Published : 19 Jun 2020, 05:51 PM
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশ মোকাবেলা করছে কোভিড-১৯। চলছে অদৃশ্য এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার অব্যাহত সংগ্রাম। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন, বাড়ছে মানুষের মৃত্যু। জনমনে আতংক জেঁকে বসেছে। মানুষ টিকে থাকার জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাল্টে যাচ্ছে সকল পুরানো হিসাব নিকাশ। থেমে আছে অর্থনীতির চাকা। মানুষ বন্দিজীবন যাপন করছে। আর এর ফলে, সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষের অনেক অর্জন, অগ্রগতি আর সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ভয়াবহভাবে এই চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে থেকেই আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। অনেক অর্জনের মাঝে নারী পুরুষের সমতার সংগ্রামে দেশের অগ্রগতি বা অর্জন দেশ বিদেশে প্রশংসার দাবিদার হয়ে উঠছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ সংকটে অন্যান্য খাতের মতো নারী পুরুষের সমতার বিষয়টি সবচেয়ে বড় সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ঠরা মনে করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদার করাসহ অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার সংগ্রাম হবে আগামী দিনের মূল বিবেচ্য বিষয়। অন্য সব খাতের মতো নারীর অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার যে সংগ্রাম অব্যাহত ছিল তা কতটা অগ্রাধিকার পাবে, সেটি দেখার জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে। এ কথা সকলে স্বীকার করবেন যে, গত ২৫ বছর ছিল নারী আন্দোলনের জন্য একটি সোনালী অধ্যায়। সূচনা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, বেইজিং সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে সহযাত্রী হয়েছিল, তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল নারী। এতদিন ধরে অব্যহত প্রচেষ্টার ফলে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে অনেক বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল তা আজ থমকে দাড়িয়েছে। নানামুখি চলমান সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগসমূহ আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ফলস্বরুপ সংকটে পড়ছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এর পুরো প্রক্রিয়া।
সরকারি, বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে গ্রামীণ জীবনে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এসেছিল বেশ খানিকটা সাফল্য। এরই অংশ হিসেবে বড় অংশের নারীরা ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সরকারি নীতি আর বেসরকারি উদ্যোগের কারণে। কার্যত এসব ক্ষেত্রেই আজ নারীরা পড়েছে সবচেয়ে বড় বাধার মুখে। কোভিড-১৯ কালীন সময়ে লকডাউনজনিত কারণে সকল মানুষই এক রকমের ঘরবন্দি, এই সুযোগে স্থানীয় সরকারের যুক্ত একটি বড় অংশের নারী প্রতিনিধিরা সরকারি উদ্যোগের অংশীদার হতে পারেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। ত্রাণ বিতরণসহ মানুষকে সচেতন করার কাজে তাদের যুক্ত করা হয়নি। নারীরা জানিয়েছেন পরিবারের কারণে তারা যেমন ঘর থেকে বের হতে পারেননি ঠিক তেমনি তাদের উপেক্ষা করেই পুরুষ প্রতিনিধিরা ত্রাণ বিতরণসহ সরকারি নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ফলে একদিকে নারীরা তাদের ভোটারদের নিকট যেমন তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন, ঠিক অন্যদিকে এতদিনের লড়াইয়ের ফলে পুরুষদের কাছ থেকে তারা যে অধিকার অর্জন করেছিলেন তা আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে গেছে। নারীদের বাদ দিয়েও যে কাজ করা যায় সে বিশ্বাস আবার তৈরি হয়েছে পুরুষ প্রতিনিধিদের মাঝে। মোদ্দাকথা হচ্ছে স্থানীয় সরকার আবার ফিরেছে তার স্বেচ্ছাচারী পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভংগিতে। আর অন্যদিকে সংকটকালীন সময়ে নারীরা যে জনগণের পাশে থাকতে পারেন না এরকম একটি মৌলবাদী প্রচারণাও গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে যারা স্থানীয় সরকারে আছেন, আগামী দিনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক কিংবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের থমকে দাঁড়াতে হলো।
অন্যদিকে প্রতিদিন সংবাদপত্রে খবর বের হচ্ছে, নারীদের শ্রমে গড়ে ওঠা বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ব্যবসাসমূহ পূঁজির অভাবে প্রায় বন্ধ হবার পথে। গত মার্চ ২০২০ থেকে দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে শুরু হওয়া লকডাউনের কারণে অন্যসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো দেশের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কার্যক্রমও কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। জুন থেকে সীমিত পরিসরে জরুরি পরিষেবা কার্যক্রম, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নানান প্রতিবন্ধকতা ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার ফলে তাদের এতদিনের শ্রমে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলি বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশে কোভিড-১৯ সময়ে পরিবারের সদস্যদের খাবার যোগান দেয়া, নিয়মিত নানাবিধ চাহিদা মেটানোসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা তাদের দীর্ঘদিনের অর্জিত সম্পদ এবং পুঁজি হারিয়েছেন। একইসাথে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হারানোসহ তারা তাদের নিয়মিত ক্রেতা ও ব্যবসায়িক নেটওর্য়াকের বাইরে চলে এসেছেন। ফলে থমকে গেছে তাদের উদ্যোগ ও ব্যবসা। অন্যদিকে তাদের ওপর বাড়ছে ঋণের বোঝা। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরিবারে তাদের যে অবদান তা ক্রমান্নয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের এতোদিনের শ্রমে অর্জিত ছোট ছোট উদ্যোগ এবং ব্যবসা। ঘাড়ে চেপে বসেছে ঋণের বোঝা। সামাজিক কর্মকাণ্ডে কমেছে তাদের অংশগ্রহণ। