Published : 20 Jun 2020, 07:42 PM
'আমাদের দুর্গত জগতের তারাই সেরা মানুষ
নাম না বললেও তোমরা চিনবে
দীঘল সন্ধ্যার অগ্নিশিখাগুলিকে বুঝবে।'
– লুই আরাগঁ
(রণেশ দাশগুপ্ত অনূদিত)
দীঘল সন্ধ্যার আরেকটি অগ্নিশিখা আজ নিভে গেল। আমাদের এই দুর্গত জনপদের আরেকজন সেরা মানুষ কামাল লোহানী চলে গেলেন। সব জীবনই মূল্যবান, সব মৃত্যুই শোকাবহ। তবু মৃত্যুর এই চলমান ঢলে দু-একটি মৃত্যু আমাদের অস্তিত্বের শিকড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। থমকে দাঁড়াচ্ছি আমরা, ভাবছি অনেক কিছু। ভাবছি একটি প্রলম্বিত গৌরবময় যুগের কথা–যে যুগের তাঁরা শেষ প্রতিনিধি।
আমাদের মধ্যে যাদের জন্ম উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে কিংবা তারও আগে কিংবা সামান্য পরে, তাদের জীবনে একটি মহৎ সত্য সবসময় আলোকস্তম্ভের মতো দীপ্যমান হয়ে আছে। সে সত্যের নাম বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন- যার পরিণতি ঘটে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশে এত তিক্ত, এত ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাসঘাতকতার দায় মিটিয়েও আমরা ভুলতে পারি না একাত্তরের কথা। ভুলতে পারি না জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কথা, যার উথলে ওঠা দেখেছি ষাটের দশকে। ভুলতে পারি না সংস্কৃতির সেই সংগ্রামের কথা যা রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি মানুষের চেতনাকে প্রস্তুত করেছিল একাত্তরের মহাসমরের জন্য। সংস্কৃতির এই সংগ্রামের একজন নির্ভীক, লড়াকু সৈনিকের নাম কামাল লোহানী। তাকে কি কখনো আলাদা করা যাবে বাংলাদেশের সত্তা থেকে, তার ইতিহাস থেকে?
উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে কামাল লোহানী একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর যোগ ছিল বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে। একষট্টি সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং তেষট্টি সালে 'ছায়ানট' নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দুইটি উজ্জ্বল মাইলফলক। দুটি ঘটনার সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন কামাল লোহানী। তিনি 'ছায়ানটে'র সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। উনিশ শ সাতষট্টি সালে কামাল লোহানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় 'ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী।' এই সংগঠনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিল্পী আলতাফ মাহমুদও যুক্ত ছিলেন। 'ক্রান্তি'র গীতি-আলেখ্য 'ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে,' নাটক 'আলোর পথযাত্রী' এবং নৃত্যনাট্য 'জ্বলছে আগুন ক্ষেত-খামারে' এ দেশের গণমানুষের মুক্তির স্বপ্নকে নতুন ভাষা দিয়েছিল।
সাতষট্টি সালে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলে তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেখানেও সামনের সারিতে ছিলেন কামাল লোহানী এবং তাদের 'ক্রান্তি।' উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনেও ক্রান্তি হাজির ছিল মানুষের ধমনি জ্বালিয়ে-দেওয়া গান, নাচ আর নাটক নিয়ে। কামাল লোহানী রাজপথে সরব ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একজন নেতা হিসেবেও।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান। সংবাদ পাঠ করেছেন নিয়মিত। তাঁর উদ্দীপ্ত কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা সংবাদ শুনে একাত্তরের জুন-জুলাইয়ের চরম হতাশার দিনগুলিতেও আমরা আবার নতুন স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছি।
বিশেষ করে মনে পড়ছে উনিশ শ বাহাত্তরের দশ জানুয়ারির কথা যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেছিলেন। সেই মহাকাব্যিক প্রত্যাবর্তনের বেতার-ভাষ্যকার ছিলেন কামাল লোহানী। বাংলাদেশের এক গ্রামে কয়েকজন কৃষকের পাশে বসে আমি সেই জাদুকরি ধারাভাষ্য শুনে স্পন্দিত হয়েছিলাম। আর লক্ষ্য করছিলাম আমার কৃষক-বন্ধুদের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু।
স্বাধীন বাংলাদেশেও কামাল লোহানী প্রগতির পথ থেকে এক মুহূর্তের জন্য সরে দাঁড়াননি। উদীচী এবং আরও অনেক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সবসময় স্বপ্ন দেখেছেন আরও সুন্দর একটি ভবিষ্যতের। সব গণজাগরণের সম্মুখভাগে থেকেছেন।
বহু দ্বন্দ্বে আকীর্ণ বাংলাদেশের সমাজে এখন নানা বিভ্রান্তির গাঢ় কুয়াশা আমাদের দৃষ্টিকে ঢেকে দিতে চায়। ইতিহাসের পাঠ পরিবর্তন হয় বারবার। পাঁচ দশক আগে কী ঘটেছিল তাও বিস্মরণের বেনোজলে ভেসে যেতে চায়। এই পিচ্ছিল, প্রতারক সময়ে আমরা কামাল লোহানীকে কতটুকু ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দিতে পারব তা জানি না। কিন্তু তিনি তো দীঘল সন্ধ্যার অগ্নিশিখাই। তিনি আমাদের ইতিহাসের নির্মাতাদের একজন। অন্তত যাঁরা একটু আয়ত দৃষ্টিতে দেখতে পারেন ইতিহাসকে, তাদের কাছে। তাঁদের মনে তিনি একজন ভালোবাসার মানুষ এবং শ্রদ্ধেয় বীর হিসেবেই বেঁচে থাকবেন।