Published : 11 Jun 2020, 04:38 PM
পাকিস্তান সৃষ্টির দেড় মাসের মাথায় জন্ম নেয়া শিশুটি বড় হতে হতে দেখেছে আদর্শিক দৃঢ়তার কারণে রাজনীতি পাগল বাবার ওপরে রাষ্ট্রের সার্বক্ষণিক নজরদারী। দেখেছে যখন তখন তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন এই আতংকে রয়েছেন পরিবারের সকলে। বিশেষ করে বড় কন্যা হিসেবে বাবার জীবনে আসা নানা ঝড়-ঝাপ্টা অন্য আর ভাই-বোনের চেয়ে বেশি দেখতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে তাকে।
তার চোখের সামনেই পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে যখন তখন নানা ছুতায় আটক করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার বাবাকে। ফলে, তিনি বুঝে গেছিলেন 'কারাগার' তার বাবার আরেক স্থায়ী ঠিকানা। তাও আবার শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নয় – এক জেলার জেল থেকে আরেক জেলার জেলে স্থানান্তর করা হতো তার জনককে। যেন 'জেল থেকে জেলে'র দুর্বিষহ জীবন পালনের জন্য এই বদ্বীপে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। তার ওপরে আসা সকল যন্ত্রণা উপেক্ষা করে জেলের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই তিনি থেকেছেন – মানুষের বঞ্চনার কথা, অধিকারের কথা, এবং সব অনাচার থেকে মুক্তির কথা ভেবেছেন। তাকে, তার রাজনীতিকে চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে রাষ্ট্র সর্বসময় তক্কে তক্কে থেকেছে, কিন্তু ক্ষ্যাপাটে এই লোকটির অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তার কাছে বারবার হার মানতে হয়েছে শাসকবর্গকে।
ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীনভাবে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে যাওয়া এই রাজনীতিক তাই জয় করেছেন মুক্তিকামী সকল মানুষের হৃদয়। তাই তিনি যখন জাতির ক্রান্তিলগ্নে নুরলদীনের মত 'জাগো বাহে কোনঠে সবায়…' বলে বজ্র হুংকার দেন – তখন এদেশবাসী 'গোল হয়্যা' বসে, 'ঘন হয়্যা' আসে। 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা' করতে প্রস্তুত হয়। তাই জাতির জীবনে এই মানুষটি সবচেয়ে বড় আশার স্থল, বড় আপনার হয়ে ওঠেন। মাটির ভাষায় বলা তার কথা শুনে আরো ঘনিষ্ট হয়ে তার কাছে, তার মনের কাছে ভীড় করে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল বয়সের, লিঙ্গের, পেশার মানুষ।
সকলের মতো হাসুও জেনেছেন দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে রণক্ষেত্রে যাবার আগে মুক্তিযোদ্ধার দল অন্তরের সমস্ত শক্তি ও ভালোবাসায় হুঙ্কার দিয়ে বলেছে 'জয় বাংলা!' এবং সাথে সাথেই প্রশিক্ষণ শিবিরে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত তাদের কাণ্ডারীকে স্মরণ করতে মুক্তিযোদ্ধারা সমস্বরে জানান দিয়েছে, 'তোমার নেতা – আমার নেতা – শেখ মুজিব! শেখ মুজিব!' মুক্তিকামী, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পুর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে ক্রমশই বিশ্বব্যাপী হয়েছে। সারা বিশ্ব এই মহান নেতার অভূতপূর্ব তেজ দেখে বিস্মিত হয়েছে; আকুল হয়ে দেখেছে তার তেজে দীপ্ত মুক্তিকামী এক জাতি বিপুল নির্ঘোষে সশস্ত্র 'শত্রুর মোকাবেলা' করতে আগুয়ান। সেই জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে শত্রুমুক্ত হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সত্য, কিন্তু দেশবৈর শক্তি নিঃশেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঘাতকেরা তার নিজ বাসভবনে সেই মহান নেতার বুক স্টেনগানের বুলেটে বিদীর্ণ করেছে। শুধু তিনি নন, তার প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনী, সন্তান, সদ্য পরিণীতা পুত্র বধুদেরসহ আরো স্বজনকে হত্যা করেছে হন্তারকের দল। সেদিন একই ভাগ্যবরণ করার কথা বড় মেয়ে হাসিনার, ছোট মেয়ে রেহানারও। সে