ রানা সিরিজের মেধাসত্ব নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আবদুল হাকিমের মধ্যে সালিশি পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। খবর এসেছে মাসুদ রানা সিরিজের ৪৫০টি বইয়ের মধ্যে ২৬০টি বই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লিখেছেন শেখ আবদুল হাকিম; আর ছাপা হয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে। মেধাসত্ত্ব দপ্তর আবদুল হাকিমের অভিযোগের পরে তার পক্ষে রায় দিয়েছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা আপিল করবেন।
বুদ্ধিজীবীর অবস্থান প্রসঙ্গে কয়েকটা উদাহরণ দিতে চাই। সক্রেটিসের উদাহরণ তো হরেদরে আসে। জাঁ পল সার্ত্রে নোবেল পুরস্কারই প্রত্যাখান করেছিলেন। তিনি মনে করতেন কোন প্রতিষ্ঠানের কোন পুরস্কার গ্রহণ করে কার্যত ওই বুদ্ধিজীবী ওই প্রতিষ্ঠানের একজন হয়ে যান। তখন তার আর স্বাধীন সার্বভৌম ভাবমূর্তি আর থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ১৯১৯ সালে জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপট বিবৃত করে লেখাও ছেপেছেন। ব্রিটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার ২০০৫ সালে তার নোবেল বক্তৃতায় ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে নির্দেশ করে বলেছেন, "আপনারা পৃথিবীর এক নম্বর সন্ত্রাসীর নাম ও ঠিকানা জানতে চান? তার নাম টনি ব্লেয়ার, ১০ ডাউনিং স্ট্রিট, লন্ডন।"
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী শঙ্খ ঘোষকে সরকারের মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কাছে ভিড়াতে পারেন না। এই তো সেদিনও 'উন্নয়নের খাড়া' নামে এক কবিতা লিখে তৃণমূল সরকারকে সতর্ক করেছেন। তার বিপরীত আমাদের কবি লেখকরা পুরস্কারের বণ্টন নিয়ে গোপনে ও প্রকাশ্যে ফয়সালা করেন। এক কবি তো ফেইসবুকে রীতিমত ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা পুরস্কার ভাগিয়ে নিলেন। একজন কবি কি পুরস্কারকেও এতটা তোয়াক্কা করেন? এখন আবার লেখকদের বয়স ধরে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আহারে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাল, পুরস্কারের কাঙাল।
বুদ্ধিবৃত্তির এই পুরস্কার কাঙালযুগে বুদ্ধিজীবীরা 'বিশিষ্ট নাগরিক' সেজে বিবৃতি দিবেন। বেশ!
আমার লেখার শুরুতেই দুই দল বিবৃতিজীবীর কথা বলেছি। এরা বিবৃতি দিয়ে খালাস। এ খালাসি ভূমিকা থেকে কবে বেরিয়ে আসবেন?
আমাদের একের পর এক সংকট লেগেই থাকে।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যে স্বাস্থ্যকর লক্ষণ হতে পারে না। শ্রমশোষণের নামে কর্পোরেট দাসপ্রথাও মেনে নেওয়া যায় না। দুর্বলের উপর সবলের দাপট বা সংখ্যালঘুদের উপর জীবন, সম্পদ ও সম্পত্তির হুমকি প্রতিনিয়ত লেগেই থাকে। আদিবাসী উচ্ছেদ তো আছেই। এরকম অসংখ্য চলমান সঙ্কট।
এসব নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কার কী অবস্থান? ২০০৭ সালে মধুপুরের গারো নেতা চলেশ রিসিলকে মেরে ফেলা হল। তা নিয়ে আজ পর্যন্ত মামলা পর্যন্ত করা হলো না। তাকে তো ভূতে মারেনি। কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হল ১৯৯৬ সালে। আজ পর্যন্ত হদিস নাই। সর্বশেষ নিখিল তালুকদারকে মেরে ফেলা হলো। এরকম উদাহরণের শেষ কোথায়?
বিবৃতিজীবীরা বিবৃতি দিবেন হাওয়া আর তাল বুঝে। আর বুদ্ধিজীবীরা তালি দিবেন। এই তাল আর তালি কতকাল?