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের পরিবারের শিশুদের শিক্ষাজীবনে। নিজেদের ব্যবসা বন্ধজনিত জটিলতায় তারা সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন না। তাদের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতা কাঠোমোয় তাদের যুক্ততার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার মধ্যে দিয়ে তারা যে স্থানীয় র্পায়ের বিভিন্ন কাঠামোতে যুক্ত হবার ক্ষেত্র তৈরি করছিল সেখানেও তাদের থামতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশব্যাপী বেড়েই চলছে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা। পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণ, তালাক এবং নারী নির্যাতনের নির্মম চিত্র প্রতিদিন ফুঁটে উঠেছে। এসময়ে নারী নির্যাতনবিরোধী চলমান সামাজিক আন্দোলন না থাকায় নারীদের এগিয়ে চলার যে পদযাত্রা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরিবারে তাদের যে অবদান তা ক্রমান্নয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নারীর এতদিনের সংগ্রামে অর্জিত সাফল্যসমূহ সংকুচিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৭ হাজার পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ৫৫০টি পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের। উল্লিখিত পরিবারের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ পরিবারের নারী ও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং পরিবারগুলোতে এ ধরনের ঘটনা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ফলে উভয় দিক থেকে নারীদের সামনে এগিয়ে যাবার পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে অর্থের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়ছে অন্যদিকে পরিবারে এবং সমাজে তারা নিগৃহিত হচ্ছেন। এর ফলে পরিবারে এবং সমাজে তারা তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছেন।
সবচেয়ে বড় আশার জায়গা ছিল রাজনৈতিক দলে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা। রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্দেশনার ফলে বাধ্য হচ্ছিলেন তাদের কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। সেটিও এখন ভেস্তে যাবার পথে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত ১৮ জুন- দল নিবন্ধন আইন: খসড়া প্রকাশ করে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে এর ওপর মতামত চেয়েছেন। এই খসড়ায় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হল, রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণে যে সময়সীমা ছিল, তা আর রাখতে চাইছেন না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ক সকল সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা দলের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন-২০২০ প্রণয়নের লক্ষ্যে খসড়া আইন থেকে বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো লিখছে, এক-এগার সময়কার এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে দলে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের বিধানটি এনেছিল। আরপিওতে ভিআইএ অধ্যায়টি সংযোজন করে প্রচলন করা হয়েছিল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া। সেখানে নিবন্ধন পাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল ২০২০ সালের মধ্যে দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণ করতে হবে। কিন্তু ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে এসেও ইসি জানাচ্ছে, কোনো দলই সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা পূরণ করতে পারেনি। তাই সময়সীমা আর বেঁধে দিতে চায় না সংস্থাটি। খসড়া অনুযায়ী, দলগুলো গঠনতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণের সময়সীমা নিজেরাই উল্লেখ করবে এবং প্রতি বছর তথ্য প্রদানের সময় ইসিকে নিজেদের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নারীপদ পূরণের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করবে। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪১টি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এই খসড়ার ওপর রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে আগামী ৭ জুলাইয়ের মধ্যে মতামত চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। এমনিতেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি করা এবং সেখানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে ছিল একরকমের অনিশ্চয়তা। নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয় অথবা আইনে পরিণত হয় তাহলে রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে যাবে। নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের যে উদ্যোগ তা নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের আইন পাশের মধ্যে দিয়ে ভেস্তে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করেন। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান ও নারী উন্নয়ন নীতিমালার সাথে এ বিষয়টি সাংঘর্ষিক। তাই জোরালোভাবে এখনই দাবি তোলার সময়।
নানা বিবেচনায় নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের যে ধারা বাংলাদেশ শুরু করেছিল আচমকা কোভিড-১৯ এসে তা থামিয়ে দেবার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করছে। চারিদিক থেকেই নারীর অগ্রগতিকে রুখে দেবার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় দেশের নারী আন্দোলনকে এগিয়ে আসতে হবে, মানবিক এই সংকট মোকাবেলার জন্য। এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে এর বিরুদ্ধে। দেশের এই সংকটকালীন সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বেসরকারি সংগঠনগুলো তাদের সামর্থ্য নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতা অথবা সরকার তাদের যুক্ত কেন করছে না এই মর্মে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, এই জায়গা থেকে সকলকে বেরিয়ে আসতে হবে। সম্মিলিতভাবে আবার মাঠে নামতে হবে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস, প্রজেক্ট নয়। এই দৃষ্ঠিভঙ্গী থেকে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। নারী যখন সংকটে পড়ে, দেশের অগ্রগতি তখন আপনা আপনি বিপদগ্রস্ত হয়, সংশ্লিষ্ট সকলকে একথা মনে রাখতে হবে।