সময়ে তারা দেশের বাইরে থাকার কারণে প্রাণে রক্ষা পেলেন। হত্যাকারীরা ১৫ অগাস্টের হত্যালীলাতেই সন্তুষ্ট থাকেনি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার যেন কেউ করতে না পারে সে জন্য সংবিধানে আইন (ইনডেমনিটি বিল) সংযোজন করেছে। দেশকে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন করতে একই বছরের ৩ নভেম্বরে জেলখানায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতাকে। জার্মানী বঙ্গবন্ধু কন্যাদের বসবাসের জন্য তখন নিরাপদ নয় বিবেচনায় পঁচাত্তরের শেষভাগে তারা সেখান থেকে দিল্লীতে চলে আসেন এবং ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা শুরু করেন।
কি বেদনার! জাতির জনকের কন্যা হাসিনা-রেহানা ইচ্ছে করলেই ভারত থেকে বাংলাদেশ আসতে পারতেন না কারণ তাদের দেশে ফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল জিয়া সরকার। আর যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমনি যার একাত্তরে কৃত ঘৃণ্য অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু – সেই গোলাম আজমকে অবাধে দেশে আসতে দিয়েছে সেই একই জিয়াউর রহমান। শুধু কি তাই? খুব ঠান্ডা মাথায় পুরো দেশকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সহায়ক করে সাজাতে, দেশবিরোধী শক্তিকে পুনর্বাসিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাজনীতিকে 'ডিফিকাল্ট' করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিল জিয়া ও তার বশংবদেরা। এই দাহন কালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ রাজনীতির নবতর সরোবরে কোনোরকমে নাক ভাসিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। এই দল প্রায় ভেন্টিলেশনে চলে যাবার অবস্থায় পর্যবসিত হলে ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত হয়। সকল নিষেধাজ্ঞা ও ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে ঐ বছরেরই ১৭ মে হাসিনা স্বদেশে ফেরেন।
দেশে ফেরার পরে পুরো আশির দশক জুড়ে তাকে নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। ১৯৮৪ সালে দুবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। একবার ফেব্রুয়ারিতে, আরেকবার নভেম্বরে। আবার পরের বছর মার্চ মাসে তাকে তিন মাসের জন্য গৃহে অন্তরীণ করা হয়।
এরশাদ আয়োজিত ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ এবং তিনি ১৯৮৬-৮৭ সময়কালে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ভূমিকা রেখে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের এই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকে তীব্র সমালোচনা করেন খালেদা জিয়া ও তার সাত দলীয় জোট।
এরশাদ আমলে তাকে একাধিকবার হত্যা করার প্রচেষ্টা হয়। শোনা যায়, ১৯৮৭ সালে শেখ হাসিনার গাড়িকে লক্ষ্য করা ছোঁড়া বুলেট একজন নিঃস্বার্থ লীগকর্মী নূর হোসেনের বক্ষ বিদীর্ণ করায় অল্পের জন্য বেঁচে যান শেখ হাসিনা। এরপরও তাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা নেয়া হয়। তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনের সাথে দেশবাসীর যুক্ততা এরশাদ পতনে ভূমিকা রাখে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করলে এক দীর্ঘ সময়ের (জিয়াসহ) সামরিক শাসনের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয়ী হয়, কিন্তু জামায়াতে ইসলামের সাংসদের সহযোগিতা নিয়ে সরকার গঠন করে। এই বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের নাগরিক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের আমির ঘোষণা করলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গোলাম আজমের বিচারের দাবিতে গণআদালতের যে ব্যাপক আন্দোলন সূচিত হয় – সেই আন্দোলনে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তি সম্পৃক্ত