Published : 10 Jun 2020, 12:15 PM
করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আমরা তিন মাস কাটিয়ে দিয়েছি। আরও কতদিন স্থায়ী হবে করোনাকাল তা কোনো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বা জ্যোতিষী বলতে পারছেন না। তিন মাসে দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। অনেক মানুষের জীবন গেছে। আরও যাবে। অতীতের ভাইরাস মহামারীর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। একশ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এবার কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের মরণকামড় কোথায় গিয়ে থামবে, বলা যাচ্ছে না। দেশে দেশে গবেষণাগারে গলদঘর্ম হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা করোনাবধের ঔষধ বা টিকা আবিষ্কারের চেষ্টায়। হয়তো অচিরেই টিকা বা অন্য ঔষধ আবিষ্কৃত হবে। নিয়ন্ত্রণে আসবে করোনাভাইরাস। তবে করোনাভাইরাস একেবারে নির্মূল হতে সময় লাগবে বলে আভাষ পাওয়া যাচ্ছে।
করোনাভাইরাস পৃথিবীর সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির চেহারা পাল্টে দেবে বলে পণ্ডিত-গবেষকরা অনুমান করছেন। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাববলয় তৈরির নতুন প্রতিযোগিতা কোন দিকে মোড় নেয় সবাই আগ্রহ নিয়ে তা প্রত্যক্ষ করবেন বা করছেন। তবে আগামী পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার হাত ছাড়া হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার নাম সামনে চলে আসছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা যে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সেটা আবার অনেক স্পষ্টভাবেই বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে। কাজেই বিদ্যমান অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা মানুষ আঁকড়ে থাকবে, নাকি নতুন পথের সন্ধান করবে, দেখার বিষয় সেটাও। তবে এখনই কোনো চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার সময় আসেনি। চরম বিপদ বা দুঃসময়ে মানুষ যেরকম ভাবনা ভাবে, বিপদ কেটে গেলে ঠিক সেভাবেই হয়তো আর ভাবে না।
আমরা বাংলাদেশে কেমন কাটালাম এই করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন মাস? একটি জাতীয় দৈনিকের ৮ জুনের প্রধান শিরোনাম: 'সমন্বয়হীন কাজে ঢিলেঢালা তিন মাস'। সরকারি মহল হয়তো এই শিরোনামের সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এরসঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত করবেন বলে মনে হয় না। বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, 'গত তিন মাসে আমরা অনেক কিছুই করেছি। কিন্তু প্রতিটি কাজই করেছি ঢিলেঢালাভাবে। সামনে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়, তা বিবেচনা করে সবকিছু আঁটসাঁটভাবে করতে হবে। ফাঁক রাখা যাবে না'। খুবই সঠিক কথা। আমরা সব ক্ষেত্রেই বলি বেশি, করি কম। সবকিছুতেই বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন ছিল তা করা সম্ভব হয়নি। না, সব দায়-দোষ অবশ্যই সরকারের নয়। নাগরিকদের কারো কারো সচেতনতার অভাব, কোনো নিয়মবিধি না মানার বেপরোয়া মনোভাব, প্রকৃত তথ্য গোপনের প্রবণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি – ইত্যাদির সামগ্রিক ফল হলো দেশকে এখন এক গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল চিত্র ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্যখাতে আমাদের দেশে বাজেট বরাদ্দ আশেপাশের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। আমরা উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছি কিন্তু কিসের বিনিময়ে সেটা ভেবে দেখিনি। জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে অবকাঠামের চাকচিক্যে বেশি মনোযোগী হয়েছি। সত্যিকার টেকসই উন্নয়ন বলতে কী বোঝায় তা উপলব্ধিতে নিতে পারিনি। গালভরা কেতাবি বুলি, মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। আমাদের অগ্রাধিকার বিবেচনার মধ্যে ঘাটতি আছে।
এটা ঠিক যে, আমাদের অর্থনীতি মজবুত হচ্ছিল। প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা গর্ব করছিলাম। অভাব-দারিদ্র্য কমছিল। তবে আয় ও ধনবৈষম্য বাড়ছিল। যার প্রয়োজন ১০ টাকা তার হাতে দুই টাকা তুলে দিয়ে তাকে আমরা খুশি করার চেষ্টা করেছি। আবার কারো দশ টাকার প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছি একশ টাকা দিয়ে। অনেককে দিয়েছি প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং মুষ্টিমেয়কে দিয়েছি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। যারা বেশি পেয়েছে তারা উদ্বৃত্ত টাকা উৎপানশীল কাজে না লাগিয়ে বিলাসিতায় ব্যয় করতে অভ্যস্ত হয়েছে আর একটি বড় অংকই বিদেশে পাচার করেছে। সরকার এটা বুঝেছে যে, আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ অল্পে তুষ্ট। অন্যদিকে যারা শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে শেয়ার বাজার লুট করে, ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়েছে তাদের কিন্তু চাহিদার শেষ নেই।