হয়। সেখানে সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই আন্দোলন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করে। এ সময়ে ভারতের সাথে গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তি বিষয়ে নতুন পদক্ষেপ নেয় সরকার। এর বাইরে মূলত ইনডেমনিটি বিল রদ করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হয় এবং টেলিকম শিল্পকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে মোট ভোটের শতকরা ৪০ ভাগ পেয়েও আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসন পায়। মোট আসনের দুই তৃতীয়াংশ (২৩৪ আসন) পায় বিএনপি। ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরেই দেশজুড়ে বিএনপি'র তাণ্ডবের শিকার হয় আওয়ামীপন্থী বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার আরেক ন্যাক্কারজনক প্রচেষ্টা হয় ২০০৪ সালে। ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় সভা চলাকালে শেখ হাসিনা এবং সকল সিনিয়র নেতাদের হত্যা করার জন্য অতর্কিতে গ্রেনেড আক্রমণ হয়। আইভি রহমানসহ ২৪ জন মারা যান। আদালতে প্রমাণিত হয় যে এর সাথে কারা জড়িত ছিল।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিতে নির্বাচন হবার কথা ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে ওঠে। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াজুদ্দীন আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। লেঃ জেনারেল মুইনুদ্দীন সরকার চালাবার দায়িত্ব নেয়। সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হয়। ফখরুদ্দীন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'মাইনাস টু ফর্মুলা' এসময়ে প্রয়োগের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৭ এর ১ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৮ সালে জনৈক ব্যবসায়ীকে বিদ্যুৎ প্লান্ট বসাবার জন্য ঘুষ দিতে হাসিনা বাধ্য করেন এমন অভিযোগ আনা হয়। ১৮ এপ্রিল ২০০৭ এ সরকার হাসিনাকে দেশে ফিরতে বারণ করে। বলা হয় যে তিনি বাইরে এমন সব কথা বলেছেন যে দেশে এলে আইন শৃংখলার অবনতি হতে পারে। এটা সাময়িক আদেশ বলে জানানো হয়। একই সময়ে, খালেদা জিয়াকেও দেশত্যাগে বাধ্য করার উদ্যোগ নিচ্ছিল সরকার।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বারণ করায় শেখ হাসিনা খুব ক্ষিপ্ত হন এবং ২২ এপ্রিল ফিরে আসেন। দেশে আসার অব্যবহিত পরে তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে সরকার। এই মামলা যে সর্বৈব মিথ্যা এবং সাজানো সে বিষয়ে হাসিনা জোর দিয়ে বলেন ও আদালতে তিনি নিজেই এই মামলা লড়বেন বলে জানান। ২৩ এপ্রিল গ্রেপ্তারের আদেশ বাতিল করা হয় এবং ২৫ এপ্রিল হাসিনার দেশে ফেরায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
এর মাস কয়েক পরেই ১৬ জুলাই ২০০৭ এ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নিয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। জামিন না মঞ্জুর হয়। সংসদ ভবন এলাকায় একটি বাড়িকে কারাগারে রূপান্তরিত করে সেখানে তাকে রাখা হয়। ১৭ জুলাই ২০০৭-এ হাসিনা ও খালেদার কাছে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে নোটিশ দিয়ে বলা হয় তাদের সম্পত্তির হিসেব দিতে। তবে এসবই খালেদা ও হাসিনাকে দেশ ছাড়া করতে সামরিক শাসক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুরভিসন্ধি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এসময়ে পুলিশ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনে। যেখানে বলা হয় যে তিনি ২০০৬ এর অক্টোবর মাসে বিরোধী দলের ৪ জন সমর্থককে হত্যা পরিকল্পনা করেছেন। তখন হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন।
৩০ জুলাই ২০০৭-এ ঢাকা হাইকোর্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল করে। এবং জামিন দেয়। এর একমাস পরেই ২ সেপ্টেম্বরে ৩০ মিলিয়ন টাকা ঘুষ নেবার অভিযোগ আনা হয়। এর সাথে আরো ৬ জন জড়িত ছিল বলে বলা হয়। খালেদার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উত্থাপন করে।
১৩ জানুয়ারী ২০০৮ অর্থ লোপাটের দায় আনা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যা তিনি করেছিলেন শেখ রেহানা ও শেখ সেলিমকে সংগে করে। ৬ ফেব্রুয়ারী হাইকোর্ট এই অভিযোগ বাতিল করে দেন এই বলে যে জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে কৃত কোনো অপরাধের বিচার এই আদালত করতে পারে না।
১১ জুন ২০০৮ শেখ হাসিনাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয় চিকিৎসার কারণে। পরের দিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান তার কানের চিকিৎসার জন্য। এক যুগ পরে আজ সেই বিশেষ দিন। এই দিনের তাৎপর্য অনেক। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে শেখ হাসিনার ওপরে একের পর এক আঘাত এসেছে। শারিরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে না পেরে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ভিন্ন প্রচেষ্টা হয়েছে। ড. মুহম্মদ ইউনুসকেও রাজনীতির মাঠে ঘোড়া দাবড়াবার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। ভালো দিক হলো এই সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ১৩টির মধ্যে ১২টি মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে। এটি ছিল আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াবার সময়।
২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস জয় হয় আওয়ামী লীগের। কিন্তু শেখ হাসিনাকে চিরতরে সরিয়ে দেবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-এ সরকার গঠনের পরপরই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে বিপদাপন্ন করার চেষ্টা হয়।
একের পর এক নানা অপচেষ্টা তাকে এবং তার সরকারকে হীনবল করার জন্য নেয়া হয়। ২০১৩-তে গণ জাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন বানচাল করার অভিপ্রায়ে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলাম সমাবেশ করলে – উদ্যোক্তাদের নানা উস্কানিমূলক আহ্বানের প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানান খালেদা জিয়াসহ নানাজন।
পেছন ফিরে তাকিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের তিনটি অনভিপ্রেত ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০১৪-তে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আলাপ করার জন্য বিএনপি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাতে ফোন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ফোনালাপের জবাব কি অশালীন ভঙ্গীতে সেদিন খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন এবং কি ধরনের অসহযোগিতা করেছিলেন তা সকলের জানা। ফলে দেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হয়ে তা আরো জটিল পথে ধাবিত হয়েছিল। এর কিছু দিন পর খালেদা জিয়ার আহবানে কয়েক মাসব্যাপী পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস দেখেছে সারা বিশ্বের মানুষ।
ছোট সন্তান কোকো'র অকস্মাৎ মৃত্যুতে শোকবিহ্বল মাকে স্বান্তনা দিতে খালেদা জিয়ার বাড়িতে দেখা করার উদ্দেশ্যে গুলশানের বাড়ি অভিমুখে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 'খালেদা জিয়া ঘুমিয়ে আছেন' বলে প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ির ভেতরেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। গেটের বাইরে থেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে। এমনকি দলের দায়িত্বশীল কেউ এগিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়নি। এহেন আচরণকে আমরা কি বলতে পারি?