অল্পে তুষ্ট মানুষের জীবন যে জোড়াতালি দিয়ে চলছিল তা করোনাকালে নগ্নভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। কোটি কোটি মানুষের কোনো সঞ্চয় নেই। একদিন আয়-উপার্জন না করলে তাদের সংসার চলে না। সরকারি ত্রাণ সহায়তা না পেলে তাদের জীবন বাঁচে না। এই অবস্থাটা কী শক্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিচয় বহন করছে? করোনাভাইরাস এখনই আমাদের অর্থনীতিকে কাবু করে ফেলেছে। পরে অবস্থা কেমন দাঁড়াবে তা একমাত্র বিশ্ব পালকই বলতে পারেন।
প্রথাগত সংস্কার বা চুনকাম করে অর্থনীতির ভঙুর অবস্থা কাটানো যাবে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ, মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কালক্ষেপন করার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস দেখাতে হবে। সৃজনশীল উদ্যোগ-পরিকল্পনা যাদের আছে, তাদের সহযোগিতা গ্রহণের উদারতা দেখাতে হবে। বিপদ মোকাবেলায় সাধারণ মানুষের লোকজজ্ঞান থেকেও শিক্ষা নিতে হবে।
করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে বলে আমার ব্যক্তিগত আশঙ্কা। বেকার, আয়-উপার্জনহীন মানুষ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। ছিনতাই-রাহাজানি-চুরি-ডাকাতি বাড়তে পারে। এসব প্রবণতার কিছু কিছু খবর এখনই পাওয়া যাচ্ছে। সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রাও বাড়ার লক্ষণ স্পষ্ট। সংখ্যালঘুদের দোকানপাট লুট, বাড়িঘরে হামলা, জমি দখলের মতো অপরাধ সংঘটিত হবে আগের তুলনায় বেশি। এই করোনাভীতির মধ্যেও বহু জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর নানা রকম দুর্বৃত্তপনার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এরমধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রামের কৃষক নিখিল তালুকদারকে হত্যার ঘটনাটি বেশি আলোচনায় এসেছে। তাস খেলার অভিযোগে নিখিলকে পুলিশের একজন এএসআই শামিম হাসান এমনভাবে পেটান যে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকেও এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা হাঁটু দিয়ে ঘাড় চেপে ধরে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেছে। মৃত্যুর আগে ফ্লয়েডের আকুতি ছিল 'আই কান্ট ব্রিদ' – আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
রামশীলের কৃষক নিখিল পুলিশ কর্মকর্তা শামিম হাসানকে হয়তো ইংরেজিতে কোনো অনুরোধ করতে পারেনি তবে বাংলায় নিশ্চয়ই বলেছিল, স্যার, আর সইতে পারি না। আমারে মাইরা ফেইলেন না। শামিমের দিলে রহম হয়নি। নিখিল মরে প্রমাণ করলো তার মতো মানুষেরা রাষ্ট্রের কাছে কত অসহায়! নিখিল হত্যার অভিযোগে প্রথমে মামলা না নিয়ে তার গরিব পরিবারকে কিছু টাকা দিয়ে বিষয়টি থামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় কারো মধ্যে সুবুদ্ধির উদয় হয় এবং নিখিল হত্যার অভিযোগে মামলা নিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা শামিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শামিমের উপযুক্ত শাস্তি হোক – এটাই এখন প্রত্যাশা।
কোটালিপাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা। হিন্দু প্রধান এলাকা। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। সেখানে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় হয়তো প্রশাসনের টনক নড়েছে। তবে তারপরও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সাধারণত বিচার হতে দেখা যায় না। এই সুযোগ নিয়েই অপরাধী-দুর্বৃত্তরা একের পর এক অপরাধ সংঘটনে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। এটাও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, পুলিশ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষতা না পেলে অপরাধ করা কারো পক্ষে সহজ হয় না। পুলিশের মধ্যে ভালো খারাপ দুই-ই নিশ্চয়ই আছে। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির জন্য যেখানে মোটা অংকের টাকার লেনদেন করতে হয়, পুলিশকে যেখানে রাজনৈতিক তদবিরে তটস্থ থাকতে হয়, সেখানে সততা এবং অপরাধ দমনে নীতিনিষ্ঠতা প্রত্যাশা করলেও তা পাওয়া যাবে না।
করোনার পর এইসব বিষয়গুলো সামনে আসবে এবং বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। সুশাসন নিশ্চিত না হলে সামাজিক অস্থিরতা রাজনীতিকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। মানুষের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। পানি ঘোলা করে মাছ শিকারের সুযোগ কেউ যাতে নিতে না পারে, সেটা দেখার যাদের দায়িত্ব তারা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলেই ভালো।