১৫ অগাস্ট – জাতীয় শোক দিবস। সমগ্র জাতির জন্য বেদনা বিধুর একটি দিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকা উত্তরসূরীকে দেখতে হয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর অকস্মাৎ আবিষ্কৃত হতে যে ১৫ অগাস্ট বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্মদিবস। জাতির এই কালো দিবসের তাৎপর্য ম্লান করে দিতে এই আবিষ্কারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তারা – পরম বেদনায় জাতি দেখেছে সকল সম্মানবোধ ও শিষ্টতাকে থোড়াই কেয়ার করে কি নির্লজ্জভাবে ১৫ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিশালাকৃতির কেকের সামনে খালেদা জিয়াকে দাঁড় করিয়ে দলীয়ভাবে 'হৈ-হল্লা, মহোৎসব' পালিত হয়েছে। কারো মৃত্যুদিবসে জন্মোৎসব পালন করায় বারণ নেই সত্য, কিন্তু যে কোনো দেশপ্রেমিক মানুষের এই উপলব্ধি থাকার কথা যে কেন এই দিনে ঘটা করে দেশের প্রধানমন্ত্রীর, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতার জন্মদিবস পালন করা যায় না। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, যার ডাকে মানুষ এই দেশ স্বাধীন করেছে, যিনি জাতির জনক – তার সপরিবারে হত্যাদিবস তো ভাবগাম্ভীর্যের সাথে সমগ্র জাতির এবং রাষ্ট্রের পালন করার কথা। কিন্তু যখন রাষ্ট্র তা না করে 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর', 'মাননীয় দেশনেত্রীর' জন্মদিন পালন করে – তখন তাদের রাজনৈতিক দর্শনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঘাটতি বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।
এই সব অনভিপ্রেত নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। সেই ছোটবেলার মতো এখনো বড় সন্তান হিসেবে নানা ঝড়-ঝাপ্টা সইতে হচ্ছে তাকেই, তবে এখন পাশে নেই বাবা, স্নেহময়ী মা। নেই কামাল, জামাল, রাসেল এবং আরো কতজনা!
বাবার মতো, কখনোবা বাবার চাইতেও বেশি একরোখা, ক্ষ্যাপাটে হবার কারণেই এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের আওতায় যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচার হচ্ছে। প্রতিদিন নিজের দলের মধ্যে, দলের বাইরে, দেশের মধ্যে, দেশের বাইরে নব নব উস্কানি, অন্যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত নানা বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। সামলাতে হয় সব চোয়াল শক্ত করে। করোটিতে পিতা-মাতা আর আপন স্বজনের নৃশংস হত্যার শিকার হবার স্মৃতি বহন করেও তিনি স্বপ্ন দেখেন এই দেশ মধ্যম আয়ের হবে, হবে উন্নত দেশ। নানা কুশীলবের পাতা নানা ফাঁদ ছিন্ন করে তিনি এই দেশে পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগ নেবার সাহস রাখেন। ওদিকে নিন্দুকেরা দিবারাত্র শাপ-শাপান্ত করে তাকে – 'সরে না কেন, নড়ে না কেন, মরে না কেন' এই সব ভেবে। কিন্তু দেশপ্রেমিক জাতির সৌভাগ্য যে, সেদিন দেশে ছিলেন না শেখ হাসিনা – থাকলে বাবার ভাগ্যবরণ করতে হতো তাকেও। তিনি আমাদের মাঝে রয়ে গেছেন বলেই আমরা এমন সব অভিজ্ঞতা বরণ করেছি যার তুল্যমূল্য একদিন ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই হবে এবং তিনি যে জাতিকে আবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সাহসী করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের গন্তব্যের দিকে এগুতে এক বিশাল ক্ষেত্র নির্মাণ করে দিয়ে চলেছেন – সে সত্য অবধারিতভাবে অনুধাবন করবে আগামী প্রজন্ম। এর মাঝে সমালোচনা করার মত অনেক কিছুই রয়েছে – কিন্তু সমাজ, দেশ, দল জুড়ে যে বিষ্ঠার উৎপাদন ও আমদানী হয়েছে – সেখানে চাইলেই রাতারাতি পরিচ্ছন্ন, নিপাট বাগান করা সম্ভব নয়। নানা প্রতিকূলতার এই সাগর ঠেলে এগিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। সব পায়ে দ'লে – নিশ্চয় তিনি জাতিকে আরো আরো এগিয়ে দেবেন।